আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুন। আজ ভালোবাসার দিন, ফুল ফোটা ও পাখি ডাকার দিন। ফাগুনের উদাসী হাওয়ায় মনের মানুষের আরও কাছে আসার দিন। ভালোবাসা একটি দীর্ঘ সম্পর্কের নাম। একটি স্বচ্ছ ও গভীর অনুভূতি। একটি নির্ভেজাল ও নিঃস্বার্থ দায়িত্ববোধ। এ অনুভূতির কোনো ধর্ম ও বর্ণ নেই, নেই কোনো সীমারেখা কিংবা কাঁটাতারের বেড়া। এ সম্পর্ক অনেকটা হাত এবং চোখের মধ্যে সম্পর্কের মতো। হাতে যখন আঘাত লাগে, তখন চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। আবার চোখে যখন অশ্রু ঝরে, তখন হাত চোখের অশ্রু মুছে দেয়। মনের টান কথাটা খুব পুরোনো। পৃথিবী যতই এগিয়ে যাক, দিন যতই বদলাক, আমরা যতই পাল্টাই, কিছু জিনিস কখনো পাল্টায় না। এরই একটি হলো ভালোবাসার বোধ। কিন্তু নারী-পুরুষের এই চিরায়ত সম্পর্ককেও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা নিজের শৃঙ্খলে বন্দি করতে চায়, আবদ্ধ রাখতে চায় নিজ গণ্ডির মধ্যে, করতে চায় ব্যবসা, লুটতে চায় মুনাফা। এ উদ্দেশ্যেই বিশ্বের দেশে দেশে এখন বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপিত হয় ভালোবাসা দিবস। শুধু ‘ভালোবাসা’ নয়, এ আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে ‘মা’ এবং ‘বাবা’কেও। অর্থাৎ আছে ‘মা’ দিবস এবং ‘বাবা’ দিবসের আয়োজন। বিষয়টি নিদারুণ দুঃখজনক। তবে এ কথাও তো মিথ্যে নয় যে, সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার বোধ ক্রমেই কমছে। মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও পরিচিতজনদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। সমাজে বিচ্ছিন্নতা সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি। এ লক্ষ্যেই হয়তো এই দিনগুলো বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই দিনগুলো এক অমানবিক বাস্তবতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে প্রতিকারের আশায়। প্রতিকার কতটা হয় তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ে।
আজ শুধু ভালোবাসার দিন নয়। প্রতিবাদেরও দিন। ভালোবাসা দিবসের আড়ালে রয়েছে বারুদের গন্ধমাখা স্মৃতিবিজড়িত একটি অগ্নিঝরা দিন। ফাগুনের এই দিনটির সঙ্গে মিশে আছে ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ জাফর জয়নাল, দিপালী সাহার লাল টকটকে রক্ত-আত্মত্যাগের এক সংগ্রামী ইতিহাস। এদিন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সূচিত হয়েছিল প্রথম বড় ধরনের আন্দোলন, যা মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন হিসেবে পরিচিত।
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এরপর ওই বছর শিক্ষা দিবস (১৭ সেপ্টেম্বর) সামনে রেখে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৬ সেপ্টেম্বর মৌন মিছিল করে ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী এবং ছাত্র ঐক্য ফোরামসহ কয়েকটি সংগঠন। এসব কর্মসূচির মাধ্যমেই ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে দৃঢ় হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালের ৮ নভেম্বর ১৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর ১৩ ডিসেম্বর এ সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচির ডাক দেয়।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদের উপদেষ্টা মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া হয়। এ কর্মসূচি সফল করতে ছাত্রদের একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বেলা ১১টার দিকে শিক্ষা ভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয়। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন ও দিপালী সাহাসহ কয়েকজন। নিহতদের কয়েকজনের লাশ গুম করে সরকার। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। একই সঙ্গে ওই সময় পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় এবং ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। ছাত্রহত্যা এবং পুলিশি হামলার প্রতিবাদে পরদিন এ আন্দোলন জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পরদিন সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হয় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। এরপর পশ্চিম থেকে আসা ভ্যালেন্টাইন ডের জোয়ারে ভেসে যেতে শুরু করে রক্তের অক্ষরে লেখা গৌরবময় সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক দিন। নব্বই-পরবর্তী মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল জোয়ারে দিনটি পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের এখন আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে সংবাদপত্রের ওপর এতই নিষেধাজ্ঞা ছিল যে, ১৪ ফেব্রুয়ারির বিক্ষোভ এবং ছাত্রহত্যার ঘটনা ওই সময়ের কোনো পত্রিকা সরকারের প্রেসনোটের বাইরে অন্য কোনো খবর প্রকাশ করতে পারেনি।
১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক ‘গতকালের ঘটনা সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোট’ এবং দৈনিক সংবাদ ‘রাজধানীতে কারফিউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে প্রকাশ করে। ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সরকার এক প্রেসনোটে ঢাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের লক্ষ্যে পরিচালিত ক্রমবর্ধমান ও পরিকল্পিত ছাত্র গোলযোগ বন্ধের উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। প্রেসনোটে বলা হয়, এই ছাত্র গোলযোগ শান্তিপ্রিয় জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিতেছিল। ঢাকায় ছাত্রদের এক দিনের উসকানিমূলক গোলযোগের প্রেক্ষিতে সরকার নিন্মোক্ত ব্যবস্থাবলি ঘোষণা করিয়াছে—
(১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হইয়াছে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হইবে। আজ (মঙ্গলবার) সকাল ৯টার মধ্যে ছাত্রদের সকল আবাসিক হল ত্যাগ করিতে হইবে।
(২) সভা, শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণাসংক্রান্ত বিধিসমূহ কঠোরভাবে প্রয়োগ হইবে।
(৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ধ্যা ৬টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত এবং মেট্রোপলিটন ঢাকার অবশিষ্ট এলাকায় রাত্রি ১০টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকিবে। ঘোষণায় বাংলাদেশ সচিবালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গোলযোগে পর্যবসিত ঘটনাবলির উল্লেখ করা হয়। ১৪টি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনসমূহের মোর্চা তথাকথিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা কয়িয়াছিল যে, তাহারা সরকারি নীতির প্রতিবাদে সচিবালয় অবরোধ করিবে। সকাল ১১টায় তাহারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং বক্তারা সামরিক আইন ভঙ্গ করিয়া ছাত্রদেরকে আইন নিজের হাতে তুলিয়া লওয়ার আহ্বান জানাইয়া উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেয়। ছাত্রনেতা নামধারী এই সকল পেশাদার উস্কানিদাতাদের উস্কানিতে ছাত্ররা একটি শোভাযাত্রা বাহির করে, যা কি না সামরিক আইনে নিষিদ্ধ। সরকারের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে দিতে তাহারা একযোগে সচিবালয়ের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে এবং পুলিশ পুরাতন হাইকোর্টের কার্জন হল সংযোগস্থলে তাহাদিগকে থামাইয়া দেয়। অতঃপর উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা কর্তব্যরত পুলিশের প্রতি ব্যাপকভাবে ইট নিক্ষেপ করিতে শুরু করে এবং পুলিশ কর্ডন ভাঙার চেষ্টা করে। সংখ্যাগত কারণে কোণঠাসা হইয়া শুধুমাত্র লাঠি ও বেতের ঢাল সজ্জিত পুলিশ বিপদগ্রস্ত হয় এবং জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিবার জন্য হোসপাইপের সাহায্যে পানি নিক্ষেপ করে। উহা ব্যর্থ হইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করিয়া ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়।’... (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ১৯৮৩)।
এরশাদের ক্ষমতা দখল: ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের এভাবে ক্ষমতা দখলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে অনেকটাই নীরবে মিলিটারি স্বৈরশাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিলেও ছাত্ররা মেনে নেয়নি এই সামরিক অভ্যুত্থান। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় ছিল ৮ বছর ২৫৬ দিন। এ সময় দেশের হাজার হাজার মানুষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেছে। হত্যা- গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশেষত ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে।
রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট: এরশাদের সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে পোস্টার লাগাতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর তিন সদস্য গ্রেপ্তার হন। এই ছাত্রনেতারা হলেন শিবলী কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আব্দুল আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সেই থেকে শুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াইয়ের দিনগুলো। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে শহীদবেদিতেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। মিছিলের খবর শুনে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী এসে স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর নির্মম নির্যাতন করে। সরকারি ফরমান ও তৎপরতার কারণে ওই সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লাল-কালো অক্ষরে এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন অব্যাহত থাকে। ছাত্রদের দেয়াল লিখন সমানে মুছতে থাকে সামরিক সরকারের তল্পিবাহক পুলিশ বাহিনী। পুলিশ যত দেয়াল সাদা চুন টেনে মুছে ফেলে, ছাত্ররা ততই দেয়াল লিখন চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলছিল দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের প্রাথমিক প্রস্তুতি। এ সময় ছাত্রনেতারা একটি সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করা হয়। সেটাই ছিল সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম লিখিত প্রতিবাদ।
এরশাদের উত্থান ও স্বেচ্ছাচারিতা: জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখল করে একটি সামরিক ফরমান (এমএলআর-৮২) জারি করেন এরশাদ। এতে আকারে-ইঙ্গিতে কেউ তার সামরিক শাসনের সমালোচনা-বিরোধিতা করলে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদ শুরু হলে এই এমএলআর-৮২-এর অধীনে রাজনৈতিক নেতাসহ হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনামলে আন্দোলন-সংগ্রাম ঠেকাতে বহু জাতীয় রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করেন।
রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের ক্ষমতা দখলকে প্রথমদিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে অনেকটাই নীরবে মিলিটারি স্বৈরশাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি মেনে নিলেও ছাত্ররা মেনে নেয়নি এই সামরিক অভ্যুত্থান। ক্ষমতা দখলের দিনই (২৪ মার্চ ১৯৮২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সরকারি ফরমান তৎপরতার কারণে সে সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লাল-কালো অক্ষরে এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন অব্যাহত থাকে। ছাত্রদের দেয়াল লিখন সমানে মুছতে থাকে সামরিক সরকারের তল্পিবাহক পুলিশ বাহিনী। পুলিশ যত দেয়ালে সাদা চুন টেনে মুছে ফেলে, ছাত্ররা ততই দেয়াল লিখন চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলছিল দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের প্রাথমিক প্রস্তুতি। এ সময় ছাত্রনেতারা একটি সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া হয়। সেটাই ছিল সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম লিখিত প্রতিবাদ।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক