নতুন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদে’র সূচনাটা ভালোভাবে হলো না। সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হলো মারামারি, কমিটি প্রত্যাখ্যান ও পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। কোটা বৈষম্যের অবসানে গড়ে ওঠা যে আন্দোলন জুলাই অভ্যুত্থানের রূপ নেয়, নতুন ছাত্র সংগঠনের কমিটি গঠনে বৈষম্য করা হয়েছে বলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন। সংগঠনের স্লোগানে ‘শিক্ষা, ঐক্য, মুক্তি’র কথা থাকলেও প্রথমেই অনৈক্যের সুর বেজেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের নতুন রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর দুদিন আগে ছাত্র সংসদ আত্মপ্রকাশ করে। নতুন দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ কাজ করবে রাজনৈতিক মহলে এমন গুঞ্জন ছিল। তবে নতুন ছাত্র সংগঠনের নেতারা এ ধরনের গুঞ্জন নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তাদের সংগঠন কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। স্বতন্ত্র ছাত্র সংগঠন হিসেবে স্বকীয়তা বজায় রেখে এ সংগঠন কাজ করবে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছাত্ররাজনীতির নামে বছরের পর বছর ধরে যে রাজনীতি চলে আসছে, তার স্থায়ী অবসান। গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন আমলে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বলতে কিছুই ছিল না। আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত) শিক্ষাঙ্গনে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। গেস্টরুম ও গণরুমকে ‘টর্চার সেলে’ পরিণত করা হয়। সাধারণ ছাত্রদের ধরে নিয়ে এ টর্চার সেলে করা হতো নির্যাতন। ছাত্রলীগের মিছিল ও সমাবেশে যেতে বাধ্য করা হতো। কেউ মিছিলে যেতে অস্বীকার করলে তাকে ধরে এনে টর্চার সেলে ‘শাস্তি’ দেওয়া নিয়মে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। ফেসবুকে ভারতবিরোধী একটি পোস্টের জেরে আবরারকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। তবে এটিই একমাত্র কারণ ছিল না। ছাত্রলীগের বুয়েটের নেতাদের সমীহ করে সালাম না দেওয়ার ঘটনাও আবরার হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ। ছাত্রলীগের সব নেতা বুয়েটে ‘ভয়ের রাজত্ব’ কায়েম করেছিল। ছাত্রলীগ ‘হেলমেট বাহিনী’ হিসেবেও পরিচিতি পায়। ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে এই হেলমেট বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল। বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচিতেও হেলমেট বাহিনীকে হামলা চালাতে দেখা গেছে। ছাত্ররাজনীতির নামে এক বীভৎস রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনে শিকড় গেড়ে বসে। তবে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হয়েছে বিভিন্ন সরকারের আমলে। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সেভেন মার্ডারে’র ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, জাতীয় ছাত্রসমাজ হানাহানি ও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এসব ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে লিপ্ত—এমন অভিযোগ ঘুরেফিরে উঠেছে। একসময় শিক্ষাঙ্গনে বারবার রক্ত ঝরেছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অসংখ্যবার বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিল না) ব্যাপক সেশনজট তৈরি হয়। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মূল্যবান শিক্ষাজীবনের অপচয় হয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ছাত্র সংসদ নির্বাচন নির্বাসিত হয়ে পড়ে।
অথচ এ দেশে ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলন এ দেশের ইতিহাসে এক-একটি মাইলফলক। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে এতগুলো বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন এককথায় নজিরবিহীন বলা যায়। তবে অবিস্মরণীয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে গত জুলাই-আগস্টে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর সব আন্দোলনকে অতিক্রম করে গেছে জুলাই ছাত্র-গণআন্দোলন। দেশ কাঁপানো এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ শিক্ষার্থীরা। মূলত চাকরিতে কোটা প্রথার বৈষম্য অবসানের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলনই শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটায়। এর ফলে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ যেমন তৈরি হয়েছে; তেমনি শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে এমন ছাত্ররাজনীতির চর্চার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্ভাবনার কথা জানিয়ে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা নতুন ছাত্র সংগঠনের ঘোষণা দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পর সবাই যার যার ছাত্র সংগঠনে ফিরে গেছেন। বর্তমান প্রজন্মের যাওয়ার মতো সংগঠন, তাদের মতামত প্রতিষ্ঠা করার মতো সংগঠন নেই। নতুন ছাত্র সংগঠন যেমন শিক্ষার্থীদের অধিকারের বিষয়ে সরব থাকবে, তেমনি একজন শ্রমিকের স্বার্থেও রাজপথে দাঁড়াবে। অর্থাৎ জাতীয় পরিমণ্ডলেও ছাত্র সংগঠন দেশের স্বার্থে কাজ করবে।’ সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে নতুন ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবে। সব মতের শিক্ষার্থীকেই ধারণ করবে।’
দীর্ঘ প্রস্তুতি ও টানাপোড়েনের পর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’। ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একচেটিয়া প্রাধান্যের অভিযোগ তুলে ক্ষুব্ধ হন গণঅভ্যুত্থানের বড় ভূমিকা রাখা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। বিক্ষোভ ও মারামারির মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর ক্যান্টিন থেকে আত্মপ্রকাশ করে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, তিন ঘণ্টার নাটকীয়তার পর কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। নতুন ছাত্র সংগঠন ঘোষণার কথা ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি। পদ নিয়ে নেতাদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় তারিখ চার দিন পেছানো হয়। ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশের প্রস্তুতির সময় উত্তরা এবং বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ‘ঢাবির সিন্ডিকেট ভেঙে দাও, সিন্ডিকেট কমিটি মানি না মানব না, ঢাবির কালো হাত ভেঙে দাও, বৈষম্য মানি না’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। এর বিপরীতে একই সময়ে নতুন ছাত্র সংগঠনের সমর্থকদের ‘শিক্ষা, ঐক্য, মুক্তি’ স্লোগান দিতে দেখা যায়। একপক্ষের ঐক্যের স্লোগান, অন্যপক্ষের পাল্টা স্লোগানে অনৈক্যের সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্লোগান পাল্টা স্লোগানের পর দুপক্ষ মারামারিতে লিপ্ত হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ছাত্রী আহত হন। মারামারির ঘটনার জন্য দুপক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করে। ওই রাতে রাজধানীর বাংলা মোটরে রূপায়ণ টাওয়ারের সামনে সড়ক অবরোধ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। মারামারির ঘটনার জন্য নতুন ছাত্র সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস লেখেন, ‘মারামারির ঘটনায় তিনি দুঃখিত ও লজ্জিত।’ নাটকীয়তা, টানাপোড়েন ও মারামারির পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদে’র ২০৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা হয়েছে বলে সংগঠনের নেতারা জানান। তবে কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আধিপত্যের অভিযোগ তুলে কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে গেলে আমরা গুলির সামনে দাঁড়িয়েছি। রামপুরা-বাড্ডায় শত শত লাশ পড়লেও কখনো রাজপথ ছাড়িনি। অথচ প্রাইভেটকে উপেক্ষা করে নতুন সংগঠনের ঘোষণা আসে মধুর ক্যান্টিন থেকে, এখানে সরকার পতনের কিছুই হয়নি।’ তাদের মতে, বাংলাদেশের সার্বজনীন দল করতে চাইলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিশ্চিত করে সবাইকে সমান অধিকার দিয়ে তারপর সর্বজনীন রাজনীতিতে নামতে হবে।
আত্মপ্রকাশকে কেন্দ্র করে মারামারি, কমিটি প্রত্যাখ্যান ও পদত্যাগের ঘটনায় নতুন ছাত্র সংগঠন কি শুরুতেই হোঁচট খেলো? নেতৃত্ব নিয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরোধের জেরে নবগঠিত ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ কতটা গতিশীল হবে এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আগামীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ আরও বাড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখন দেখার বিষয়, নতুন ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা কতখানি ধারণ করতে পারে এবং ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আনতে পারে কি না? নতুন এ উদ্যোগ রাজনীতিবিমুখ সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারবে কি না, সময় তা বলে দেবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন