দর্শন সম্বন্ধে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত এবং সবার মতো আমিও জানি যে, প্রায় সব তৃষ্ণারই তৃপ্তি আছে, তবে বিশেষভাবে নেই দুটির, জ্ঞানের এবং ভক্তির। এই দুটি আবার পরস্পরবিরোধী। জ্ঞান ভক্তিকে দুর্বল করে, ভক্তি জ্ঞানকে প্রতিহত করতে চায়। আমরা যখন দর্শনের চর্চার প্রসঙ্গে আসি তখন জ্ঞানের ওপরই জোরটা পড়ে, ভক্তির ওপরে নয়।
দর্শনের উৎসে থাকে কৌতূহল, যাকে বলা চলে জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসা থেকেই জ্ঞানান্বেষণের সূত্রপাত। জ্ঞান আবার ব্যাখ্যাও করে। পুরোনো ব্যাখ্যা নতুন ব্যাখ্যার জন্য পথ ছেড়ে দেয় এবং ওই পথে জ্ঞান ও ব্যাখ্যা উভয়ই এগিয়ে যায়। বোঝা যায় এই যাত্রার শেষ নেই। দর্শন বিভিন্ন ধরনের। আমরা বলি এবং মানি যে, সব উল্লেখযোগ্য বিষয়েরই একটি দর্শন থাকে। তবে এটিও জানি আমরা যে, দর্শনের সংখ্যা অসংখ্য হলেও দর্শনচর্চার ধারা দুটি—একটি ভাববাদী, অন্যটি বস্তুবাদী। বস্তুবাদী ধারাটি বস্তুকেন্দ্রিক নয়, বস্তুর দ্বারা সেটি আকীর্ণ নয়; তবে বস্তুজগতের ওপর নির্ভরশীল বটে। এই ধারাকে ইহজাগতিক বললেও হয়তো আপত্তি থাকবে না।
জ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুর সঙ্গে মনের সম্পর্ক একটি অত্যন্ত পুরোনো এবং প্রায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসা। বস্তু বড় না মন বড়, এ প্রশ্নটি উঠেছে। প্রশ্নটির তাৎপর্য হলো এই বিবেচনা যে, বস্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করে, নাকি মনই তার নিজস্ব উপায়ে বস্তুর ধারণা, ব্যাখ্যা, তাৎপর্য সবকিছু তৈরি করে নেয়। আর এই জিজ্ঞাসার মীমাংসা করতে গিয়েই দর্শন পরস্পরবিরোধী দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে, যাদের একটি ভাববাদী, অন্যটা বস্তুবাদী। তবে ভাববাদী হোক কি বস্তুবাদীই হোক, দার্শনিক জ্ঞানের আহরণভূমি হচ্ছে অভিজ্ঞতা ও চিন্তা। অভিজ্ঞতা ও চিন্তা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি সামাজিক; একাধারে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক, অতীতের হয়েও বর্তমানের।
দর্শনের ভাববাদী ধারার সঙ্গে ধর্মের বিলক্ষণ নৈকট্য আছে। ধর্ম একসময়ে দর্শনের জায়গাটা দখল করে রেখেছিল। দর্শনের মতোই ধর্ম, জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছে এবং যেমনটি দর্শন করে থাকে, তেমনি তত্ত্ব নির্মাণ করেছে। ধর্ম অবশ্য একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব নেয়, সেটি হলো ব্যক্তির জন্য নৈতিকতা ও আচরণের নিয়মবিধি তৈরি করে দেওয়া। তবে দর্শন যে নৈতিকতা-নিরপেক্ষ, তা নয় এবং ধর্মের মতো দর্শনও ক্ষমতা রাখে মানুষকে বদলে দেওয়ার। কিন্তু ধর্ম যেভাবে মানুষকে শাসন করে, দর্শনের জন্য সেটা স্বভাবসিদ্ধ নয়। ধর্মের সঙ্গে দর্শনের প্রধান দূরত্বটা এখানে যে, ধর্ম জোর দেয় বিশ্বাসের ওপর, সেইসঙ্গে সে দাবি করে ভক্তির। তাছাড়া এটাও তো দেখা গেছে, ধর্মবিশ্বাসীরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর চড়াও হয়, কারণ তারা নিজেদের বিশ্বাসের জগৎটাকেই জগৎশ্রেষ্ঠ বলে ধরে নেয়। অন্যদিকে দর্শনে থাকে সংশয়, তার নির্ভরশীলতা যুক্তি, প্রমাণ, বিবেচনা, বিতর্ক ইত্যাদির ওপর।
দর্শন এখানে বিজ্ঞানের বন্ধু ও সহযাত্রী। তবে পার্থক্য এ দুয়ের ভেতরও রয়ে যায়। সেটি ঘটে এই জন্য যে, দর্শনের তুলনায় বিজ্ঞান অধিকতর প্রায়োগিক। বিজ্ঞানেও তত্ত্ব থাকে; কিন্তু বিজ্ঞান তার তত্ত্বকে কখনোই প্ৰয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে না, প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে পরীক্ষা করে নিতে চায় এবং এভাবেই গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সে জন্য দেখা যায়, দর্শনের চেয়ে বিজ্ঞানের চলিষ্ণুতা অধিক। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনার কোনো শেষ নেই। তৃপ্তি কাকে বলে বিজ্ঞান তা জানে না। যত তার জ্ঞান বাড়ে তত বৃদ্ধি পায় কৌতূহল। বিজ্ঞান ধরে নেয় যে, শুধু আহরণে নয়, বিতরণেও জ্ঞান বিকশিত হয়। দর্শনের বস্তুবাদী ধারার সঙ্গে ধর্মের নৈকট্য যতটা কম, বিজ্ঞানের নৈকট্য ততটাই বেশি। বিজ্ঞানের মতোই বস্তুবাদী দর্শনও অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে তত্ত্বে পৌঁছায় এবং তত্ত্বকে পরীক্ষা করে। এভাবেই পথ কেটে বস্তুবাদী দর্শনের অগ্রগমন। নিজে সে বদলায়, বিশ্বাসীদেরও বদলে দেয়। এই দর্শন বস্তুগতকে গুরুত্ব দেয় ঠিকই; কিন্তু তাই বলে মনোজগৎকে মোটেই অস্বীকার করে না। তার বক্তব্যটি মোটামুটি এই রকমের যে, মানুষের মনই ধ্যান-ধারণা ও বস্তুজগতের ব্যাখ্যা তৈরি করে, মনেই থাকে জ্ঞানের সঞ্চয় এবং ঘটে ভাবনার উদয়, সেখানেই চিন্তার ধারা-উপধারায় মিলন বিরোধ। মনের আপেক্ষিক স্বাধীনতাও রয়েছে, মনই কল্পনা করে এবং কল্পনা ছাড়া সৃষ্টি সম্ভব নয়। কিন্তু বস্তুবাদী দর্শন কখনোই এটি মানবে না যে, মন সার্বভৌম। বলবে মানুষের মন তার জাগতিক অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলোর ভেতর রয়েছে অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস, ভূগোল—এককথায় বস্তুজগতের সবকিছুই। বস্তুগুলো ইহজাগতিক এবং এরা মনের গতিপথ ও গতিধারার ওপর কর্তৃত্ব করে। এ জন্য দেখা যায়, একই পরিবারের দুজন সদস্য যদি একই ছাদের নিচেও থাকে, তবু তাদের অর্থনৈতিক জীবন যদি দুই রকমের হয়, একটি ধনী, অন্যটি গরিব—তাহলে তাদের চিন্তাধারা দুই রকমের হতে বাধ্য। শীতের দেশের স্বর্গকল্পনা আর গরম দেশের স্বর্গকল্পনা যে অভিন্ন নয়, সেও তো আমরা জানি।
বস্তুবাদী দর্শন ও বিজ্ঞানের এই নিকটবর্তিতা তাদের উভয়কেই চিনতে সাহায্য করে। উভয়ের ক্ষেত্রেই দুটি চালিকাশক্তি কার্যকর থাকে, যাদের স্থায়ী সত্যও বলা চলে। একটি হচ্ছে কার্যকারণ, অন্যটি দ্বন্দ্ব। কারণ ছাড়া যে কার্য নেই, এটি সকলেরই জানা, কিন্তু সাধারণ আলোচনায় দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। দ্বন্দ্ব আসলে কার্যকারণের চেয়েও অধিক সত্য। সবকিছুর ভেতরই দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্বই মূল চালিকাশক্তি। ঐক্যের ভেতর দ্বন্দ্ব থাকে; দ্বন্দ্ব পুরোনো ঐক্যকে ভেঙে দিয়ে নতুন ঐক্য তৈরি করে। ঐক্য, বিরোধিতা, ঐক্য—এভাবেই অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকে । এমনকি মালিক ও শ্রমিকের ভেতরও একটি ঐক্য দেখা দেয়, কারণ উভয়পক্ষই উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত; কিন্তু তাদের ভেতর দ্বন্দ্ব অপরিহার্য। কেননা শ্রমিকরা উৎপাদন করে সামাজিকভাবে; কিন্তু উৎপাদিত বস্তু চলে যায় ব্যক্তিগতভাবে মালিকের দখলে। মালিক-শ্রমিকের এই দ্বন্দ্বের মীমাংসাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। মালিকপক্ষ ছাড় দিতে বাধ্য হয়; কিন্তু তাতে দ্বন্দ্বের নিরসন হয় না। নিরসনের জন্য আবশ্যক হয় এমন ব্যবস্থার, সেখানে মালিকানাটি সামাজিক হবে, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে পার্থক্য থাকবে না।
ওদিকে দ্বন্দ্ব আছে বলেই মানুষের সভ্যতা এগোয়। এমনকি পাখি যখন আকাশে ওড়ে তখন তার পক্ষেও অপরিহার্য হয় পাখা দিয়ে বায়ুমণ্ডলে আঘাত করার। সমাজে, রাজনীতিতে, মানুষের মনে সর্বত্র দ্বন্দ্ব আছে, ছিল এবং থাকবে। প্রেমের সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে গ্রিক দার্শনিকদের এ রকম উক্তি পাওয়া যায় যে, একসময়ে পুরুষ ও নারী একই দেহে ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় ছিল; দেবতারা দেখল এই অখণ্ডতা দেবতাদের স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক। কেননা অখণ্ড মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চায় দেবতাদের। অতএব তারা ঠিক করল, মানুষের বিভক্ত করা চাই। সেটিই তারা করেছে, আলাদা করে দিয়েছে পুরুষ ও নারীকে। সেই থেকে মানুষের ওই দুই সত্তা এক হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। এই গল্পের সঙ্গে যোগ করা যায় এই কথাটিও, এ ক্ষেত্রে ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা দ্বন্দ্বের সম্ভাবনাকে যে নির্মূল করে দেয়, তা নয়। দ্বন্দ্ব না থাকলে সাহিত্যসহ সব শিল্পকলার উৎকর্ষ যে ব্যাহত হতো, তাতে সন্দেহ কি!
আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা বলি, তাই বলে দ্বন্দ্বের ভেতর যে দ্বিধা আছে, তা নয়; দ্বিধা যা তা মানুষের, দ্বন্দ্বের নয়। মানুষ সাধারণত চায় দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে। কিন্তু পারে না। যে জন্য নানা রকমের সংঘর্ষ বাধে; কিন্তু তার ভেতর দিয়েই মানুষের পক্ষে সামনে এগোনো সম্ভবপর হয়। দার্শনিক চিন্তাও দ্বন্দ্বের কারণেই এগোয়। ভাববাদী দর্শন দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ, বস্তুবাদী দর্শন যতটা দেয়। অভিজ্ঞতা বলে পরস্পরবিরোধী উপাদানের উপস্থিতি বস্তুর অস্তিত্বের শর্ত বৈকি। যে জন্য নিচু না থাকলে উঁচু থাকে না। ভালো-মন্দের ব্যাপারেও দেখি মন্দ আছে বলেই আমরা ভালোকে চাই এবং ভালোর আলোকেই মন্দকে চিনি, মন্দের অন্ধকারের দরুন ভালোর উজ্জ্বলতা চোখে পড়ে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন