বাংলাদেশ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও পরিবেশগত সমস্যার কারণে দেশটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বায়ু, শব্দ ও পানিদূষণ, বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা দেশের জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী ও উপকূলীয় এলাকাবাসী এসব সমস্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা জনসাধারণকে সচেতন করার পাশাপাশি পরিবেশ লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উন্মোচন করেন এবং নীতিনির্ধারকদের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেন।
সাংবাদিকরা গবেষণা প্রতিবেদন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং প্রচারমূলক লেখনীর মাধ্যমে পরিবেশগত তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলেন। তারা জনগণের সঙ্গে সরকারি নীতিমালা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার সংযোগ স্থাপন করেন। তারা শুধু সমস্যার দিক তুলে ধরেন না, বরং সম্ভাব্য সমাধানও উপস্থাপন করেন, যা সমাজে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এভাবে তারা সমাজে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তুলতে সহায়তা করেন এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করেন।
পরিবেশ সাংবাদিকতার গুরুত্ব ও ভূমিকা: পরিবেশগত সমস্যা উন্মোচন: পরিবেশ সাংবাদিকতা সাধারণ মানুষের সামনে পরিবেশের অব্যবস্থাপনা ও দূষণের কারণ তুলে ধরে। এটি জনসাধারণ, সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, যাতে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে ঢাকার বায়ুদূষণ বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে চলে গেলে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, ইত্তেফাক, ডেইলি সান, নিউ ন্যাশন, কালবেলা, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন গবেষণা ও বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বায়ু ও শব্দদূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরতে সাংবাদিকতার ভূমিকা: বায়ু ও শব্দদূষণ বর্তমানে পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, যা মানবস্বাস্থ্য ও প্রকৃতির জন্য এক বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা এসব দূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। আইসিডিডিআর,বি, ক্যাপস, স্পারশোর মতো বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়ে কাজ করছে এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন প্রতিবেদনে ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণকাজের ধুলোবালি দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরে। পরবর্তীকালে আদালত ও সরকার কয়েকটি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে এবং নির্মাণস্থলে ধুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়মকানুন জারি করে। সাংবাদিকরা এসব তথ্য তুলে ধরে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করছে।
নদী ও পানিদূষণ রোধে সাংবাদিকতা: বাংলাদেশের অনেক নদী শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত রাসায়নিক ও গৃহস্থালি বর্জ্যের কারণে দূষিত হচ্ছে। সাংবাদিকরা একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে নদীর ভয়াবহ দূষণের চিত্র তুলে ধরেছেন। ২০১৯ সালে ঢাকার চারপাশের নদী দখল ও দূষণের ফলে পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে সময় টেলিভিশন ধারাবাহিক প্রতিবেদন করায় সরকারের পক্ষ থেকে নদী দখল দূষণমুক্ত করতে টানা দুই বছর অভিযান পরিচালনা করেছিল। ২০১৯ সালে দ্য ডেইলি স্টার বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উঠে আসে যে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন ট্যানারি ও টেক্সটাইল শিল্পের কারণে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় এবং সরকার ট্যানারি শিল্পকে সাভারে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়।
এ ছাড়া ২০২২ সালে প্রথম আলো একটি বিশেষ প্রতিবেদনে জানায় যে, দেশের ৫৪টি নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এ ধরনের প্রতিবেদন সরকারকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তুলে ধরা: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বর্ষা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কৃষি ও মানবজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের লাখো মানুষ বাসস্থান হারাচ্ছে।
২০২১ সালে প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানায়, উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা ও খুলনার হাজার হাজার পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়ে ঢাকার বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। সাংবাদিকদের এসব প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যা পরবর্তী সময়ে জলবায়ু অভিযোজন ও সহায়তা প্রকল্পে সাহায্য করে।
২০২২ সালে এখন টিভি, চ্যানেল২৪ ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু শরণার্থীদের নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে দেখানো হয় কীভাবে সাতক্ষীরা ও খুলনার কৃষিজমি লবণাক্ততার কারণে চাষযোগ্যতা হারাচ্ছে এবং সেখানকার মানুষ শহরে অভিবাসন করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব প্রতিবেদন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব চিত্র সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে এবং সরকারকে জলবায়ু সহনশীল নীতি গ্রহণে উৎসাহিত করে।
পরিবেশ নীতিমালা ও সরকারের জবাবদিহিতায় সাংবাদিকদের ভূমিকা
সাংবাদিকরা শুধু সচেতনতা বৃদ্ধির কাজই করেন না, বরং নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহির আওতায় আনেন।
নীতিমালার কার্যকারিতা যাচাই: অনেক সময় সরকার পরিবেশ রক্ষার জন্য নতুন আইন ও নীতিমালা ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। সাংবাদিকরা মাঠপর্যায়ে গিয়ে এসব নীতির কার্যকারিতা পর্যালোচনা করেন এবং প্রয়োগের দুর্বলতা তুলে ধরেন।
ঢাকার বায়ুদূষণ বর্তমানে এক মারাত্মক সমস্যা। ২০২৩ সালে প্রথম আলো এবং বিডিনিউজ২৪ মতো দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন সংবাদ পত্রিকা এবং এনটিভি, এখন টিভিসহ একাধিক টিভি চ্যানেল প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেখায়, কীভাবে ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলো ঢাকার বায়ুর গুণগত মান নষ্ট করছে। জনসাধারণের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়। এর ফলে সরকার নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং বেশ কিছু অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়।
সরকার ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ: অনেক শিল্পকারখানা পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।
২০২২ সালে সমকাল পত্রিকা আশুলিয়া শিল্প এলাকার কিছু কারখানার অবৈধ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উঠে আসে, কীভাবে কারখানাগুলো কলকারখানা আইন লঙ্ঘন করে দূষণ ছড়াচ্ছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কয়েকটি কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়।
সাধারণ মানুষের আচরণগত পরিবর্তনে ভূমিকা সাংবাদিকদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে অনেক সময় জনগণের আচরণেও পরিবর্তন আসে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, গাছ লাগানো, নদীদূষণ প্রতিরোধে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রচার চালিয়ে তারা পরিবেশ রক্ষায় সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করেন।
সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা: তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহে বাধা: অনেক সময় পরিবেশগত তথ্য ও গবেষণা প্রতিবেদন সরকার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গোপন রাখে, যা সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন তৈরি করা কঠিন করে তোলে।
হুমকি-হয়রানি: পরিবেশবিষয়ক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করলে অনেক সাংবাদিক হুমকির মুখে পড়েন। ২০২২ সালে নোয়াখালীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এক সাংবাদিককে হুমকি দেওয়া হয়। ২০২২ সালে যুগান্তর পত্রিকার এক সাংবাদিক মেঘনা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশের পর হুমকি পান।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা: অনেক সংবাদমাধ্যমে পরিবেশ সাংবাদিকতার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট থাকে না, ফলে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করা কঠিন হয়ে পড়ে।
পরিবেশ সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ: বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসার ও নাগরিক সাংবাদিকতার বিকাশের ফলে পরিবেশ সাংবাদিকতায় নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইউটিউব, ফেসবুক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো পরিবেশবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পরিবেশ সাংবাদিকদের জন্য অনুদান দিচ্ছে, যা সাংবাদিকদের আরও কার্যকর ও গভীর অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে সহায়তা করছে। পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টি ও নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের কাজ শুধু সমস্যা চিহ্নিত করাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথও দেখায়। তবে পরিবেশ সাংবাদিকদের সুরক্ষা, তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধা এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এভাবে সাংবাদিকতার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন আরও জোরদার হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ, বাসযোগ্য ও টেকসই বাংলাদেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: এসাইনমেন্ট ডেস্ক ইনচার্জ, এখন টেলিভিশন