যে চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকেই আমরা সাধারণত মূল্যবোধ বলে থাকি। এটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও রুচির ওপর প্রভাব ফেলে, যা তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হয়। একে সাধারণত সমাজের ঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।
সামাজিক মূল্যবোধ: সামাজিক মূল্যবোধ সমাজে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির মনোভাব তৈরি করে। এটি সমাজের একটি ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কারণে সামাজিক মূল্যবোধের ক্রমাগত অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। পরিবার, শিক্ষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতির ভূমিকা কমে যাওয়ার ফলে সমাজে নৈতিকতা, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির অভাব বেড়ে গেছে। ভোগবাদিতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, যা সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। পারিবারিক মূল্যবোধ সামাজিক মূল্যবোধেরই অংশ যেহেতু পরিবার সমাজের ক্ষুদ্র অংশ। এই পারিবারিক মূল্যবোধের মধ্যেও এখন ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ: প্রতিটি সংস্কৃতি তার নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মানুষের সামাজিক রীতিনীতির অংশ হিসেবে কাজ করে এবং সমাজের ঐতিহ্যকে সম্মান দেয়। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় একটি উদ্বেগজনক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে আমাদের সমাজে পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনকে সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখত। আজকাল, নানা ধরনের গণমাধ্যম—বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া—সমাজে অশ্লীলতা, সহিংসতা এবং অস্বাস্থ্যকর মনোভাব ছড়াচ্ছে, যা তরুণদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ফলে প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা কমছে। এ ছাড়া ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুচ্ছ করে অনেকেই আধুনিকতার নামে পুরোনো মূল্যবোধগুলো উপেক্ষা করছে। ফলে, সমাজের ঐক্য ভেঙে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
নৈতিক মূল্যবোধ: নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের আচরণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলে, যা সঠিক এবং ভুলের পার্থক্য স্পষ্ট করে। এটি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে নৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নৈতিক মূল্যবোধের নেতিবাচক দিকগুলো প্রকট হয়েছে। আমরা এখন আর দেশ, জাতি ও সমাজের চিন্তা করি না। সবাই এখন নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। সবাই খুঁজি কোথায় নিজের লাভ। এমনকি এতে যদি দেশের, জাতির, সমাজের ক্ষতিও হয় তাতেও কিছু যায় আসে না। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের আরও একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে দেশে চলমান বর্তমান খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অরাজক কার্যকলাপ।
ধর্মীয় মূল্যবোধ: ধর্মীয় মূল্যবোধ হলো মানুষের আচার-আচরণ, জীবনধারা এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে একটি নৈতিক দিক, যা ধর্মীয় শিক্ষা এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এটি মূলত মানুষের আচরণকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ, সহানুভূতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সামাজিক অবস্থা ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কারণে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি মানুষের মনোযোগ কমেছে।
মূল্যবোধ সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মানুষের জীবনযাত্রার নৈতিক দিকটি গড়ে তোলে, যা সমাজে শান্তি, সহানুভূতি এবং সম্মান প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। সমাজে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সৎ আচরণ এবং নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে ইতিবাচক মূল্যবোধের প্রচলন আমাদের মানবিক গুণাবলি এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার ভিত্তি গড়ে তোলে। একইভাবে, নেতিবাচক মূল্যবোধ সমাজে অশান্তি এবং দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। ফলে প্রতিটি সমাজে মূল্যবোধের সম্যক ধারণা এবং তার বাস্তব প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।
শহিদুজ্জামান শাকিল, শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা কলেজ
মন্তব্য করুন