বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চ বর্তমানে বেজায় সরগরম। এর প্রধান কারণ আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; যিনি কি না ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিলাষ ব্যক্ত করে আসছেন। অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছেন, তিনি ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেন। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তিনি যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করছেন, সেগুলো দেখে আমার মনে হচ্ছে, তার ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। হয়তো তিনি সাউন্ড গ্রেনেড—যত গর্জে তত বর্ষে না; অথবা হয়তো তিনি বিধ্বংসী এক বিস্ফোরক, যা আগামী চার বছরে সমগ্র মানবজাতির জন্য অভিশাপ বলে প্রমাণিত হবেন।
তবে এ কথা আমি নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি, আসন্ন চার বছর গতানুগতিক রাজনীতির কোনো দেখা মিলবে না। হয় আমাদের সব ভীতি বাস্তব রূপ ধারণ করবে; নয়তো মধ্যপ্রাচ্যে ৪০ বছর ধরে চলমান আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাম্প্রতিককালের সংকটগুলোর অবসান ঘটবে। ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসকদের পতন ঘটতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আবার বিশ্বব্যাপী নৈরাজ্যও সৃষ্টি করতে পারেন। সম্প্রতি তিনি ফিলিস্তিনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এ দ্বারা তিনি সঠিক কী বোঝাতে চাইছেন, তা এখনো কারও কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি এই অঞ্চলের যুদ্ধ স্থগিত করে দিতে পারেন; আবার ফিলিস্তিনিদের চিরকালের জন্য বাস্তুহারাও করে দিতে পারেন।
এমনটা চিন্তা করা কোনো অতিরঞ্জিত ভাবনা নয়। কেননা রাজনীতির মাঠে ট্রাম্প এক অপ্রত্যাশিত খেলোয়াড়। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের যিনি প্রেসিডেন্ট, তিনি ঠাট্টা করে কোনো কথা বললেও আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি না। কবি আল-মুতানব্বি যেমনটা বলেছেন—‘সিংহের দাঁত দেখতে পেলে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, সে হাসছে। হয়তো সে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতিই নিচ্ছে।’
এখনো ১০০ দিন হয়নি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার। অথচ এরই মধ্যে তিনি এফবিআইর উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন। মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসআইডির কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। পাশাপাশি সংস্থাটির হাজার হাজার কর্মীর অন্যত্র স্থানান্তর করেছেন; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছেন এবং সামরিক বিমান ব্যবহার করে অবৈধ অনেক অভিবাসীকে নির্বাসিত করেছেন। লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানরা বাধ্য হয়েছেন এই অভিবাসীদের নিজ দেশে স্থান দিতে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক এড়াতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ২ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য ও সীমান্তরক্ষী মোতায়েন করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। চোরাচালান বন্ধ করতে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে একই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে মেক্সিকোকে। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর ব্রাসেলসে ট্রাম্পকে নিয়ে বৈঠক হয়েছে। তারা ধারণা করছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনকে দেওয়া সমর্থন প্রত্যাহার করতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। একই সঙ্গে ইউরোপীয় পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে তার। এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে ট্রাম্পের চরিত্র ও ব্যবস্থাপনার কৌশল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন সবাই। আরও কী কী কঠোর পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করবেন—তা এখনই আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের কাছে ২ হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন ভ্রমণ করার আগেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইরানের তেল বিক্রয় রোধে পদক্ষেপ নেওয়ারও ঘোষণা দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পুনর্গঠিত সরকার এবং আগের চেয়েও ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপ্রধান ট্রাম্পকে আমরা এখন এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাচ্ছি। তিনি ঠিক কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেবেন এবং তার নীতিগুলো বিশ্ব রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে—সেসব বিষয়ে আমাদের আগে থেকেই বিচক্ষণ হতে হবে।
ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মূল্য অত্যন্ত চড়া। যদিও তিনি একাধিকবার বলেছেন, তার প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে তিনি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবেন না। তার পরও যারা তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবে বা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, তাদের চড়া খেসারত দিতে হতে পারে।
ট্রাম্পের হাতে অস্ত্র মূলত দুটি। প্রথমটির ধরন অর্থনৈতিক। যেমন—তিনি যত্রতত্র শুল্ক বৃদ্ধি করতে পারেন, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরব দেশগুলোর রপ্তানির পরিমাণ সীমিত। তবে চাইলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আর্থিক সহায়তা বন্ধই করে দিতে পারেন। যদি কোনো আরব রাষ্ট্র তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায়, তবে তার দায়ভার ওই রাষ্ট্রকে একা বহন করতে হবে। কারণ, তিনি মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারেন—এ শঙ্কায় কোনো আরব রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে গিয়ে তার প্রতিবেশীর সঙ্গে অবস্থান নেবে না। অন্য কোনো আন্তর্জাতিক শক্তির কাছ থেকেও বিকল্প সহায়তা এ মুহূর্তে তারা প্রত্যাশা করতে সক্ষম নয়। কারণ, ট্রাম্পের বিরোধিতা করলে সংশ্লিষ্ট সরকার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার অযাচিত মূল্য দিতে হবে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় অস্ত্রের ধরন রাজনৈতিক। স্বভাবতই অন্য দেশগুলোর ওপর পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রভাব বিদ্যমান। তবে এ কথাও সত্য যে, ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো রাষ্ট্র বা সরকারের সম্পর্ক বৈরী হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী শক্তিরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে। যেমন—কোনো আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো গোষ্ঠীগুলো এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। একদিকে তারা দেশের ভেতর থেকে ট্রাম্পবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করবে; অন্যদিকে তারা কৌশলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করার প্রয়াস চালাবে। এর আগে ২০১১ সালে এ কৌশলের দৃষ্টান্ত দেখা গেছে।
যদি ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করতে চায়, তবে ইসরায়েলি সরকারকে অপেক্ষা করতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইরানের আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার দিকে চেয়ে থেকে। আর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে বলা যায়, এই আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন এবং লেভান্ত অঞ্চলে হামাস ও হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায়, ইরানের নেতৃত্ব ট্রাম্পের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে পারে। ইরানের তেল বিক্রির ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় তেহরানের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য সামরিক হামলার হুমকিকেও কাজে লাগাতে চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এমনটা হলে কূটনৈতিকভাবে এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে ইরান।
মধ্যপ্রাচ্যে যে দ্বন্দ্বগুলো চলমান, তার মধ্যে ইরান ও ফিলিস্তিন সংকট যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের জের ধরেই সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও ইয়েমেন সংকটের সূত্রপাত ঘটেছে। সম্প্রতি গাজার ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার কথা বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তার পরিণতি কী হবে—তা ধারণাও করা যায় না।
লেখক: সৌদি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। আল আরেবিয়া নিউজ চ্যানেলের সাবেক পরিচালক এবং আশারক আল-আরেবিয়া পত্রিকার সাবেক সম্পাদক। আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ