বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরোধিতা করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই ইতিহাস ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের গৌণ ভূমিকাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করা হয়েছে। এটাই হলো ফ্যাসিবাদের ধর্ম। তারা জাতির গৌরবময় ইতিহাস দখল করে এবং রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিজেদের মতো তা নির্মাণ করে, প্রয়োজনে পুনর্নির্মাণ করে
রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতি কোনো ব্যক্তিবিশেষের অবদানের সঙ্গে ইতিহাস কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। সময় নেয়। কখনো যৌক্তিক কারণে, কখনো অনাহুত আলোচনা, সমালোচনা হয়। কিন্তু তাতে সত্যের উজ্জ্বলতা কখনো ম্রিয়মাণ হয় না। বাস্তব ন্যায়নিষ্ঠ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। কোনো ব্যক্তির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদানকে অস্বীকার করার চারিত্রিক শক্তি ইতিহাসের নেই। সেই একই কারণে দেশ বিভাগের পর চল্লিশের দশকের শেষ দিকে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একুশ শতকের এক দশক পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে আবদুল মতিন এ দেশের মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে লড়াই সংগ্রাম করেছেন তাকে অস্বীকার করা যায় না। এতে আপন অর্জনের গৌরবকে কেবল উপেক্ষা করা হয়।
আবদুল মতিন বায়ান্নের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা। তিনিই একুশের মহানায়ক। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে তিনি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন এবং তিনিই ১৪৪ ধারা ভাঙার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরোধিতা করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই ইতিহাস ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের গৌণ ভূমিকাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করা হয়েছে। এটাই হলো ফ্যাসিবাদের ধর্ম। তারা জাতির গৌরবময় ইতিহাস দখল করে এবং রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিজেদের মতো তা নির্মাণ করে, প্রয়োজনে পুনর্নির্মাণ করে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে তারা ইতিহাস ঐতিহ্যকে দখল করে। মর্মান্তিক পতন না হওয়া পর্যন্ত তাদের এ ধারা অব্যাহত থাকে। আর পতনের পরও তারা মনে করে, তারা যা করেছে ঠিকই করেছে, অন্যায় কিছু করেনি। তারা এতটাই অনুভূতিহীন নির্বোধ যে, জীবনের কোনো স্তরেই তাদের মধ্যে অনুশোচনার বোধ জাগে না।
পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, যেন শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলন হয়েছে, তিনিই একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আরও দুঃখজনক ও লজ্জাজনক বিষয় এই যে, বিগত সরকারের আমলে একুশের বইমেলায় শিশু চত্বর ‘শেখ রাসেল শিশু চত্বর’ নামকরণ হয়েছিল। যেন শেখ রাসেল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মারা গিয়েছিল। বিষয়টি নিদারুণ দুঃখজনক এই কারণে যে, বায়ান্নের ২২ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ওহিউল্লাহ নামে এক কিশোর নিহত হয়েছিল। ভাষাশহীদ ওহিউল্লার নামে একুশের বইমেলার শিশু চত্বর হওয়াটা যৌক্তিক। কিন্তু তার কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি। তার পরিবর্তে মুজিবপুত্র শেখ রাসেলকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও একুশের বইমেলার সঙ্গে যুক্ত করেছি। এর মাধ্যমে যে পাপ আমরা করেছি, এর কোনো ক্ষমা নেই। ইতিহাস আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না। শহীদের আত্মারা আমাদের অভিশাপ দেবে। বাংলা একাডেমির কাছে প্রত্যাশা, আগামী বইমেলায় শিশু চত্বরকে তারা ওহিউল্লাহর নামে করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে। সেইসঙ্গে আবদুল মতিনের অবদান যথাযথভাবে তুলে ধরবে। এতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস দখলমুক্ত করার পথ উন্মুক্ত হবে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সরকার পোস্টাল স্ট্যাম্প, পোস্টকার্ড, মানিঅর্ডার ফরম এবং এনভেলাপে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করলে নিম্ন আয়ের সরকারি চাকরিজীবীরা তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। আবদুল মতিন তাদের দ্বারা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হন। বাংলা ভাষার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়া দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চের ভাষা দিবসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হয়।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদ-এ-আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। এটা গভর্নর জেনারেল হিসেবে ছিল তার প্রথম সফর। ২১ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ যখন বলেন, ‘Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan,’ আবদুল মতিন এ সময় জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদে সোচ্চার হতে চাইলে তার সঙ্গীরা মুখ চেপে ধরে তাকে নিবৃত্ত করেন। এরপর মার্চের ২৪ তারিখে কার্জন হলে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ আবারও বলেন, ‘Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan.’ তখন আবদুল মতিনকে আর নিবৃত্ত করা যায়নি। তিনি জিন্নাহ মুখের ওপর বলেন, No, No. It will be not. আবদুল মতিনের এ বক্তব্যে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহসহ উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। ওই সময় আবদুল মতিন কোনো রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ১৯৪৯ সালে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে দুই মাসের আটকাদেশ দেয়। আটকাদেশের মেয়াদ শেষ হলে ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোয়াজ্জেম হোসেন তাকে আন্দোলন করবেন না—এ মর্মে মুচলেকায় সই করতে বললে তিনি তা করতে অস্বীকার করেন এবং এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে তিন বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।
১৯৫০ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবসের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ছাত্রদের একটি সভায় আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হলে তিনি তার আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তখন থেকেই ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরে আন্দোলন ফলপ্রসূ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যান।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের উর্দুপ্রীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তিনি এবং ৩১ জানুয়ারি গঠিত ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারিতে তীব্র আন্দোলনের ডাক দেন। এ কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি জানিয়ে দেয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে রমনা এলাকায় ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে। এরপর অনেকটা তড়িঘড়ি করে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব জরুরি সভা ডাকেন। এ সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়। ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির ৮ জন আওয়ামী লীগের, কমিউনিস্ট পার্টির ২ আর বাকি ৭ জন ছিলেন অন্য দল এবং ছাত্র সংগঠনের সদস্য। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সব সদস্যসহ ১১ জন ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নেন। কমিউনিস্ট পার্টির দুই সদস্য ভোটদানে বিরত থাকেন। আবদুল মতিন ও অলি আহাদসহ চারজন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে অবস্থান নেন। সভায় ১৪৪ ধারার ভাঙার বিপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় আবদুল মতিন বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে বিষয়টি পেশ করা হোক। ছাত্রদের মতামতের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য রাখেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত সবাই বিপুল উল্লাসে আবদুল মতিনের বক্তব্যকে স্বাগত জানান এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে মত দেন। এরপর আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়। এর পরের ইতিহাস বাঙালির অস্তিত্ব, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার ইতিহাস। এ আন্দোলনে যারা শহীদ হলেন, সবরকমের ঝুঁকির মধ্যেও ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে তাদের গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের নিয়ে প্রথম ভাষাশহীদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে সারারাত জেগে ছাত্ররা তৈরি করেন শহীদ মিনার। এটি নির্মাণকাজে মতিনও ইট বহন করেন। ১৯৫২ সালের ৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার একটি গোপন বৈঠক থেকে অন্য ভাষাসংগ্রামীদের সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরের বছর ১৪ মার্চ তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য তিনি ভাষা মতিন হিসেবে পরিচিত।
আবদুল মতিন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন পাবনা জেলার ধুবালীয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুল জলিল এবং মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আবদুল মতিন এখন শুধু বাঙালির অহংকার নন, তিনি এখন সারা বিশ্বের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার এক অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস।
আবদুল মতিন ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি তার চোখ দুটি সন্ধানীর আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংকে দান করেন। তার দান করা দুই চোখের দুই কর্নিয়া দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে এক অন্ধ যুবক ও যুবতীকে। স্বাস্থ্যকর্মী রেশমা নাছরিন ও মো. ইকবাল কবীর নামে একজন স্কুলশিক্ষকের চোখে ফিরে এসেছে আলো। তাদের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে আবদুল মতিনের কর্নিয়া। এ ছাড়া তিনি নিজের শরীরটাও দান করে গেছেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য।
নিজেকে দান করার চেয়ে কঠিন কাজ জগতে কিছু নেই। মানুষের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ ও দাতা হওয়ার সাহসী মানসিকতা আবদুল মতিন সহসা অর্জন করেননি। সেই যে প্রথম যৌবনে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ অন্যায় অবস্থানের প্রতিবাদ করেছিলেন, মানুষের অধিকার অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, সেই অঙ্গীকার অটুট আছে তার মৃত্যুর পরও। তার এ অঙ্গীকার আমাদের বলে দেয় যে, মানুষ মরে যায়, কিন্তু মানবতার মৃত্যু নেই। মানুষের জীবনকে ঘিরে মানবতার এ অখণ্ড প্রবাহ চলে বলেই মানবিক মূল্যবোধ কখনো নিঃশেষ হয় না।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক