জর্জ হ্যারিসন বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রতিভাবান জনপ্রিয় গায়ক ও গিটারিস্ট। বিখ্যাত ব্যান্ড সংগীত দল ‘দ্য বিটলস’-এর চার সদস্যের একজন হিসেবে তিনি বিখ্যাত। জর্জ হ্যারিসন সংগীত পরিচালনা, রেকর্ড প্রযোজনা এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রায় সবক্ষেত্রে সমান দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তিনি ১৯৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্য বিদেশি সংগীতশিল্পীদের তুলনায় জর্জ হ্যারিসনের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান রয়েছে অনন্য উচ্চতায়। এর পেছনের কারণ ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। ১৯৭১ সালের কথা। বাংলাদেশে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর পৈশাচিকতা জর্জ হ্যারিসনকে বেদনাতুর করে তুলেছিল। বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পপসংগীতের এ জনপ্রিয় শিল্পী ও পণ্ডিত রবি শংকর তখন দুটি দাতব্য সংগীতানুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একাত্তরের ১ আগস্ট নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সে সময় এক বেনিফিট সংগীত অনুষ্ঠানের (কনসার্ট ফর বাংলাদেশ) আয়োজন করেন। এ কনসার্ট থেকে সংগৃহীত হয় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। সেই অর্থ তখন বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেওয়া হয়েছিল। কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন তার নিজের লেখা বিখ্যাত সেই মর্মস্পর্শী ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানটি পরিবেশন করেন। সেদিনের কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন নোবেলজয়ী বব ডিলানসহ পৃথিবীর সেরা শিল্পীরা। কনসার্টের টিকিট, ক্যাসেট থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ ইউনিসেফের ফান্ডে জমা করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ‘বাংলাদেশ’ গানটিই ছিল প্রথম কোনো চ্যারিটি সংগীত। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ‘বাংলাদেশ’ গানটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, গানটির মধ্যে হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য উঠে এসেছে, তা বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে মানুষের স্পর্শ করেছে। জর্জ মূলত লিড গিটারিস্ট হলেও বিটলসের প্রতিটি অ্যালবামেই তার নিজের লেখা ও সুর দেওয়া দু-একটি একক গান থাকত, যা হ্যারিসনের প্রতিভার পরিচায়ক ছিল। বিটলসের হয়ে এ সময়ের গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—ইফ আই নিডেড সামওয়ান, ট্যাক্সম্যান, হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস, হেয়ার কামস দ্য সান ও সামথিং ইত্যাদি। বিটলস ভেঙে যাওয়ার পরও তার জনপ্রিয়তা কমেনি। ’৭০-পরবর্তী সময়ে তার অনেক গান প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়েছিল। এ সময়কালের গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—মাই সুইট লর্ড (১৯৭০), গিভ মি পিস অন আর্থ (১৯৭৩), অল দোজ ইয়ার্স এগো (১৯৮১), গট মাই মাইন্ড সেট অন ইউ (১৯৮৭)। হ্যারিসন ২০০১ সালে ২৯ নভেম্বর ৫৮ বছর বয়সে মেটাস্টাটিক নন-স্মল সেল লাং ক্যান্সারে মারা যান। হলিউড ফরএভার সিমেট্রিতে তাকে দাহ করা হয়। এরপর তার দেহভস্ম ভারতের কাশ্মীরের কাছে গঙ্গা ও যমুনা নদীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিবারের কাছের লোকেরা ভারতে হিন্দুরীতিতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জর্জ হ্যারিসনের বক্তব্য ছিল—‘সব মতবাদই একটি বৃহৎ বৃক্ষের শাখা। তুমি তাকে কী নামে ডাকবে এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।’
মন্তব্য করুন