বাঙালি লেখক ও সমাজসেবক কালীপ্রসন্ন সিংহ। হুতোমপ্যাঁচার নকশা তার শ্রেষ্ঠ মৌলিক রচনা। বাংলা গদ্যের উন্নয়নে হুতোমপ্যাঁচার নকশা মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। সতেরো খণ্ডে সংস্কৃত মহাভারতের বাংলা গদ্যানুবাদও তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। তিনি ঊনবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। মাত্র ২৯ বছরের জীবনে তিনি সাহিত্য ও সমাজের উন্নয়নে অসংখ্য কাজ করেছেন।
কালীপ্রসন্ন সিংহর জন্ম ১৮৪০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ‘সিংহ’ পরিবারে। ছয় বছর বয়সে পিতা মারা যাওয়ার পর হরচন্দ্র ঘোষ নামে নিম্ন আদালতের একজন বিচারক কালীপ্রসন্নের অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত হন।
বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসেবে পরিচিত, তত্কালীন হিন্দু কলেজে তিনি ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে কলেজ ত্যাগ করেন। বাড়িতেই তার ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষা অব্যাহত রাখেন। তিনি মিস্টার ক্রিকপ্যাট্রিক নামক এক ইউরোপীয় শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ইংরেজির জ্ঞান উন্নত করেন। কালীপ্রসন্ন একাধারে লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, জনহিতৈষী, সামাজকর্মী এবং শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মহান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদান রেখে গেছেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি অদ্ভুত স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। অল্প বয়সেই কালীপ্রসন্নের বুদ্ধিমত্তা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’। এখানে সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে মিলিত হয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ উপস্থাপন ও আলোচনা করতেন। ওই সভা বিধবাবিবাহ এবং অন্যান্য সংস্কার আন্দোলনের মতবাদ প্রচার করত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে বিধবা-পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের লক্ষ্যে বেঙ্গল কাউন্সিলে আবেদনপত্র পেশ করার জন্য কালীপ্রসন্ন তিন হাজারেরও বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। বিধবাবিবাহ আইন পাস হলে তিনি বিধবা-বিবাহকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ১ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেন। বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের জন্য ওই সভা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। নীলকরদের নিপীড়নমূলক আচরণ উদ্ঘাটনে অবদানের জন্য রেভারেন্ড জেমস লঙকেও তারা সংবর্ধিত করেন। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক অনুবাদের অভিযোগে জেমস লঙের এক মাসের কারাদণ্ড ও ১ হাজার টাকা জরিমানা হলে কালীপ্রসন্ন তা পরিশোধ করেন। কালীপ্রসন্ন ছিলেন শিল্প ও সংস্কৃতির, বিশেষত নাট্য সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। নাটক ও যাত্রার মাধ্যমে সামাজিক জ্ঞান বৃদ্ধির মানসে তিনি ১৮৫৬ সালে বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে প্রথম মঞ্চস্থ হয় বেণীসংহার নাটক এবং কালীপ্রসন্ন স্বয়ং এতে অভিনয় করেন। তৎকালীন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় তিনি পর্যায়ক্রমে বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা, সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা এবং বিবিধার্থ সংগ্রহ নামে তিনটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। তিনি নিজ সম্পাদনায় কিছুদিন পরিদর্শক নামে একটি দৈনিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন। নাটক, প্রহসন, উপন্যাস, নকশা, প্রবন্ধ ও অনুবাদ মিলে তার গ্রন্থসংখ্যা ৯টি। কালীপ্রসন্ন সিংহ ১৮৭০ সালের ২৪ জুলাই মারা যান।