বেশ কিছু রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে অসচেতনতা দেখা যায়, যার মধ্যে মৃগী বা খিঁচুনি রোগও একটি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে এবং তাই নানা ভ্রান্তধারণাও প্রচলিত। প্রতি বছর বিশ্ব মৃগী দিবস পালিত হয়, যাতে মৃগীরোগের ভুল ধারণাগুলো তুলে ধরা হয় এবং রোগের প্রকৃত তথ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
বিশ্ব মৃগী দিবসের ইতিহাস: বিশ্ব মৃগী দিবস পালন শুরু হয় ২০১৫ সালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সোমবার এ দিনটি পালিত হয়। ২০২৫ সালে এ দিনটি পড়েছে ১০ ফেব্রুয়ারি, তাই দিনটিতে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব মৃগী দিবস। এ দিবসটি আয়োজনের জন্য দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে এসেছে—একটি হলো ইন্টারন্যাশনাল ব্যুরো ফর এপিলেপ্সি এবং অন্যটি ইন্টারন্যাশনাল লিগ অ্যাগেইনস্ট এপিলেপ্সি। এদের যৌথ উদ্যোগে পালিত হয় এ বিশেষ দিনটি।
মৃগীরোগটি আদতে কী: বিশেষজ্ঞরা মৃগীরোগকে মস্তিষ্কের একটি প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখানে ব্রেনের বিভিন্ন স্নায়ুকোষের মধ্যে ইলেকট্রিক আদান-প্রদান চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে এই ইলেকট্রিক আদান-প্রদানের মধ্যে তড়িতীয় বিস্ফোরণ ঘটে, যা খিঁচুনি বা মৃগীরোগের কারণ হতে পারে। সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুটি পরপর খিঁচুনি দেখা দিলে সেটি মৃগীরোগের লক্ষণ বলে ধরা হয় এবং তখনই সতর্ক হতে হবে।
মৃগী ও খিঁচুনির মধ্যে তফাত: অনেকেই খিঁচুনিকে মৃগীরোগ মনে করেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, খিঁচুনি মৃগীরোগ নয়। প্রায় সবাই জীবনে এক বা দুবার খিঁচুনির সম্মুখীন হতে পারেন, যা মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক ব্যবস্থার সমস্যা হতে পারে। তবে এই এক বা দুবারের খিঁচুনি মৃগীরোগের লক্ষণ নয়। যদি ঘন ঘন খিঁচুনি দেখা দেয়, তবে সেটি মৃগীরোগের লক্ষণ হতে পারে।
মৃগীরোগ একটি স্নায়ুগত সমস্যা: মৃগীরোগ নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই একে মানসিক সমস্যা মনে করেন, কিন্তু আদতে এটি একটি স্নায়ুগত সমস্যা, মানসিক নয়।
মৃগী একটি স্নায়বিক অবস্থা, যা বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে বাংলাদেশে ভুল ধারণা এবং কলঙ্কে আচ্ছন্ন রয়েছে। এই মৃগী দিবসে, আমাদের লক্ষ্য এ অবস্থার ওপর আলোকপাত করা, মিথ দূর করা এবং মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমর্থন করার জন্য সহানুভূতি, বোঝাপড়া এবং সক্রিয় পদক্ষেপকে উৎসাহিত করা।
মৃগীরোগ বোঝা: মৃগীরোগ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্নায়বিক ব্যাধি, যা বারবার খিঁচুনি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এটি মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের কারণে ঘটে। এই খিঁচুনিগুলো ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, মনোযোগে সংক্ষিপ্ত ভ্রান্তি বা পেশির ঝাঁকুনি থেকে দীর্ঘস্থায়ী খিঁচুনি পর্যন্ত। এটি স্বীকার করা অপরিহার্য যে, মৃগীরোগ একটি মানসিক রোগ বা অভিশাপ নয়; যেমন কিছু পুরোনো বিশ্বাস পরামর্শ দিতে পারে। এটি একটি চিকিৎসা অবস্থা যা বয়স, লিঙ্গ বা আর্থসামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে।
বাংলাদেশে ব্যাপকতা: বাংলাদেশে এটি অনুমান করা হয় যে, জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও বেশি মৃগীরোগে জীবনযাপন করে, তবু সচেতনতার অভাব, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা এবং সামাজিক কলঙ্কের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নির্ণয় করা যায় না বা চিকিৎসা করা হয় না। এ অবস্থাটি প্রায়ই ব্যক্তি এবং পরিবারকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়, তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা চাইতে বাধা দেয়।
কমন মিথ ও ফ্যাক্টস: ১. মিথ: মৃগীরোগ সংক্রামক।
সত্য: মৃগীরোগ সংক্রামক নয়। এটি একটি স্নায়বিক অবস্থা, সংক্রামক রোগ নয়।
২. মিথ: মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না।
সত্য: সঠিক চিকিৎসা এবং সহায়তার মাধ্যমে, মৃগীরোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে, কাজ করতে পারে, পড়াশোনা করতে পারে এবং এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী হতে পারে।
৩. মিথ: মৃগী খিঁচুনি হয় দখল বা মন্দ আত্মার কারণে।
সত্য: মৃগীর খিঁচুনি মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক স্রাবের কারণে হয় এবং এর জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, আধ্যাত্মিক হস্তক্ষেপ নয়।
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ: ১. কলঙ্ক এবং বৈষম্য: বাংলাদেশে মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই স্কুল, কর্মক্ষেত্রে এমনকি তাদের পরিবারের মধ্যে ও বৈষম্যের সম্মুখীন হন। এ কলঙ্ক অনেককে সময়মতো চিকিৎসা সাহায্য চাইতে বাধা দেয়।
২. চিকিৎসার সীমিত অ্যাকসেস: অনেক গ্রামীণ এলাকায় নিউরোলজিস্ট বা মৃগী-নির্দিষ্ট যত্নের অ্যাকসেস নেই। এর ফলে চিকিৎসার একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবধান দেখা দেয়, যা সঠিক ওষুধ বা রোগ নির্ণয় ছাড়াই অনেকে ভোগে।
৩. সচেতনতার অভাব: সাধারণ জনগণের মধ্যে মৃগীরোগ, এর লক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা উদ্বেগজনকভাবে কম। খিঁচুনি পরিচালনার প্রাথমিক জ্ঞান অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে কার্যত অস্তিত্বহীন।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃগীরোগ কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে:
* ওষুধ: অ্যান্টি-মৃগীর ওষুধ (AEDs) ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষেত্রে খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
* সার্জারি: কিছু রোগীর জন্য, ওষুধ কার্যকর না হলে অস্ত্রোপচার সাহায্য করতে পারে।
* লাইফ স্টাইল পরিবর্তন: পর্যাপ্ত ঘুম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং খিঁচুনি ট্রিগার এড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খিঁচুনির জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা: খিঁচুনির সময় কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয় তা জানলে জীবন বাঁচাতে পারে এবং জটিলতা প্রতিরোধ করতে পারে:
১. শান্ত থাকুন এবং নিশ্চিত করুন যে ব্যক্তি নিরাপদ পরিবেশে আছে।
২. দমবন্ধ করতে সাহায্য করার জন্য তাদের পাশে আলতো করে ঘুরিয়ে দিন।
৩. তাদের মাথার নিচে নরম কিছু রাখুন।
৪. তাদের নড়াচড়া বন্ধ করবেন না বা তাদের মুখে কিছু রাখবেন না।
৫. খিঁচুনি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সঙ্গে থাকুন।
৬. যদি খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় বা এটি তাদের প্রথম খিঁচুনি হয় তবে চিকিৎসা সহায়তা নিন।
সমাজ কীভাবে সাহায্য করতে পারে: ১. শিক্ষা এবং সচেতনতা: মৃগীরোগ সম্পর্কে লোকেদের শিক্ষিত করতে স্কুল, কর্মক্ষেত্র এবং সম্প্রদায়গুলোতে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান পরিচালনা করুন এবং পৌরাণিক কাহিনিগুলো দূর করুন।
২. অন্তর্ভুক্তির প্রচার করুন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিগুলোকে উৎসাহিত করুন, যাতে মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য করা না হয়।
৩. স্বাস্থ্যসেবা অ্যাকসেস উন্নত করুন: সরকার এবং স্বাস্থ্যসেবা সংস্থাগুলোকে অবশ্যই সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসার অ্যাকসেস উন্নত করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।
৪. সমর্থন নেটওয়ার্ক: নির্দেশিকা, সংস্থান এবং মানসিক সহায়তা প্রদানের জন্য মৃগীরোগের সঙ্গে মোকাবিলা করা ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য সহায়তা গোষ্ঠী এবং হেল্পলাইন স্থাপন করুন।
আশার বার্তা: এই মৃগীরোগ দিবসে আসুন আমরা এমন একটি সমাজ তৈরি করার অঙ্গীকার করি, যা মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বুঝতে এবং সহায়তা করে। সঠিক চিকিৎসা, সমবেদনা ও সচেতনতার মাধ্যমে আমরা তাদের স্বাভাবিক, উৎপাদনশীল জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারি। আসুন কলঙ্ককে সহানুভূতি দিয়ে, ভয়কে জ্ঞান দিয়ে এবং বর্জনকে অন্তর্ভুক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপন করি। একসঙ্গে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে, বাংলাদেশে মৃগীরোগে বসবাসকারী কেউ একা বা প্রান্তিকবোধ না করে। মৃগীরোগ রাস্তার শেষ নয়, এটি এমন একটি যাত্রা যা আমরা একটি সমাজ হিসেবে, আক্রান্তদের জন্য সহজ এবং আরও আশাব্যঞ্জক করতে পারি।
লেখক: এফসিপিএস (নিউরোলজি), ফেলো ইন অ্যাডভান্স এপিলেপ্সি অ্যান্ড ইইজি (ইউএমসিসি, মালয়েশিয়া) ও সহকারী অধ্যাপক, নিউরোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।