টাকা লাগবে ৬০ কোটির মতো। মার্কিন ডলারে ৫০ লাখ। এ পরিমান বাংলা টাকায় যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতির পরিকল্পনার কথা জানান দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্যাকেজটির নাম ‘গোল্ড কার্ড’। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদ্যমান ইবি-ফাইভ ভিসা কর্মসূচির জায়গায় নতুন এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। এটি মার্কিন নাগরিকত্বের পাইপলাইন হবে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে অভিবাসী তাড়ানো, আরেকদিকে এমন চান্স বাংলাদেশিসহ এশীয় অঞ্চলের নাগরিকদের মধ্যে বেশ পুলক তৈরি করেছে।
ট্রাম্পের গোল্ড কার্ড কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি বাড়াবে বলে অভিজ্ঞতাদৃষ্টে ধারণা অনেকের। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতাদের নিজ দেশে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থসম্পদ পাচারে পুলক জাগাতে পারে। মোট কথা কালো টাকার মালিকদের পোয়াবারো হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, গোল্ড কার্ড ব্যবস্থার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থানে সাড়া জাগবে। বিদ্যমান ইবি-ফাইভ কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিদেশিদের গ্রিন কার্ড দেওয়া হয়ে থাকে। পরিকল্পনাটিতে এখনো কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে। সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য মিলবে বলে আভাস দিয়েছেন ট্রাম্প। এক সাংবাদিক ট্রাম্পের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, রুশ ধনকুবেররাও এ গোল্ড কার্ড পাবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, সম্ভবত। আরে, আমি কিছু রুশ ধনকুবেরকে চিনি, যারা বেশ দারুণ মানুষ।’ ট্রাম্পের কথাবার্তা এমনই।
বর্তমানে ইবি-ফাইভ ইমিগ্রান্ট ইনভেস্টর প্রোগ্রাম নামক কর্মসূচিটি পরিচালনা করছে ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউএসসিআইএস)। এটি যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংস্থা। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙা করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে কংগ্রেস এ কর্মসূচি চালু করেছিল। দেশের টাকা বিদেশে পাচারের হাব হিসেবে বাংলাদেশে বেশি আলোচিত মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, দুবাই। মালয়েশিয়ায় হাজারে হাজার বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম গড়েছেন।
২০১৭-১৮ সালেও বাংলাদেশিদের এ সংখ্যা ছিল শ’কয়েক। পরবর্তী বছর পাঁচেকে তা পৌঁছে যায় অবিশ্বাস্য পর্যায়ে। এ সময়ে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের মালিকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের একটি শীর্ষ অবস্থান গড়ে ওঠে। আর এই সেকেন্ড হোম করতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মালয়েশিয়ার ব্যাংকে জমা রাখতে হয়েছে। অঙ্কের পরিমাণে তা ৫০ কোটির মতো। যুক্তরাষ্ট্রে সেটা ৬০ কোটিতে মিললে একটি ঘরানার কাছে তা হবে পানির দরের মতো। মালয়েশিয়ায় নিয়মকানুন সোজা বা ফ্লেক্সিবল হওয়ায় বাংলাদেশের বৈধ-অবৈধ অর্থ সেখানে পাচার হয়ে আসছে। মালয়েশিয়া আরও আগ্রাসীভাবে এ প্রক্রিয়া চালাতে এখন সেকেন্ড হোম করার শর্ত আরও সহজ করেছে। প্ল্যাটিনাম, গোল্ড ও সিলভার—এ তিন ভাগে আবেদনকারীদের ভাগ করা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মালয়েশিয়ার ব্যাংকে জমা রাখার পর বাড়ি ও গাড়ি কেনাসহ নানা ক্যাটাগরিতে সুযোগ মেলে।
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের নামে বাংলাদেশ থেকে দুভাবে অর্থ পাচার হয়। প্রথম আমদানি-রপ্তানির নামে ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়। সরাসরি হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ অর্থের বড় একটি অংশ অবৈধ আয়। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা ও মাদক ব্যবসাসহ অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত। পুরো কাজটি অবৈধ পথেই হয়। মালয়েশিয়া বা এসব দেশে অর্থ পাঠানোর কোনো অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংক দেয়নি। ওই অর্থ সেখানে কীভাবে গেল সেটা বিএফআইইউ ও এনবিআরের তদন্ত করে দেখার তেমন সুযোগ নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) সরাসরি কাজ করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোনো সংস্থা তথ্য দিলে দুদক মানি লন্ডারিং বা আন্তর্জাতিক আইনে কিছু কাজ করতে পারে মাত্র। বছর কয়েক আগে, বাংলাদেশের কারা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছে, তা জানতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছিল। কিন্তু তাতে ফল আসেনি। কিছু অভিজ্ঞতা ও যৎসামান্য তথ্য পেয়েছে শুধু।
দেশের টাকা বিদেশে পাঠানোর সুযোগ বিবেচনায় বেশি আলোচিত মালয়েশিয়া। নানা তথ্য-সাবুদে জানা যায়, টাকা পাচার করে কানাডায় ডজনের বেশি অভিজাত বেগমপাড়া গড়েছেন দেশের অসাধু সাহেবরা। যার বেশিরভাগ টরন্টোতে। ওইসব পল্লিতে শতকোটি টাকার বিলাসবহুল বাড়িতে আয়েশি জীবন কাটান বেগমরা। এ যেন রূপকথার গল্প। স্বামী বাংলাদেশে, স্ত্রী কানাডায়। দেশে স্বামীরা অবৈধ কারবার ঘুষবাণিজ্য কিংবা ব্যাংকের টাকা লুট করে প্রাসাদ গড়েছেন কানাডায়। লুটপাটে ক্লান্তি এলে মাঝেমধ্যে স্ত্রী-সন্তানের কাছে বিশ্রামে যান এ লুটেরা সাহেবরা। কানাডার নিভৃতে থাকা এমন অসাধু স্বামীর স্ত্রীদের লোকালয়ের নাম ‘বেগমপাড়া’। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ঋণখেলাপি হিসেবে যারা প্রচারিত তাদের অনেকের বেগমরা সেখানে থাকেন বলে নাম পড়েছে বেগমপাড়া। বেগমপাড়ার লুটেরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কয়েক দিন মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। পরে আর বেশিদূর এগোতে পারেনি।
পুরো কানাডায় লাখখানেক বাংলাদেশি আছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের বেশিরভাগ থাকে টরন্টো বা তার আশপাশে। গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে বহু উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী কানাডায় গেছেন অভিবাসী হয়ে। গত কয়েক দশক ধরে, কানাডা নতুনদের আসার জন্য তাদের দ্বার খুলে দেওয়ার একটি উন্মুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কানাডার অভিবাসন নীতিতে জনসংখ্যা বাড়ানো, শ্রমের শূন্যতা পূরণ করা এবং বিশ্বজুড়ে সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয় ছিল। তাদের উৎপাত ও নানা ভেজালে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কানাডায় অভিবাসী অনুমোদনে উদার ট্রুডোকে একপর্যায়ে কঠোর হতে হয়। হাত দেন কাটছাঁটে। এ কাটছাঁটের আওতায় ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটিতে স্থায়ীভাবে বাস করতে আসা মানুষের হার ২১ শতাংশ কমানোর কথা বলা আছে। অর্থাৎ এতদিন স্থায়ী বাসিন্দাদের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ থাকলেও চলতি বছরের মধ্যে তা ৩ লাখ ৯৫ হাজারে নামিয়ে আনা হবে।
অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের কারণে অন্যান্য দেশ যেসব সংকটের মুখে পড়েছিল, কানাডাও একপর্যায়ে সেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এর জেরে কানাডায় অস্থায়ী বসবাসের প্রোগ্রামগুলোয় এ কাটছাঁটের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অস্থায়ী বিদেশি কর্মী এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরাও এ কাটছাঁটের অন্তর্ভুক্ত হবেন। সরকারের নীতিতে এ পরিবর্তনকে ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি থামানোর’ প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের যন্ত্রণাটা একটু ভিন্ন। রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বিষয়আসয়ের সঙ্গে তা অর্থনৈতিক সম্পর্কিতও। এর জেরে অভিবাসীদের বিষয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠেন ট্রাম্প। নেন কিছু কৌশল ও পদক্ষেপও। তার নির্দেশনা মতো শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়া থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীদের কোস্টারিকায় পাঠানোর কর্মসূচি। সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয়েছে পানামা সীমান্তবর্তী জঙ্গলের আশ্রয়কেন্দ্রে। ফ্লাইটের আরোহীরা ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন, তুরস্ক, আর্মেনিয়াসহ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের। ওই ফ্লাইটে থাকা ৬৫ শিশুসহ অন্তত ১৩৫ জনের মধ্যে ৪০ জন ভারতের। তাদের পাঠানো হয়েছে কোস্টারিকার রাজধানী থেকে ২২৪ মাইল দূরে পানামা সীমান্তবর্তী বনাঞ্চল ঘেঁষা অভিবাসী আশ্রয়কেন্দ্র। এতদিন পানামা আর গুয়াতেমালায় পাঠানো হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়ানো অবৈধ অভিবাসীবাহী ফ্লাইট। এর আগে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়ানোর কর্মসূচির অংশ হিসেবে পানামা আর গুয়াতেমালায় পাঠানো হতো। এর ধারাবাহিকতায় এবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আটক অনুপ্রবেশকারীদের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে কোস্টারিকায় পাঠানো শুরু হয়। বিতাড়িত অবৈধ অভিবাসীদের দেশে পাঠানোর আগপর্যন্ত সার্বিক ব্যবস্থাপনার খরচও যুক্তরাষ্ট্রের। আর তদারকির দায়িত্বে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম। চলতি মাসের শুরুতে কোস্টারিকা সফরে গিয়ে অবৈধ অভিবাসীদের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পাকাপোক্ত করে এসেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।
অভিবাসী খেদানো এমন অ্যাকশনের মাঝেই ট্রাম্পের মতিবদল। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বিদেশিদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কর্মসূচি ও ইউক্রেনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা উপস্থাপন। দেন ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের শর্তে নাগরিকত্বের গোল্ড কার্ড ভিসা দেওয়ার ঘোষণা। এ কর্মসূচির মাধ্যমে জাতীয় ঋণের বোঝা কমবে বলে কড়া যুক্তি ক্ষ্যাপাটে এ মার্কিন প্রেসিডেন্টের। বাংলাদেশে কারও কারও প্রশ্ন, শেষ পর্যন্ত আদম ব্যবসা? ৬০ কোটি টাকায় যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসতের সুযোগ নেওয়ার বহু আদম রয়েছে এ বঙ্গদেশে। তাদের বেশিরভাগই এখন দুর্গতিতে। ট্রাম্পের ভাষায় যা গোল্ডেন কার্ড। তাদের কাছে এটি গোল্ডেন অপরচুনিটি, গোল্ডেন চান্স। হেলায় এ সুযোগ হাতছাড়া না করার মতো বুঝজ্ঞান তাদের আচ্ছামতো রয়েছে। উন্নত জীবনের খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হওয়ার মানসিকতা গত কয়েক বছরে বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। অর্থ ও সম্পদ পাচারের দুরভিসন্ধিসহ নানা কারণে আইনের নাগাল এড়ানোর তাগিদ থেকেই ঘটছে স্থায়ী অভিবাসনের বেশিরভাগ ঘটনা। সেখানে এখন মার্কিনি হাতছানি। একে তো নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি। ঠেকানোর সাধ্য কার?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন