এটা খুবই সহজ কথা যে, গণতন্ত্র ও দারিদ্র্য একসঙ্গে চলতে পারে না। সবাই বলেন এ কথা। সরকারি মন্ত্রীরাও। আসলে দারিদ্র্য হচ্ছে এক ধরনের ব্যাধি। খুবই বাজে রোগ সে। মানুষকে হেয়, বিব্রত, বিপন্ন করে। ছোট করে ফেলে। খুবই আত্মসচেতন করে রাখে। বিপদে ফেলে দেয় যখন-তখন, যেখানে-সেখানে। না, দারিদ্র্যের মধ্যে মাহাত্ম্য বলে কিছু নেই। অসামান্যদের কথা আলাদা, দারিদ্র্যের আগুনে পুড়ে পুড়ে তারা অনেকেই খাঁটি সোনা হয়ে উঠেছেন এ আমরা জানি।
জীবনীতে পড়েছি। তা ভেতরে সোনা ছিল বলেই ‘খাঁটি’ হয়েছেন, নইলে পুড়ে কয়লা হতেন, কিংবা ছাই; ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা সত্য। কাজী নজরুল ইসলামের সেই ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি আমি যতবার পড়েছি, কিংবা তার সম্পর্কে যতবার ভেবেছি; ততবারই মনে হয়েছে কবি ব্যতিক্রমীদের একজন। নইলে দারিদ্র্য মহৎ করেছে মানুষকে এমন তো দেখিনি। পঙ্গু করেছে, পাত্র করেছে ভিক্ষার, কিংবা তার চেয়েও যা খারাপ, ক্ষেত্র করেছে অবজ্ঞার—এই তো দেখে এলাম সারা জীবন। আবার বাপ-দাদাও তাই দেখে এসেছেন, এই গরিব দেশে।
আমাদের যত যত সমস্যা ও ব্যর্থতা তার পেছনে যে দারিদ্র্য রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে কি? যেমন, পরিবার পরিকল্পনা। ছোট পরিবার সুখী পরিবার—এটা সত্য; কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্য হচ্ছে ধনী পরিবার মানেই ছোট পরিবার। পরিবার ছোট হলেই যে সুখী হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অসুখ-বিসুখ, ঝগড়া-কলহ, মনোমালিন্য, অধিক আদরে ছেলেমেয়ে নষ্ট ইত্যাদি সমস্যা থাকতেই পারে। থাকেই। অনেকে তো বিয়েই করতে পারেনি, নিজেই নিজের পরিবার এবং পরিবার পরিকল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে আদর্শ বটে, কিন্তু তেমন পুরুষ কিংবা মহিলা, বিশেষ করে মহিলা, নিজেকে আদর্শ মানুষ কিংবা স্বর্গসুখ ভোগকারী ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেন এমনটা মনে হয় না। আলাপ করে দেখুন, বিষণ্ন হয়ে ফিরে আসবেন। এদের অনেকেই দুঃখের প্রতিমূর্তি।
ব্যতিক্রম সর্বক্ষেত্রেই সম্ভব, কিন্তু সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যাবে ধনী পরিবারেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল হয়েছে। দরিদ্রদের মধ্যে তা ব্যর্থ। যেজন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যাচ্ছে না, শতচেষ্টা করেও কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও এখন আগের তুলনায় সচেতন, তাদের ক্ষেত্রেও পরিবার এখন ছোট হয়ে আসছে। তবে মধ্যবিত্তও ধনীই বটে, বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের তুলনায় ধনী।
দরিদ্র মানুষ আগামী বছরের কথা দূরে থাক, আগামীকালের কথাই ভাবতে পারে না, তারা সকালে ভাবে দুপুরে কী খাবে, দুপুরে ভাবে রাতের কথা, এর বেশি ভাববার ক্ষমতাই রাখে না। মনে করে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। এই হতাশা সবরকমের দায়িত্বজ্ঞান অপহরণ করে নেয়। গরিব মানুষ উচ্চতর জীবনের স্বপ্ন রাতেও দেখে না, দিনে তো নয়ই। ভাবে এরকমই ছিল আমার বাবাও, বাবার বাবাও, এরকমই থাকব আমি, থাকবে আমার সন্তানসন্ততি। ভবিষ্যৎহীন, চেতনাহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন এ মানুষদের কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করা যায় না।
এখন দেশে শিক্ষার ব্যাপারে আগের আগ্রহ নেই। বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষায়। এর কারণটাও ওই দারিদ্র্যই। মানুষ দেখতে পাচ্ছে লেখাপড়া শিখে লাভ হচ্ছে না। চাকরি হচ্ছে না। উপার্জনের আশা নেই। এ পরিস্থিতিতে ছাত্রসমাজের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক হতাশা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার ব্যাপারে অনীহা এবং ঠিক বিপরীতে সন্ত্রাসের ব্যাপারে আগ্রহ ওই হতাশারই দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ বটে।
আর দারিদ্র্য তো আজকের নয়, যুগ-যুগান্তের। সেই অন্তহীন দারিদ্র্য ব্যক্তির জীবনে এমন হীনম্মন্যতা তৈরি করে রেখেছে যে, অবস্থা ভালো হলেও গরিবই থেকে যায় মনের দিক থেকে। ঈর্ষা, অবিশ্বাস, ক্ষুদ্র স্বার্থের পাহারাদারি, কলহ, কোন্দল শুধু যে কাজ হয়ে দাঁড়ায় তা নয়, প্রধান বিনোদনেও পর্যবসিত হয়। অন্য কোনো আনন্দে অভ্যাস নেই, ঝগড়া-ফ্যাসাদ ভিন্ন।
আজকাল আমরা দারিদ্র্যও বিক্রি করছি দেশ-বিদেশে। কিন্তু দরিদ্র মানসিকতা বিক্রি করতে পারব না। কেউ কিনবে না। বৈষয়িকভাবে মোটেই অভাবে নেই, কিন্তু দেখলেই মনে হবে অত্যন্ত অভাবগ্রস্ত, সাহায্য চাইছেন না, কিন্তু তবু মনে হবে চাইছেন—এরকম অবস্থাপন্ন কিন্তু তবু দুস্থ মানুষ কি আপনি দেখেননি? আমি দেখেছি। আপনিও দেখেছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দারিদ্র্য যখন কারও সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য। টাকাপয়সায় কাটে না। এক প্রজন্মেও কাটতে চায় না। আর আগের প্রজন্মে আমরা কেইই-বা কী ছিলাম, বাপ-দাদা কীই-বা রেখে গেছেন, অভাব ছাড়া? শুধু ব্যাধি কেন বলব, দারিদ্র্য অত্যন্ত কঠিন ও জটিল ব্যাধি।
তাই বলে কি আমরা ভোগ-বিলাসের পক্ষে? না, অতিরিক্ত ভোগ-বিলাস, কিংবা অপচয় কোনোটারই পক্ষে নই আমরা। আমরা চাই সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবন, তাতে আনন্দ থাকবে, অবকাশ থাকবে, থাকবে সৃষ্টিশীলতা। স্কুল ভোগ-বিলাসে সৃষ্টি নেই, দেওয়া নেই, কেবল নেওয়াই আছে। দারিদ্র্যের সংজ্ঞা যে আপেক্ষিক, তাও জানি। কিন্তু তবু দারিদ্র্য যে কী বস্তু, তা বাংলাদেশের মানুষ আমরা যদি না বুঝি তবে কে বুঝবে।
এর সঙ্গে গণতন্ত্রের শত্রুতা একেবারেই স্বভাবগত। গণতন্ত্র ও দারিদ্র্য একে অপর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বভাবের। গণতন্ত্রের একটি মূল বিষয় হচ্ছে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া; কিন্তু দরিদ্র মানুষ কী ভাগ করবে, অভাব ছাড়া। অভাব তো অবিভাজ্য, যারটা তারই থাকে, ভাগ করতে গেলে নেওয়ার লোক পাওয়া যায় না খুঁজে, নাম শুনলেই দৌড়ে পালায়। গণতন্ত্র প্রকাশ্য, অভাব গোপনীয়। গণতন্ত্র সবল, দারিদ্র্য আত্মমুখী। গণতন্ত্র মানুষকে মেলায়, দারিদ্র্য বিচ্ছিন্ন করে। গণতন্ত্র জগৎমুখী, দারিদ্র্য আত্মমুখী। গণতন্ত্র আলাপ করে, দারিদ্র্য করে কলহ। না, গণতন্ত্র ও দারিদ্র্য কিছুতেই একসঙ্গে থাকতে পারে না। তার চেয়েও বড় কথা দারিদ্র্য থাকলে গণতন্ত্র থাকে না, থাকতে পারে না। শুধু যে ভোট কেনাবেচা কিংবা ছিনতাই হয় তাই নয়, মানুষে মানুষে মিলনটাই গড়ে ওঠে না। গৃহহীনরাই সবচেয়ে বড় গৃহী, তারা শুধুই গৃহ খুঁজে বেড়ায়; উন্মুক্ত প্রান্তরে আসে না, অন্যের সঙ্গে সমঝোতা, সহযোগিতা কিছুই করে না। মন্ত্রীরা যখন বলেন দারিদ্র্যই গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু তখন খুবই যথার্থ কথা বলেন বটে।
কিন্তু দারিদ্র্যের কারণ কী তা তো বলেন না। না, সেটা বলেন না। বলেন; যখন-তখন আসল কথা না বলে আজেবাজে কথা বলেন। মুখ্যকে গৌণ করে, গৌণকেই ধরে টানাটানি করেন। বলেন, দারিদ্র্যের কারণ আমাদের আলস্য। আমরা কাজ করি না। ফাঁকি দিই। বলেন, দারিদ্র্যের কারণ আমাদের জনসংখ্যা। এত মানুষ, এদের কে খাওয়াবে, যা আছে খাওয়াতেই শেষ, উন্নতি কী করে হবে? কী করে ঘুচবে দারিদ্র্য? কেউ বলেন, অন্য কিছু নয়, দায়ী আমাদের দুর্নীতি। চোর। চোরে ছেয়ে গেছে দেশ। চাটার দল। বেত চাই। বেতাতে হবে। এসব বলেন, কিন্তু দারিদ্র্যের আসল কারণটা দেখেন না বা দেখলেও মানতে চান না।
অন্য কারণ অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে বৈষম্য। এ বৈষম্যই দারিদ্র্য সৃষ্টি করছে এবং করেছে। না, দারিদ্র্য বৈষম্য সৃষ্টি করেনি। উল্টোটাই সত্য। বলা হবে এবং হচ্ছে যে, প্রতিযোগিতা থাকা ভালো। হ্যাঁ, তা ভালো বৈকি। প্রতিযোগিতা ছাড়া উন্নতি নেই। কিন্তু কার সঙ্গে কার প্রতিযোগিতা, সেটা তো দেখতে হবে। হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিয়ে যদি বলি তুমি আমার সঙ্গে সাঁতরাও দেখি, পাল্লা দাও, তাহলে লোকটি তো পারবে না, ডুবেই মরবে। সাঁতরাতে বলার আগে তার হাত-পায়ের বন্ধনগুলো কাটাতে হবে, তাকে মুক্ত করতে হবে, তবেই সাঁতারের প্রশ্নটা উঠবে, নইলে তা নিষ্ঠুর বিদ্রুপ ছাড়া আর কী। দেশের অধিকাংশ মানুষই এই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রয়েছে, তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে দারিদ্র্যের জলাশয়ে। তাদের অবস্থা সাঁতরে তীরে ওঠার নয়, অবস্থা ডুবে মরবার।
দেশের যে বৈষম্য রয়েছে তার দরুন অধিকাংশ মানুষই নিজেকে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জনসংখ্যা বোঝা হয়ে উঠছে, তাকে সম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না। শিক্ষা কর্মসূচি ভেঙে পড়ছে। কাজ নেই। অদক্ষ লোকে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে।
পুঁজি যা রয়েছে তা অল্প কিছু লোকের হাতে। এই লোকেরা দেখছে দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই পুঁজি বিনিয়োগ না করে তা তারা বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওদিকে এ ধনীরাই আবার আমদানি করছে বিদেশি জিনিসপত্র। ব্যবস্থা করছে চোরাচালানের। ফলে দেশীয় পণ্যের বাজার গড়ে উঠছে না। ধনীদের মধ্যে দেশপ্রেম ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। তারা আবার দ্রুতগতিতে ভোগবাদিতার পথে এগোচ্ছে। প্রতিযোগিতা উৎপাদনের নয়, প্রতিযোগিতা ভোগের। পুঁজির সঞ্চয় বিঘ্নিত হচ্ছে এভাবে—পদে পদে।
বাংলাদেশের মূল সমস্যাটা হলো বৈষম্য। দারিদ্র্য এ বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি। ধনী গরিবকে শোষণ করে, গরিবকে কর্মক্ষম হতে দেয় না এবং ধনী শোষণ করে যা পায় তা ভোগ করে এবং যা বাঁচে তা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। গরিব মানুষ অন্য কিছু উৎপাদন করতে পারে না, হতাশা ও সন্তান ভিন্ন। ফলে সে আরও গরিব হয়। অপরাধ বাড়ে, বাড়ছে, আরও বাড়বে। বিদেশনির্ভরতা বাড়ে, বাড়ছে, আরও বাড়বে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের ছবি। অন্য সমস্যা রয়েছে হাজারে হাজারে, কিন্তু সবই বৈষম্যের সঙ্গে বাঁধা। আসল গ্রন্থিটা ওখানেই।
আর গণতন্ত্রের কথা যে বলি তার মূল কথাটাই হলো অধিকার ও সুযোগের সাম্য। এ না থাকলে গণতন্ত্র থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওই অধিকার ও সুযোগের সাম্য বাংলাদেশে কী পরিমাণে রয়েছে, তার যদি হিসাব করি তাহলেই জানতে ও বুঝতে পারব বাংলাদেশে গণতন্ত্র কতটা আছে বা তার ভবিষ্যৎ কী?
বৈষম্য ইংরেজ আমলে ছিল। ইংরেজ ও বাঙালি এক ছিল না। বৈষম্য পাকিস্তান আমলে ছিল। পাঞ্জাবি ও বাঙালি এক ছিল না। বৈষম্য বাংলাদেশ আমলেও রয়েছে। বাঙালি ও বাঙালি এক নয়। মূল তফাত অর্থনৈতিক। আমরা ইংরেজ হটিয়েছি, পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছি, কিন্তু তবু বৈষম্য দূর করতে পারিনি। আর সেজন্যই দুর্দশা ঘুচছে না। স্বস্তি নেই, অগ্রগতিও নেই। এগোতে হলে দুপায়ে হাঁটতে হয়, একটি পা যদি খোঁড়া থাকে, তাহলে যা করা যায় তাকে হাঁটা বলা চলে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক
মন্তব্য করুন