বিশ্ব রাজনীতিতে ভিলেন ও কমেডিয়ান চরিত্রের নেতাদের রমরমা রাজনীতি বাণিজ্য চলছে। তবে তারা নিজ নিজ দেশ ও জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাদের পূর্বসূরি মহান রাষ্ট্রনায়করা নাগরিক সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে গেছেন। সেসব উন্নত ও সভ্য দেশগুলো যুগ যুগ ধরে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে চলছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষায় তাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। সরকারি অমানবিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে সোচ্চার হয়। যে কারণে রাজনীতির চেয়ে নিজের কাজকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। নির্বাচন বা সরকার পরিবর্তন নিয়ে সেসব দেশের জনগণের তেমন মাথাব্যথা নেই। লোক ঠকানোকে নিজের ক্ষতি মনে করেন তারা। ধর্মীয় ভয়ভীতির চেয়ে রাষ্ট্রীয় আইন ও মানবতাকে শ্রদ্ধা করেন বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাই। মিথ্যা, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, কর ফাঁকি, অর্থ পাচারকে পাপের চেয়েও জঘন্য অপরাধ মনে করেন তারা। এর ওপর নির্ভর করে সামাজিক মর্যাদা। ফলে উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছেন তারা। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এসব কথা বাংলাদেশের প্রায় সবাই জানে। বিশেষ করে সরকার ও রাজনীতির লোকেরা তাদের বক্তৃতায় হরহামেশাই এসব উদাহরণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব ভুলে যান। সবার জন্য আইন এক ও অভিন্ন হলেও সুবিধা নেন ভিন্ন ভিন্ন পথে। দেশের সেনানিবাস এলাকায় গাড়ির গতি ও পার্কিং ঠিকঠাক থাকে। কিন্তু সেখান থেকে বের হলেই বেপরোয়া। এটি একটি ছোট উদাহরণ। বড় ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি বাংলাদেশে। ক্ষমতা বদলের নির্বাচন পদ্ধতিটাও দাঁড়ায়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বারবার ভুগিয়ে যাচ্ছে সাধারণ জনগণকে।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিন মাসের মধ্যে তারা একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয় জাতিকে। তিন দফা নির্বাচনের পর নিরপেক্ষ ওই পদ্ধতিটার রফাদফা করে দেন রাজনীতিবিদরা। মিলেমিশে বিভেদের রাজনীতি শুরু করেন তারা। ২০০৭ সালে দেশের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়। আলুপোড়া খাওয়ার লোভে ভিড় করে সামরিক-বেসামরিক আমলা থেকে আন্তর্জাতিক শক্তি নামের কতশত চেনা মুখ। এক-এগারোর অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভবে তৈরি হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক নামে উদ্ভট সরকার। তবু হাড়হাভাতে জাতি টানেলের ওপাশে আলো দেখতে পায়। কিন্তু তিন মাসের মাথায়ই মোহভঙ্গ হয় দেশবাসীর। শুরুতে সন্ত্রাস দমন ও সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করার নামে ব্যাপক অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। পরে দেখা যায়, বিভিন্ন বাহিনীর নানা পদবির কর্মকর্তাদের জমির সাইনবোর্ড। গাজীপুর, সাভার এলাকায় এসব সাইনবোর্ডের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আসতে থাকে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির খবর। সংস্কারের নামে জোর করে সময় সংহার করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলে তাদের উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে শঙ্কা জাগে জনমনে। ব্যাপক আলোচিত হয়—দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস ফর্মুলা। যদিও ওই সরকারকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করেছিলেন শেখ হাসিনা। সরকারের প্রতি জনঅসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে দুই নেত্রী রাজনীতিতে টিকে যান মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়ে। নির্বাচনের চাপ বাড়তে থাকে। তিন মাসের জায়গায় দুই বছর স্থায়ী হয় উদ্দীনস সরকার। অদৃশ্য সমঝোতার নির্বাচন দিয়ে নির্বাসন নেয় পরাক্রমশীল ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দীন সরকার। রোপণ করে যায় কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিষবৃক্ষ। দিনে দিনে তা রূপ নেয় ফ্যাসিস্ট সরকারে।
গত দেড় দশক হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে টানা আন্দোলন করেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। আন্দোলনের অংশ হিসেবে কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ, কখনোবা বর্জন করেছে তারা। ড. ফখরুদ্দীন সরকারের দেওয়া মিথ্যা মামলায় আওয়ামী শাসনামলে কারাগারে যেতে হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। নির্বাসনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গুম-খুন-হামলা-মামলায় জেরবার হয়েছে লাখ লাখ নেতাকর্মী। শেষদিকে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সম্মিলিত সংগ্রামে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। বিক্ষুব্ধ জাতিকে আশার বাণী শোনান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। পলাতক আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর ছাড়া সবাই সমর্থন করে ইউনূস সরকারকে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করে, এ সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। সে অনুযায়ী, শুরু থেকেই তারা অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সরকারের মেয়াদ নিয়ে আলোচনা না হলেও সবাই আশা করে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন বিষয় সংস্কারে হাত দিয়েছে সরকার। তাতে দুই বছর লাগতে পারে। ভবিষ্যৎ ফ্যাসিস্ট সরকার ঠেকাতে এ উদ্যোগ বলে প্রচার করা হচ্ছে। এতে সময় যাচ্ছে বেড়ে। সন্দেহ বাড়ছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মনে। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তরে কী আছে— তা নিয়ে প্রকাশ্যে সংশয় প্রকাশ করছেন তারা। বড় ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের এখতিয়ার নির্বাচিত সরকারের। তাই দ্রুত নির্বাচনের দাবি করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এ দাবিতে রাজপথে নামার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে তারা। সাধারণ মানুষও দ্বিধান্বিত। তারা মনে হয় অনির্বাচিত সরকারকে তিন মাসের বেশি দেখতে চায় না। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা থেকে এমনটা হতে পারে। এবার অবশ্য শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের সমালোচনায় সরব রয়েছে নেটিজেনরা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আহত ও পলাতক অনুসারীরা পরিকল্পিত অপপ্রচারে বিনিয়োগ করছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বেশি। সাত মাস বয়সী এ সরকারের সাতসতেরো নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন জনগণ।
নবীন-প্রবীণ, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, নারী নেত্রী-সংস্কৃতি কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ সরকারের উপদেষ্টা। তাদের বেশিরভাগই সাধারণ আটপৌরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পোশাকআশাকেও অতি সাধারণ, ক্যাজুয়াল। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসও আনুষ্ঠানিক স্যুটেট-ব্যুটেট না হয়ে তার চিরায়ত গ্রামীণ চেকেই আস্থা রাখেন। সভা-সেমিনারে দামি পানির বোতলের বদলে জগ গ্লাস চালু করেন। তোয়ালে ছাড়া চেয়ার ব্যবহার করেন উপদেষ্টারা। এসব কারণে প্রথম দিকে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি হয় তাদের ঘিরে। কিন্তু খাল খননে লাল গালিচা বিছানোর মতো অহেতুক উদ্যোগে তাদের খেলো করে তুলেছে অনেক সময়। সহজ সরল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নিষ্ফল আস্ফালন, যথাসময়ে খুদে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষা উপদেষ্টার বই তুলে দিতে না পারার অক্ষমতা, সংস্কৃতি উপদেষ্টার অসংস্কৃত চাহিদার অভিযোগ দিনকে দিন সরকারকে নাজুক করে তুলছে। এমনকি, গরমে বিদ্যুৎ উপদেষ্টার এসি পঁচিশে রাখার নির্দেশনার সঙ্গে চব্বিশের চেতনার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। এ ছাড়া সরকারপ্রধানের নিয়োগকর্তা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের দ্রুত রূপান্তরের গল্পও সরকারকে বিতর্কিত করছে। ছাত্রদের নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে বাস এসেছে। শুধু পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের চিঠি ফাঁস হয়েছে। সব কথার তথ্য-প্রমাণ লাগে না। মানুষ ধারণা করে নেয়। একজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করে নবগঠিত দলের প্রধান হয়েছেন। তাদের শুভাশীষ জানিয়েছেন অন্য সহযোদ্ধা উপদেষ্টারা। আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ নিষ্পাপ ঘটনা। কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচে অভিযোগ উঠেছে সরকারি সহযোগিতায় কিংস পার্টি গঠনের। নির্বাচন দেরির কারণ হিসেবে এরই মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বেড়ে ওঠার জন্য সময় দেওয়াকে বাড়াবাড়ি মনে করছে রাজনীতির অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা। রাজনীতি তো সরকারের মতো ক্যাজুয়াল নয়। এসব করতে গিয়ে সরকার ক্যাজুয়ালটির শিকার হলে তা হবে খুবই কষ্টের। অতি আত্মবিশ্বাস, বাজিকরদের গোপন পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্রনেতাদের ভবিষ্যৎ কণ্টকময় করে তুলতে পারে। প্রায় দেড় হাজার মানুষের রক্তস্নাত প্রিয় মাতৃভূমি আবারও হোঁচট খেলে তা হবে মর্মান্তিক।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বলেছেন, ‘সরকার মানেই মানুষকে হয়রানি করা—এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকার মানে হলো নাগরিকের সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটা নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রথম ছয় মাসকে সরকারের প্রথম পর্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে কোনো ভুল থাকলে সেটাকে ঠিকঠাক করে এখন আমরা খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।’ সরকারকে একটা ‘খেলার টিম’ অভিহিত করে জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এখন কাজ হলো কর্মপদ্ধতি ঠিক করা। খেলা হলো একটা সামগ্রিক বিষয়। একজনের ভুলের কারণে অন্যরা সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। পুরো টিমের সাফল্যটা গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। প্রস্তুতির কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটাকে পূরণ করা দরকার।’
কিন্তু সাত মাস পরও নতুন নতুন ভুল হচ্ছে। সংস্কৃতি চর্চায় বাধা, ব্যক্তিগত অধিকার হরণে বলপ্রয়োগ, উগ্র-ধর্মান্ধতার প্রসার সর্বোপরি মব জাস্টিস দমনে সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। খেলাবান্ধব ব্যক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত ড. ইউনূস। প্যারিস অলিম্পিকের মাঝমাঠ থেকে এসে দেশ পরিচালনায় অধিনায়কের দায়িত্ব নিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু যে কোনো খেলার চেয়ে জটিল হচ্ছে রাজনীতির খেলা। সতেরো বছর আগেও এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। এ খেলায় নেমে কেউ কেউ বাড়ি-গাড়ি হারিয়ে রাজপথে সংসার বেঁধেছে। কেউবা পথে পথে ঘুরে বাড়ি-গাড়ি বানিয়েছে। তবে বেশিরভাগ সময় খেলার ফল নির্ধারিত হয়েছে রাজপথে।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন