বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৫, ০৭:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণহত্যাই স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে

গণহত্যাই স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে

যে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়, তার পক্ষে নাগরিকদের মিত্র হওয়া কঠিন, বিশেষ করে দুর্বল নাগরিকদের সঙ্গেই তো তার সম্পর্কটা দাঁড়ায় সরাসরি শত্রুতার। অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে রাষ্ট্রের গুণাগুণের পরীক্ষা অন্য কোথাও তেমন হয় না, যেমনটা হয় ব্যক্তি নাগরিকের জীবনে। কার সুবিধা হচ্ছে, কার জন্য ঘনিয়ে আসছে বিপদ তা দেখেই জানা যায় রাষ্ট্রের চরিত্রটা কেমন—ভালো নাকি মন্দ। বাংলাদেশে আমরা দুই-দুইবার স্বাধীন হয়েছি, ভেবেছি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। রাষ্ট্র কেমনতর স্বাধীনতা এনেছে তার পরীক্ষা নাগরিকদের জীবনে যথারীতি হয়ে গেছে। সাতচল্লিশে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান সে পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি, একাত্তরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশও যে খুব সুবিধা করতে পারছে এমনটা বলা যাবে না। বিশেষভাবে বিপদ ঘটেছে গরিব মানুষের এবং সংখ্যালঘুদের। সংখ্যালঘুদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়ে যারা সংখ্যাগুরুদের থেকে ভিন্ন তারা আছে, এ সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কম নয়; জাতিগত পরিচয়ের সংখ্যালঘুরাও রয়েছে, এরা বাঙালি নয়, এদের সংখ্যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের তুলনায় কিছু কম। সংখ্যালঘুদের ভেতর যারা গরিব তারা আবার একবার নয়, দুবার পীড়িত হয়—একবার গরিব হিসেবে, আরেকবার সংখ্যালঘু হিসেবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে নীরবে দেশত্যাগের যে প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে, তা রাষ্ট্রের জন্য মোটেই গৌরবজনক নয়।

সংখ্যালঘু সমস্যার চাপেই কিন্তু সাতচল্লিশে ভারত বিভক্ত হয়েছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু ছিল; তবে মুসলমানদের সংখ্যাও কম ছিল না, এক-চতুর্থাংশের কাছাকাছি হবে। ব্রিটিশ শাসনের যখন অবসান হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তখন মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকরা দেখল ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রে তাদের পক্ষে স্থায়ীভাবে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা; তখন তারা বলল যে তারা স্বতন্ত্র জাতি, তাই তাদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমি প্রয়োজন। অবিভক্ত ভারতের কাঠামোতে ওই সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না, ব্রিটিশের প্ররোচনা এবং দুই সম্প্রদায়ের বিত্তবান অংশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উভয় কারণেই সমস্যা রক্তাক্ত সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছিল, যার ফলে ভারত বিভক্ত হয়ে গেল। কিন্তু তাতে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হলো না। আসলে ভাগ হলো পূর্বে বাংলা এবং পশ্চিমে পাঞ্জাব, এ দুই খণ্ডাংশের সঙ্গে পশ্চিমের সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে যুক্ত করে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো; তাতে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা যেমন রয়ে গেল, তেমনি অবিভক্ত ভারতের যে অংশ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হলো, সেখানকার মুসলমানরা পরিণত হলো সংখ্যালঘুতে। দলে দলে শরণার্থীরা ওপার থেকে এপারে আসতে এবং এপার থেকে ওপারে যেতে বাধ্য হলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে অবসান ঘটল তাও নয়। এককথায় বলতে গেলে স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠে বহু মানুষের প্রাণবিয়োগ ও আশ্রয়হানির ঘটনা ঘটল।

নতুন দুই রাষ্ট্রের কোনোটিই প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হয়নি, নাগরিকদের মধ্যে অধিকার ও সুযোগের সাম্য আসেনি। বাংলাদেশ একবার স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তানের অংশ হয়ে, দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলো পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু দুবারের কোনোবারই যে সে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি তার অনেক প্রমাণের একটি হলো, পুনরায় উল্লেখ করা দরকার— সংখ্যালঘুদের জন্য বিদ্যমান বিশেষ বৈষম্য।

পাকিস্তানের ভিত্তি ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ; বাংলাদেশের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত নতুন রাষ্ট্র তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন আর রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত নয়, উপরন্তু রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের অনুপ্রবেশও ঘটে গেছে। বাস্তব ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘুরা নিরাপদে নেই। এ সংখ্যালঘুদের মধ্যে উর্দুভাষীদের সংখ্যা অল্প। যেহেতু তারা সংখ্যালঘু এবং অধিকাংশই দরিদ্র তাই তাদের দুর্দশাটা অত্যন্ত কঠিন। এদের খবর আমরা বড় একটা রাখি না। তার কারণ আছে। ভাষাগতভাবে এরা বিচ্ছিন্ন; তদুপরি রয়েছে জাতিগত বিদ্বেষ। উর্দুভাষীরা, বিশেষ করে ‘বিহারি’ বলে যারা পরিচিত তারা, পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেনি, একাত্তর সালে তাদের ভূমিকা ছিল সরাসরি শত্রুতার। কিন্তু বিহারিরা কেউ কেউ এখনো বাংলাদেশে আছে। যারা অবস্থাপন্ন তারা চলে গেছে, রাজনৈতিকভাবে যারা এদের ব্যবহার করত সেই নেতৃস্থানীয় বিহারিরাও এখন আর বাংলাদেশে নেই, অধিকাংশই গেছে পাকিস্তানে, কেউ কেউ এমনকি বিহারেও ফিরে গেছে, বাংলাদেশে যারা রয়ে গেছে তারা নিরুপায় ও অসহায়। কেউ থাকে ক্যাম্পে, কেউ অনুন্নত নির্দিষ্ট এলাকায়, অনেকের দুর্দশা বাংলাদেশের বস্তিবাসীদের মতোই। বস্তিবাসীরা তবু সহজে চলাফেরা করতে পারে, অন্বেষণ করতে পারে জীবিকার, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিদের সে সুযোগও সীমিত।

বিহারিজ, দি ইন্ডিয়ান এমিগ্রিজ ইন বাংলাদেশ, অ্যান অবজেকটিভ অ্যানালিসিস নামে আহমেদ ইলিয়াস একটি বই লিখেছেন : যাতে এ দুর্দশা ও তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সারা বইজুড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস আছে, যেটি পাঠককে অনায়াসে স্পর্শ করে। কিন্তু শুধু ওই দীর্ঘশ্বাসের জন্য নয়, বইটি গুরুত্বপূর্ণ এজন্যও যে, এতে এ উপমহাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। জাতি ও জাতীয়তা, ধর্ম ও ভাষা, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্রিয়াকলাপ, সংখ্যালঘুদের অবস্থানÑএসবই প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে বিবেচনার মধ্যে এসে গেছে। সর্বোপরি এসেছে ব্যক্তির কথা, যে ব্যক্তি রাষ্ট্রে বসবাস করে, যাকে সম্প্রদায় ও জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে হয় এবং যে তার ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই নানা সংকটে পতিত হয়। বইটি যা বলে তার চেয়েও বেশি জিজ্ঞাসা তুলে ধরে। সেই জিজ্ঞাসাগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচ্য।

আহমেদ ইলিয়াস নিজেও একজন বিহারি। দুই পুরুষ আগে তারা বিহারের মুঙ্গের জেলা থেকে কলকাতা আসেন, সেখানেই ছিলেন তিনি ১৯৫৩ পর্যন্ত, তারপর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে, একাত্তরের পর যোগ দেন একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থায়। বইটি লিখেছেন তিনি যত্ন করে, তথ্য সংগ্রহ করেছেন আগ্রহ ভরে; তিনি উর্দুভাষায় কবিতা লেখেন, তার কাব্যিক সংবেদনশীলতাও এ বইতে খুব সহজেই পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি চেষ্টা করেছেন যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে বিষয়গুলোকে দেখতে এবং যদিও সেটা কষ্টসাধ্য ছিল তার পক্ষে। কেননা একে তো তিনি সংবেদনশীল, তদুপরি যা নিয়ে লিখেছেন তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তবুও পড়তে গিয়ে মনে হবে না যে বইটি পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট।

সব বই এবং বইয়ের আলোচ্য পূর্ববঙ্গনিবাসী উর্দুভাষী মানুষদের জীবনজুড়ে যে প্রশ্নটি কখনো সরবে, অধিকাংশ সময়ে নীরবে উচ্চারিত সেটা হলো, কেন এমনটা ঘটল। ওই অতদূর থেকে, জন্মভূমি সেই বিহার ছেড়ে এতগুলো মানুষ কেন শরণার্থী হয়ে এমন একটি দেশে এলো, যার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক দূরত্ব খুবই বড় এবং একবার শরণার্থী হয়ে এসে কেনইবা তারা পুনরায় শরণার্থী হয়ে পড়ল বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো—তখন? এসব প্রশ্নের জবাব তো আমাদের জানাই আছে, সেটা হলো উপমহাদেশের রাজনীতি। ওই রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে বিত্তবানদের নেতৃত্বে, তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, নেতারা সে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে, কিন্তু ওই রাজনীতি বহু মানুষকে বিপদে ফেলেছে, কারও কারও সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে। বিহারে মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু, তাদের শতকরা হার ছিল ১২ থেকে ১৪, সেখানকার শিক্ষিত মুসলমান (শিক্ষিতরাই তো রাজনীতি করত) কংগ্রেসকেই সমর্থন করত; তারপর এলো মুসলিম লীগের প্লাবন, স্বপ্ন জেগে উঠল পাকিস্তানের; ভারতের অন্যত্র যেমন, বিহারেও তেমনি মুসলমানরা ভাবল পাকিস্তান না হলে তারা চিরকালের জন্য গোলাম হয়ে থাকবে। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট কলকাতায় ভয়ংকর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তারপর দাঙ্গা বাধে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীতে, সেটা শেষ হতে না হতে দাঙ্গা দেখা দেয় বিহারে। ৩০ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দাঙ্গা চলে। সেই দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান হতাহত হয়, ঘরবাড়ি হারায়, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে। ওই দাঙ্গাটাই ছিল চূড়ান্ত আঘাত। এরপর ভারত-বিভাগের অনিবার্যতা সম্বন্ধে ভিন্নমত পোষণ করা কঠিন হয়ে পড়ল। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বলেছিলেন যে, বিহারের ‘হত্যাকাণ্ড’ই পাকিস্তান তৈরি করেছে। খুব যে বাড়িয়ে বলেছিলেন তা নয়। আবার একাত্তরের গণহত্যাই অনিবার্য করে তুলেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গোষ্ঠীর ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ

স্বামীর কবর দেখতে গিয়ে ‘মারধরের’ শিকার জুলাই শহীদের স্ত্রী

বিএনপি কারো কাছে মাথা নত করেনি, করবে না : এ্যানী

ঈদে মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রই আর টিকবে না’

চাঁদপুরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া

ঈদ মিছিল নিয়ে হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি

সিলেটে মধ্যরাতে বিএনপি-যুবদল সংঘর্ষ

প্রতারণার শিকার জবি শিক্ষার্থীর পাশে ছাত্রদল নেতা

১০

৩২ শহীদ পরিবারের সঙ্গে জামায়াত আমিরের ঈদ উদযাপন

১১

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের চেষ্টা প্রকৌশলী হাবিবের

১২

৩ যুগ ইমামতি শেষে রাজকীয় বিদায়

১৩

আমরা একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই : ডা. শফিকুর রহমান

১৪

রুনা লায়লাকে নিয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে যে কথা হয়েছিল শাহবাজ শরিফের

১৫

চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত

১৬

সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চাওয়া ফ্যাসিবাদের অংশ : সারোয়ার তুষার 

১৭

আজ থেকে সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু

১৮

ইন্ডিয়া টুডেকে মাহফুজ আনাম / ‘বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, ছাত্রদের অনাগ্রহ, অস্পষ্টতায় জামায়াত’

১৯

কেউ আ.লীগকে পুনর্বাসিত করতে পাববে না : হান্নান মাসউদ

২০
X