কবীর চৌধুরী জাতীয় অধ্যাপক, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক, সংস্কৃতি ও সমাজকর্মী। তিনি ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিলের গোপাইরবাগ গ্রাম। বাবা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ও মা আফিয়া বেগম। কবীর চৌধুরীর বড় ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী ও বোন খ্যাতিমান অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। পারিবারিকভাবে রাখা আবুল কালাম মোহাম্মদ কবীর নামের মানুষটি পরবর্তীকালে কর্মজীবনে কবীর চৌধুরী নামে পরিচিত হন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বপূর্ণ শিক্ষাজীবন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে দেশের নানা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা ছাড়াও কবীর চৌধুরী খাদ্য বিভাগ, লোকপ্রশাসন ইনস্টিটিউট, জনশিক্ষা দপ্তর, জাতীয় পুনর্গঠন দপ্তর, জাতীয় শিক্ষা কমিশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। তিনি ১৯৬৯-৭২ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রধান হিসেবে (পরিচালক) দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সচিব হিসেবে ১৯৭৩-৭৪ সময়ে শিক্ষা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ১৯৯৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক পদে ব্রত হন। দেশের সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সভাপতিও ছিলেন তিনি। কবীর চৌধুরী শুধু একজন লেখকই ছিলেন না। জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে তিনি ভেবেছেন, লিখেছেন। ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন জীবনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের কবিতাকে বিশ্বে পরিচিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অনুবাদ করেছেন। একদিকে যেমন বিদেশি সাহিত্যের অনেক গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন; অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদ করেছেন ইংরেজি ভাষায়। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটি যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে মৌলিক রচনা ও অনুবাদ মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১৭টি। সেইসঙ্গে বেশ কিছু প্রবন্ধ ও অনূদিত গল্প-কবিতা ভারত, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার পত্রপত্রিকা এবং সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। খুব সাধারণ জীবনযাপন করা কবীর চৌধুরী মৃত্যুর আগে পরিবারকে জানিয়েছিলেন, তার জন্য যেন আলাদা কোনো কবরের ব্যবস্থা না করা হয়, যেন সাধারণ কবরেই তাকে সমাহিত করা হয়। নীতি ও আদর্শে অবিচল দৃঢ়চেতা এ মানুষটি আদর্শের প্রশ্নে কখনো ছাড় দেননি। জাতীয় অধ্যাপক অভিধায় ভূষিত হওয়ার আগেই তিনি তিন দশকব্যাপী গণযোগাযোগ ও জনকল্যাণধর্মী কর্মের সুবাদে জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সব ধরনের গণস্বার্থবিরোধী ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তার নির্ভীক সংগ্রাম, সর্বোপরি ১৯৭১ সালে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের হোতা যুদ্ধাপরাধী ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে জোরালো আপসহীন বক্তব্য তাকে সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে এবং তিনি বাংলাদেশের সব সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল আন্দোলনের শীর্ষ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কবীর চৌধুরী মারা যান।