আইনজীবীরাও শপথবদ্ধ দলান্ধ। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব যে কারণে তাদের খুব না-পছন্দ। গণমাধ্যমের এ নিয়ে সংবাদচর্চাও তাদের কাছে বিরক্তিকর। তারা দলের মাই ম্যান হতে চান। আবার সময়ে সময়ে দলের ডিসায়ারের বাইরে মামলা লড়ে আইনের লোকও হতে চান। পরিণামে দলীয় পদ-পদায়নে ধন্য হন। হিসাবের গরমিলে পদচ্যুতও হন
এক কলমের খোঁচায় কয়েক বাক্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদ তালুকদারের দলীয় প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মাসুদ আহমেদ তালুকদারের দলীয় প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে। সাংগঠনিক কী বা কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার, তা উল্লেখ নেই। দল থেকে কেউ কিছু বলছেন না। আবার এমন কঠিন শাস্তির শিকার মাসুদ আহমেদ তালুকদারও টুঁ-শব্দ করছেন না। ঘটনা বেশ ইন্টারেস্টিং।
কয়েকটি গণমাধ্যমে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে একটি কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দু-তিন দিন আগে বহুল আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর চেয়ারম্যান ইমরান হোসেনের জামিন শুনানিতে অংশ নেন মাসুদ আহমেদ তালুকদার। বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর জি কে শামীমসহ দলটির বিভিন্ন নেতাকর্মীর পক্ষেও শুনানিতে অংশ নেন। বাস্তবতাটাই এমন। আইনজীবীরা শুধুই আইনজীবী নন। তারা পার্টিজান। কেউ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী। কেউ আওয়ামী, জামায়াতি, বামাতি ইত্যাদি। টাকাওয়ালা মক্কেল পেলে তারা তখন আর দল-বেদল থাকেন না। রাজনীতির চেয়ে তখন মূল পেশা তথা টাকাই হয়ে যায় মুখ্য। হয়ে আসছে এভাবেই। নিদারুণভাবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ বিশেষ কয়েক ব্যবসায়ীকে রক্ষায় কিছু আইনজীবীর পরিশ্রম বেশ আলোচিত। এমন একটা সময়েই দলীয় আঘাত পড়ল অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদারের ওপর। পূর্বাপর জেনেবুঝে তিনিও তাই নিশ্চুপ।
বাংলাদেশের আইনাঙ্গন ষোলো আনা রাজনৈতিক। আবার অর্থের বিষয়আসয়ও সম্পৃক্ত। নব্বইতে এরশাদ পতনের পর তিনদলীয় জোটের রূপরেখায় স্বৈরাচার যেন রাজনীতিতে পুনর্বাসন না পায়, সেই অঙ্গীকার ছিল বহুল আলোচিত। আইনজীবীদের মধ্যে বোঝাপড়া হয় এরশাদের পক্ষে না দাঁড়ানোর। কিন্তু তা দিন কয়েকের বেশি খাটেনি। রাজনৈতিক দলগুলো ওয়াদা খেলাপের আগে কথা খেলাপির তালিকায় চলে আসেন আইনজীবীরা। আওয়ামী লীগের ওই সময়ের প্রবীণ প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক (হালে কারাবন্দি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা) ঘোষণা দেন এরশাদের আইনজীবী হওয়ার। এ নিয়ে চলে তুমুল তোলপাড়। ওই তোলপাড়ের মাঝে সিরাজুল হক আওয়ামী লীগই ত্যাগ করেন। তার তখনকার যুক্তি ছিল তিনি প্রথমত আইনজীবী। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার। বিপদগ্রস্তকে আইনি সেবা দেওয়া তার প্রধান দায়িত্ব। কোনো রাখঢাক না রেখে তিনি তার প্রধান দায়িত্বই বরণ করেন। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এরশাদের আইনজীবী হিসেবে। পরবর্তীকালে বিএনপির অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেন এবং আওয়ামী লীগের ইউসুফ হোসেন হুমায়নরাও ছিলেন এরশাদের অন্যতম কৌঁসুলি হয়ে। গত বছর কয়েক নিজস্ব আঙিনায় এ টাইপের আলোচনায় এক সময়ের শিবির নেতা জামায়াতপন্থি তুখোড় আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনিরও।
বুয়েটে শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামি ছাত্রলীগের ক্যাডারদের আইনজীবী হয়েছিলেন তিনি। রানা প্লাজা মামলার আসামি সোহেল রানার আইনজীবীও। এ নিয়ে মন্দকথা এখনো বাসি হয়নি। শিশির মনির এতে মুখ খোলেননি। তার হয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও সাবেক শিবির নেতা ড. মির্জা গালিব। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে দেওয়া ওই পোস্টে গালিব বলেন, ‘আবরার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জন আসামি শিশির মনিরের চেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট আর পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখে তার চেম্বার ১২ জনের মধ্যে ৫ জনের মামলা গ্রহণ করেনি। কারণ এ পাঁচজনকে নিরপরাধ বলে মনে হয়নি। বাকি সাতজনের মধ্যে দুজনের ক্ষেত্রে আইনজীবী হিসেবে শিশির মনিরের সাবমিশন ছিল মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আদালত যেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। অর্থাৎ এ দুজনকে তিনি নির্দোষ বলে মনেও করেননি। তিনি শুধু মনে করেছেন, অপরাধের সঙ্গে এ দুজনের সংশ্লিষ্টতা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার লেভেলের নয়। আরেকটু ছোট শাস্তি হওয়া উচিত। বাকি পাঁচজনের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তার মনে হয়েছে, তারা ফৌজদারি অপরাধ করেননি।
যুগে যুগে এভাবেই হয়ে আসছে। আইনজীবীরাও পুরোদস্তুর রাজনীতিক। আবার আপিল বিভাগের বিচারকই যখন নিজেকে শপথবদ্ধ রাজনীতিক দাবি করে বসেন, তখন আইনজীবীদের এমন দলীয়পনা আর কোনো বিষয়ের মধ্যেই পড়ে না। তারা ছাত্র, যুব, শ্রমিক লীগ বা দলের লোকেরা যা করেন এর চেয়ে কম করেন না। পুলিশ বা প্রশাসনও তাদের সঙ্গে তাই করে। আইনজীবী বলে আলাদা সমীহ করে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাস কয়েক আগে, একই মামলায় যুবলীগের সভাপতির স্ত্রী যূথী এক নাম্বার আসামি, বিএনপির আইনজীবী নেতা কায়সার কামাল দুই নম্বর আসামি হলেও কায়সার কামাল গ্রেপ্তার, রিমান্ড ও জেল সবগুলোর মুখোমুখি হন। আইনের শাসন আর শাসনের আইনের ফেরের মাঝে আইনজীবীরাও। ৫ আগস্টের পর মামলা দেওয়া নিয়ে যে আজগুবি ঘটনাগুলো ঘটছে, তাতে বিচারব্যবস্থা আবার আস্থার সংকটে পড়ে গেছে। এ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত আছে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন। বিচারিক প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও গতিশীল রাখতে আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সুপারিশ রয়েছে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে। আইনজীবী সমিতিগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর দুটি বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকারের তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে—বিশেষ করে, দলগুলো আইনজীবী সমিতি নির্বাচন ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখবে না এবং নির্বাচনগুলোতে অন্য কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার বা হস্তক্ষেপ করবে না। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে আইনজীবীদের কোনো সংগঠনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের ২০০৫ সালের রায় অনুযায়ী আদালতের প্রবেশদ্বার বা চত্বরের মধ্যে যে কোনো জমায়েত, মিছিল, বিক্ষোভ, বয়কট বা ঘেরাও কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট নির্দেশ জারি করবে এবং তার পরিপালন তদারকি করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব করতে গত ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। এর পর থেকেই কমিশন সরেজমিন বিভিন্ন আদালত পরিদর্শন, মতবিনিময়সহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর কমিশন তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে।
প্রতিবেদনটিতে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা কার্যকর করা, প্রচলিত আইনের, আইন পেশার ও আইন শিক্ষার সংস্কারের কথাও আছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানের বিদ্যমান কাঠামোতে বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য যথাযথ বিধান নেই। আইনজীবীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে মামলা পরিচালনায় তাদের সুবিধা প্রদানের প্রবণতা এবং মামলার ফলে তার প্রতিফলন ঘটছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সংস্কার কমিশনের দেওয়া এসব সুপারিশের মধ্যে আইন শিক্ষা বোর্ড, আইন শিক্ষা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করাসহ কিছু সুপারিশে সায় রয়েছে আইনজীবীদের। কিন্তু আদালতে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধে ঘোরতর আপত্তি তাদের। রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকবে না, সংগঠন করার অধিকার থাকবে না, তা তারা মানতে নারাজ। এটাকে তারা একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি মনে করেন তারা। তবে বিচারকরা যেন রাজনীতি না করেন সেটা চান। সেটাতে মৌলিক অধিকার খর্ব হয় না! সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বিচারকদের রাজনীতির ব্যাপারে কিছু স্পষ্ট কথা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিচারকদের অবশ্যই সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও সম্পৃক্ততা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট আচরণবিধি অনুসারে কঠোরভাবে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর দুটি বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রয়োজন বলেও মনে করে কমিশন। বিশেষ করে, দলগুলো আইনজীবী সমিতি নির্বাচন ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখবে না এবং নির্বাচনগুলোতে অন্য কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার বা হস্তক্ষেপ করবে না। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে আইনজীবীদের কোনো সংগঠনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। আইনজীবীরা তা চান না। রাজনৈতিক দলগুলোরও এতে তীব্র আপত্তি। তারা মনমতো আইনজীবী চান। পছন্দের বিচারকও চান। এর মধ্য দিয়ে বিচারকরা মনোজগতে ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’। আইনজীবীরাও শপথবদ্ধ দলান্ধ। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব যে কারণে তাদের খুব না-পছন্দ। গণমাধ্যমের এ নিয়ে সংবাদচর্চাও তাদের কাছে বিরক্তিকর। তারা দলের মাই ম্যান হতে চান। আবার সময়ে সময়ে দলের ডিসায়ারের বাইরে মামলা লড়ে আইনের লোকও হতে চান। পরিণামে দলীয় পদ-পদায়নে ধন্য হন। হিসাবের গরমিলে পদচ্যুতও হন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন