প্রায় ৬৩ বছর আগের ঘটনা। ১৯৬২ সালের ১৬ অক্টোবর। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জন এফ কেনেডি। সকাল ৯টার দিকে দেশটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে জানান, সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় মিসাইল বসিয়েছে। প্রেসিডেন্ট কেনেডি তৎক্ষণাৎ ১৪ জন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসেন। কীভাবে দেশকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করা যায় এ নিয়ে আলোচনা করেন। প্রাথমিকভাবে প্রেসিডেন্ট কেনেডি তার সামরিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে একমত হন যে, কিউবার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে হবে। কেনেডি বলেন, ‘আমরা তো কিউবাকে মিসাইল রাখতে দিতে পারি না। কারণ এটা আমাদের মর্যাদার ইস্যু।’
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের পরামর্শ, প্রথমে মিসাইল ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে হবে। কিউবাকে সবসময় নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে এবং নৌবাহিনীর মাধ্যমে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে। ২২ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট কেনেডি সিদ্ধান্ত দিলেন যে, কিউবাকে নৌ-অবরোধ করে রাশিয়াকে বাধ্য করা হবে তাদের মিসাইল সরিয়ে নিতে। তবে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়াকে তিনি যৌক্তিক মনে করলেন না। তিনি বললেন, ‘কিউবায় রাশিয়ার মিসাইলের ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে কিছু সোভিয়েত সৈন্য মারা যাবে। তখন তারা প্রতিশোধ নিতে চাইবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সুযোগ পেয়ে যাবে পশ্চিম বার্লিন দখল করার। হয়তো বার্লিনের দিকে তারা আরেকটি ফ্রন্ট খুলে বসবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র বিকল্প হচ্ছে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করার। কিন্তু সেটা তো খুবই বাজে ব্যাপার।’
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বেশ চাপ দেওয়া হচ্ছিল যাতে প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আমেরিকায় রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর অনেক ঊর্ধ্বে। সংকট মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি শুনলেন জাতিসংঘে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত অ্যাডেলেই স্টিভেন্সনের কথা। তার সঙ্গে আলোচনার পর কেনেডি কূটনৈতিক সমাধানের দিকে যান এবং এমনভাবে উদ্যোগ নেন যেন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের পক্ষে পিছুটান দেওয়া সহজ হয়। অক্টোবরের ২২ তারিখ প্রেসিডেন্ট কেনেডি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি রাশিয়াকে আহ্বান জানান মিসাইলগুলো সরিয়ে ফেলতে। এর আগে আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজগুলো কিউবার চারপাশে অবস্থান নেয় এবং কিউবাকে অবরোধ করে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হলো, আমেরিকার কোনো অধিকার নেই কিউবাকে নৌ-অবরোধের আওতায় আনা। কিউবার অধিকার আছে তার ইচ্ছেমাফিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যাওয়ার। সেই ১৬ অক্টোবর থেকে ১৩টি দিন এ দুটি দেশ স্নায়ুচাপের মধ্যে দিয়ে যায়। ২৯ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দেয় যে, তারা কিউবা থেকে পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন মিসাইলগুলো উঠিয়ে নেবে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা কখনো কিউবাকে আক্রমণ করবে না। যুক্তরাষ্ট্র আরও একটি প্রতিজ্ঞা করে রাশিয়ার কাছে কিন্তু সেটা করে গোপনে। সেই প্রতিজ্ঞাটি গোপন থেকে যায় বহু বছর। সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় ইতালি ও তুরস্কে যে মিসাইলগুলো বসিয়েছিল, সেগুলো তারা ধ্বংস করবে।
যাই হোক, ১৯৬২ সালের ২০ নভেম্বর রাশিয়া সব মিসাইল সরিয়ে নেয় এবং ওইদিন আমেরিকাও নৌ-অবরোধ উঠিয়ে নেয়। প্রায় ৬৩ বছর পর দুই দেশ আবার একই অবস্থার মুখোমুখি হয়। সেবার যুদ্ধ এড়ানো গেলেও এবার এড়ানো যায়নি সামরিক অভিযান।
ষাটের দশকের শুরুতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট প্রতিবেশী কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে। এবার উত্তেজনা শুরু হয়েছিল রাশিয়ার নিকট প্রতিবেশী ইউক্রেন নিয়ে। রাশিয়া হয়তো ইউক্রেন নিয়ে মাথা ঘামাত না যদি ইউক্রেন পশ্চিমা ব্লকে (ন্যাটো) যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে না করত। এটা করাতেই রাশিয়া তার অস্তিত্ব নিয়ে হুমকি অনুভব করেছে। প্রায় ৬৩ বছর আগে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে রাশিয়া আমেরিকার ক্ষোভ বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ইউক্রেন প্রশ্নে পশ্চিমাবিশ্ব রাশিয়ার ক্ষোভ বুঝতে পারেনি। যদিও চার বছর আগে আমেরিকার সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বিরোধের আবহে ৬৩ বছর আগের ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট’-এর স্মৃতি উসকে দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যদি এতটাই বোকা হয়, তাহলে তাদের ফের ওই সংকট দেখতে হবে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ষাটের দশকের শুরুতে সোভিয়েত রাশিয়া আগ বাড়িয়ে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল না। ওই সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে রাখতে তুরস্ক ও ইতালিতে ক্ষেপণাস্ত্র মজুত করেছিল আমেরিকা। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এতে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গোট বিশ্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ওই সময় সংকট নিরসনে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তার ছোট ভাই অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডিকে গোপনে ক্রেমলিনে পাঠিয়েছিলেন। রবার্ট কেনেডি ক্রুশ্চেভকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, কিউবা থেকে মিসাইল অপসারণ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানোর অন্য পথ কেনেডি প্রশাসনের সামনে খোলা নেই। ক্রুশ্চেভ শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে তার কথা মেনে নেন। ফলে ওই সময় বিশ্ব আসন্ন পারমাণবিক সংঘাতের মহাদুর্যোগ থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু আততায়ীর গুলিতে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও তার ছোট ভাই অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডি নিহত হন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রচারণা ছিল প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও তার ছোট ভাই ‘অশুভ কমিউনিজম’-এর সঙ্গে আপসরফার পক্ষে। এ আপসরফার ব্যাপারটি আমেরিকার অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তির সঙ্গে ওই সমঝোতা চুক্তির কারণে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ দলের মধ্যে সমালোচিত হন এবং তাকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে হয়। তার জায়গায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ পদে বসেন তারই এক সময়ের অনুগ্রহভাজন লিওনিদ ব্রেজনেভ। সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্যগত কারণে ক্রুশ্চেভ পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের ধারণা ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস এবং চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্বের পরিণামে তাকে সরে যেতে হয়। একজন নেতা ক্ষমতা থেকে অবসরে যাচ্ছেন এবং তাকে বন্দি না করে মুক্ত অবস্থায় থাকতে দেওয়া হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে এটি ছিল এক অভাবিত ঘটনা।
ইউক্রেন প্রশ্নে পুতিন প্রথম থেকেই বলে আসছেন, তার যুদ্ধ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয়, ন্যাটোর বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, ‘আমার বক্তব্য খুব পরিষ্কার। ন্যাটোর পূর্বমুখী অগ্রগমন অগ্রহণযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্র ঠিক আমাদের দোরগোড়ায় মিসাইল নিয়ে হাজির হয়েছে। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান আমাদের জন্য সরাসরি হুমকি। এ হচ্ছে গলায় ধারালো ছুরি ঠেকানো। আমাদের অধিকার আছে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।’
ইউক্রেন বিষয়ে মধ্য এশিয়া বিশেষজ্ঞ আনাতোল লিভেন বলেছেন, ‘ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য পদের বিষয়টি নিছক তাত্ত্বিক। একদিক থেকে দেখলে, পশ্চিমা কিংবা রুশ কারও যুক্তিরই কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এটা হচ্ছে অ্যাবাউট নাথিং বা অদৃশ্য বিষয়ের নিয়ে কূটতর্ক।’
ইউক্রেন এই মুহূর্তে ন্যাটোর সদস্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হচ্ছে, এই মুহূর্তে ইউক্রেনের ন্যাটো জোটে সদস্য পদের আবেদন এজেন্ডাবহির্ভূত। ফলে যুদ্ধের শুরুতে এ নিয়ে আলোচনার বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিল না। কিন্তু পুতিনের ভাষ্য হলো, স্নাইপার তার মাথায় তাক করার সুযোগ পাবে এই উদ্বেগ নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং প্রতিদিন জেগে উঠে এ দুশ্চিন্তায় দিন কাটানো থেকে তিনি মুক্তি চান। ইউক্রেন কখনোই ন্যাটো জোটভুক্ত হবে না, তিনি এ মর্মে লিখিত গ্যারান্টি চান। সেটি দিতে হবে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর, বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের। অন্যদিকে কোনো দেশের সার্বভৌম ইচ্ছা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র তার বরখেলাফ মানতে পারে না।
রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর বিদেশি মিত্রদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। নিজেদের দুর্ভোগের কথা জানিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় টুইটারে ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। জনযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি তার দেশের জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের গাজায় দখলদার ইসরায়েলের বর্বর হামলার সময় উল্টো সুরে কথা বলেছিলেন এই জেলেনস্কি। তেল আবিবের হাত থেকে নিজেদের রক্ষায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পাল্টা হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি একটি টুইট করেছিলেন। তাতে বলেছিলেন, ওই যুদ্ধে ইসরায়েলই ভিকটিম বা ভুক্তভোগী। দেশটির আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রে ছেয়ে গেছে, কয়েকটি শহরে আগুন জ্বলছে। অনেক ইসরায়েলি ভুক্তভোগী, আহত হয়েছে বহু মানুষ। অনেক ট্র্যাজেডি, শোক ও দুঃখ ছাড়া এসব দেখা অসম্ভব। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর জেলেনস্কির সেই টুইটটি যুক্ত করে এখন ফিলিস্তিনের অনেকেই বেশ ক্ষোভের সঙ্গে টুইট-রিটুইট করছিলেন।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন