সম্ভাবনার বদলে শুধু শঙ্কার খবর। দেশের মানুষকে বাস্তবতা মানার আহ্বান জানিয়ে রাতারাতি মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার আশা না করার পরামর্শ দিয়েছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। জানিয়েছেন, আরও ছয় মাসেও মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামবে না। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার সুসংবাদও নেই। বছরখানেকেও সেই সফলতার সম্ভাবনা নেই। বলার আর তেমন বাকি রাখেননি গভর্নর। অর্থনীতিবিদরা বলতে শুরু করেছেন, একাত্তরের পর বাংলাদেশ এত বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে আর পড়েনি। অথচ মাস কয়েক আগেও মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার টার্গেটের কথা শোনানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এ দশার সঙ্গে শ্রীলঙ্কা বড় প্রাসঙ্গিক। অভ্যুত্থানে তারাও আমাদের মতো গুঁড়িয়ে-পুড়িয়ে-উড়িয়ে দেওয়ার কিছু কাণ্ডকীর্তি করেছে। বিদ্বেষ-বিভেদ চরিতার্থ করেছে। আমাদের গণভবন স্টাইলে সেখানকার রাজপ্রাসাদে ঢুকে রংঢংও করেছে। দিন কয়েকের মধ্যে এ পর্ব আবার শেষও করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন করেছে। ঐক্য অটুট রেখে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিকের মতো। সদ্য দেওয়া বাজেট যেন আরেক ম্যাজিক। কয়েক মাস ধরে জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের দাম কমানো, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর থেকে ট্যাক্স তুলে নেওয়া, বিগত দক্ষিণপন্থি সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীদের অবৈধ সম্পত্তিগুলো বাজেয়াপ্ত করাসহ জনকল্যাণমূলক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলঙ্কার বামপন্থি সরকার।
এসব করতে গিয়ে আমাদের মতো কথার এত কচলানি হয়নি। বাজেটে উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য সরকারি খাতে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ। কলেজ পর্যায়ে বৃত্তি মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা করা হয়েছে। সরকারি স্কুলে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য মাসে দেড় হাজার টাকা করে স্কলারশিপ চালু করা হয়েছে। পাবলিক লাইব্রেরি, সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন, নতুন প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা, পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও ক্যাম্পাসে স্পোর্টস একাডেমি চালুসহ রূপকথার মতো বরাদ্দ। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৬০ হাজার ৪০০ কোটি। কিডনি পেশেন্টদের বার্ষিক চিকিৎসার জন্য মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা ভর্তুকি ও বার্ধক্যজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা ভর্তুকি সরকারি বরাদ্দ। মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে ২৫ কোটি বরাদ্দ। শিশু ও মহিলাদের চিকিৎসাসংক্রান্ত সরকারি ২০০ কোটি বরাদ্দ। গৃহহীন ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর জন্য নতুন আবাসন ও গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ অনেকটাই অবিশ্বাস্য। শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির অঙ্কও পিলে চমকানো। ক্ষেতমজুর ও দিনমজুরের দৈনিক আয় সর্বনিম্ন ১ হাজার ৭০০ টাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর বেসরকারি কর্মীদের মাসিক বেতন এপ্রিল, ২০২৫ থেকে সর্বনিম্ন ২৭ হাজার টাকা বাধ্যতামূলক। ২০২৬ সাল থেকে সেটা ৩০ হাজার টাকা হবে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান, রেশনব্যবস্থা, কৃষি, শিল্প, ট্যুরিজম, বন্দরের মতো ৩৭টি খাতে সরকারি বরাদ্দ ঘোষণা। স্বর্গীয় আমেজ।
কমিউনিস্টরা অলৌকিকতা বা স্বর্গে বিশ্বাস করেন না। বাংলাদেশের বামদের চিন্তা, সক্ষমতা সেদিকে যায় না কেন? শ্রীলঙ্কার বামরা বাস্তববাদী। তাদের গণতন্ত্র চলে সরল রেখা বরাবর। পরিবারতন্ত্র সেখানেও আছে। কিন্তু গণতন্ত্রের কাছে তাদের হাত-পা বাঁধা। সেখানে ভোট কারচুপি সম্ভব নয়। মানুষও যারপরনাই সচেতনতা। উগান্ডা-রুয়ান্ডাকেও এখন আর দুর্ভিক্ষ-হানাহানির দেশের তালিকায় ফেলে রাখার দিন নেই। ব্রিকসে যোগদানের সুযোগ পাওয়া ইথিওপিয়াকে ট্রল করাও অবিচার। কোনো ঝাড়ফুঁক বা ওলি-আউলিয়ার দোয়া বা আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়া নয়, খাদের কিনার থেকে যথাসময়ের যথাকাজ তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছে। অন্ধকার আফ্রিকা বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ ওখানে এখনো খাদক-মাদক-সিন্ডিকেট কম নয়। পাশ্চাত্য নতজানুসমৃদ্ধ আফ্রিকাকে দরিদ্র করেছে, তা দেশগুলোর নাগরিকদের বোধোদয়ে আসা হঠাৎ শুরু হয়নি। সময় লেগেছে। বাংলাদেশ ঋণী হয়েছে বরাবরই। কিন্তু কখনো খেলাপি হয়নি। এটি সক্ষমতার ব্যাপার। পরিশোধের সক্ষমতা থাকাতেই বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ঋণ দিচ্ছে। দাতা সংস্থাগুলোর শক্ত মনিটর থাকলে দুর্নীতির লাগামে টান পড়তে বাধ্য, তা উপলব্ধির সুফল পাচ্ছে উগান্ডা-রুয়ান্ডা-ইথিওপিয়ার মতো নিন্দার তালিকাভুক্ত দেশগুলো।
পরিবারতন্ত্র, দলকানা রাজনীতি, রাজনৈতিক ডামাডোল-অস্থিরতা ওইসব দেশেও ছিল, আছে। লুট-চুরির অর্থ বিদেশে পাচারের কায়কারবারও আছে। প্রায় দেউলিয়া হওয়ার জেরে শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক ও কদাকার রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। যার অনিবার্য পরিণতিতে শ্রীলঙ্কার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। দেশ ছাড়তে হয় দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে। তেমন কিছুর আশা বা দুরাশা দেখার অপেক্ষমাণ লোক বাংলাদেশেও ছিলেন। বাংলাদেশে সেরকম কিছু হয়নি। আবার শ্রীলঙ্কাও নেতিয়ে পড়া থেকে উতরে ওঠে কম সময়ের মধ্যে। নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, দুর্বৃত্তায়নসহ ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারের লাগামহীন দুর্নীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নয়ছয় ছিল এর মূল কারণ। চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন ‘আরাগ্যালায়া’। এ আন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক সহিংসতার লঙ্কাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক পালাবদল। এ পাল বা ছন্দ বদলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা একটু একটু করে বদলাতে বদলাতে আজ এ অবস্থায় পৌঁছেছে। খাদ্য ও জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ঊর্ধ্বমুখী। দেশটির নতুন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি তাদের পরিস্থিতির এমন নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এর পাশাপাশি করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে পর্যটন খাতের ঘুরে দাঁড়ানো, কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়টিও ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ শ্রীলঙ্কার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও সংহত হয়েছে। ফলে সরকার কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনস্বার্থের বিষয়টিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ সেখানে তৈরি হয়েছে। এ জায়গাটিতে দেশটির সাধারণ জনগণও সচেতন। তাই সংকট উত্তরণে তারাও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে।
শ্রীলঙ্কা এখনো ঋণগ্রস্ত। ২০২৭ সালের মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে দেশটিকে। শুধু শ্রীলঙ্কার স্থানিক নয়, বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কাছেও এটি বিশ্লেষণের বিষয়। প্রথমত তারা দেখছেন, শ্রীলঙ্কা সরকারের ব্যয় সংকোচন এবং করের আওতা সম্প্রসারণে রাজস্ব বাড়ানোর ঘটনা। সরকারি নীতি ও কিছু স্বয়ংক্রিয় বিষয়ের সমন্বয় এ ধরনের পরিস্থিতি সামলাতে কীভাবে কাজে দেয়—শ্রীলঙ্কা এর উদাহরণ তৈরি করেছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কয়েকটি খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সঙ্গে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি বেইল আউট প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন বিক্রমাসিংহে। গত মার্চে আইএমএফ বোর্ড সেটি অনুমোদন করে। এরপর খাদ্যমূল্য, বিদ্যুতের দাম সামান্য কমানোর চেষ্টা করে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করে সরকার। এর অংশ হিসেবে ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। পরিস্থিতি সামলাতে সরকার শুরু থেকেই রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেছে। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। যাদের অনেকেই ডাক্তার, প্যারামেডিকেল কিংবা আইটি প্রফেশনাল। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ২০২৩ সালের আগপর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে ১৬ বার আইএমএফের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
শুরুতে তাদের স্বাধীনতাটি ছিল রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। এতে নতুন করে নব্য উপনিবেশের কবলে পড়ে দেশটি। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সাজানো না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কোনো চালের অংশ—এ বিশ্লেষণ শেষ হওয়ার নয়। তবে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানো আরও বেশি বিশ্লেষণের বিষয়। দেউলিয়া হওয়া থেকে বের হয়ে আসা, খাদ্য ও জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠা, মূল্যস্ফীতি কমানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঊর্ধ্বমুখী করার মতো ঘটনার পূর্বাপরে রাজনীতি-অর্থনীতি-কূটনীতির জন্য দৃষ্টান্ত। এরপরই না শিক্ষা নেওয়ার পর্ব। কারও কারও বিশ্লেষণে এটি বামচর্চার ফল। মানে ডানে বাঁক নিলে এমন দৃষ্টান্ত সম্ভব নয়? বিষয়টি মোটেই ডান-বামের নয়। এটি একটি ব্যবস্থাপনার ফল। এরপরও বামচিন্তার কিছু ভিন্ন রসায়ন রয়েছে।
পাঠ পঠনের জন্য বাংলাদেশের বামেরা নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার দিকে তাকাতেই পারেন। রাজাপাকসে পরিবার প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৫ বছরের বেশি শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছিল। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বাঁকবদল হয় ২০২২ সালে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, দেখা দেয় আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি। শুরু হয় গণবিক্ষোভ। সিংহলি ভাষায় যার নাম আরাগ্যালায়া, মানে সংগ্রাম। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। এর আগে তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দাও পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। দুই ভাই ক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। আরাগ্যালায়া আন্দোলনের নেতৃত্ব এককভাবে কোনো দল দাবি করেনি। অন্যকে দোষেনি। স্থানীয় না জাতীয় নির্বাচন আগে, সংস্কার না বিচার; এসব নিয়ে ছেলেখেলা খেলেনি। কে না উপলব্ধি করছেন ৫ আগস্টের পর থেকে বিপ্লবের সুফল হাইজ্যাকের নানা রকমফের। যে যেভাবে পারছেন করছেন। কিচ্ছা বানাচ্ছেন। পারলে বাহাত্তর সালের মতো মুক্তিযুদ্ধের জাল সনদ তৈরির প্রজেক্টও নিচ্ছেন। ছাত্রদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বিভিন্ন বিবৃতি ও বক্তৃতা চলছে। ছাত্ররাও ছেড়ে কথা বলছে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট;
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন