আগেকার দিনে রাজা-বাদশাহরা যখন রাজ্য চালাতেন, তখন তারাই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। তারা প্রজাদের শাসন করতেন। ক্ষেত্র বিশেষে শোষণও করতেন। এক কাজ চলত তাদেরই একান্ত আজ্ঞাবহ উজির-নাজির, পাইক-পেয়াদা, কোর্ট-কাচারি এবং মারণাস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যসামন্ত দিয়ে। রাজাবাহাদুরদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, অহংকারী, দাম্ভিক, যুদ্ধবাজ ও অত্যাচারী। আবার কেউ কেউ ছিলেন শান্তিকামী, বিনয়ী, কল্যাণধর্মী। তারা প্রজাদের প্রতি ভীষণভাবে স্পর্শকাতর ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। ভালো বা মন্দ যা-ই হোন না কেন, সেসব শাসক ছিলেন সব ধরনের আইন-আদালত ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধৃষ্টতার সীমা লঙ্ঘন করে নিজেকে প্রজাদের উপাস্য প্রভু হিসেবে ঘোষণা দিতেও পিছপা হননি। উদাহরণস্বরূপ প্রাচীন মিশরের ফেরাউনের নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কখন, কোন সময়, কোন দেশে, কী ধরনের স্বৈরশাসক জনগণের মাথার ওপর আবির্ভূত হবেন এবং কত দিন তিনি রাজ্য শাসন করবেন সে ব্যাপারে প্রজাদের মতামতের কোনো দাম ছিল না। তাদের করারও কিছু ছিল না। এভাবে মানব ইতিহাসের প্রথম দিকে নিতান্তই রাজা-রাজড়াদের খেয়ালি ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত লক্ষপ্রাণ কাঙালি প্রজাদের জীবনমান। নির্ভর করত হতভাগাদের ভাগ্য।
সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। প্রকৃত ক্ষমতা রাজা-বাদশাহদের হাত থেকে প্রজা সাধারণের হাতে চলে আসতে থাকে। তবে এ পরিবর্তন কোনো জাদুমন্ত্রবলে হঠাৎ একদিনে হয়নি। রাজতন্ত্রের অবসান কোনো কালে কোনো দেশে বিনামূল্যে অর্জিত হয়নি। রাজা-বাদশাহরা জনগণের ক্ষমতা স্বেচ্ছায় এবং বিনা সংঘাতে তাদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুবই বিরল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনগণ দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা, কঠিন সংগ্রাম, সংঘাত, বিপ্লব ও রক্তপাতের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে হটিয়ে গণতন্ত্র অর্থাৎ জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এই সংগ্রামে যুগ যুগ ধরে কত মানুষ যে নির্মম অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যার শিকার হয়েছে ইতিহাসে তাদের কোনো নাম-ঠিকানা লেখা নেই। ব্রিটিশ ইতিহাসে রাজতন্ত্রের অবসানকল্পে অলিভার ক্রমওয়েলের ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং দীর্ঘ সংগ্রাম মানব ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দীপ্যমান। আধুনিককালে বিজ্ঞান, সমাজ ও সভ্যতার এত উন্নতির পর এখনো পৃথিবীতে রাজতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্রের সর্বৈব অবসান হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কোটি কোটি নির্যাতিত মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে আজও নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এ লড়াই এভাবে আর কতকাল চলবে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।
কল্যাণকামী জনগণের শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে গণতন্ত্রও যে একেবারে ত্রুটিমুক্ত ব্যবস্থা, তা কিন্তু নয়। সংক্ষেপে গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা গোষ্ঠী যাতে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে উঠে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা দলের ওপর অন্যায়, অত্যাচার কিংবা একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, তার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনি ভারসাম্যের বিধান রেখে গেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এ ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্য’ ইংরেজিতে যাকে বলা চলে ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যান্ড চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স অব পাওয়ার’। ব্যক্তির তুলনায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা বলতে গেলে অপরিসীম। রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে থাকে প্রচুর টাকা। আইন আদালত। লোকবল। গোয়েন্দা বাহিনী। আধুনিক প্রযুক্তি। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী। গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এই পরিমাণ বিশাল ক্ষমতা ও শক্তি উপভোগ বা প্রয়োগ করে থাকে। একটি সরকার যতই গণতন্ত্রী হোক না কেন, বাস্তবে দেখা যায় এই বলপ্রয়োগে সে সবসময়-ই বাড়াবাড়ি করে থাকে। সময় সময় এই বাড়াবাড়ি জনগণের সহ্যের সীমাও ছাড়িয়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে দার্শনিক লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন, ‘পাওয়ার করাপ্টস, অ্যান্ড অ্যাবসালিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবওসালিউটলি’। অর্থাৎ, ‘ক্ষমতা মানুষকে কলুষিত করে এবং একচেটিয়া ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে কলুষিত করে’। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনো সরকারকে এই দূষিতকরণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখার জন্যে রাষ্ট্রে এবং সমাজে ‘জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্য’ একান্তভাবে প্রয়োজন।
জনগণের জন্যে রাষ্ট্র প্রধানত তিনটি কাজ করে থাকে। প্রথমত, নতুন আইন তৈরি করে এবং পুরোনো আইন পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে। দ্বিতীয়ত, জনগণের কল্যাণে সময়মতো ও স্বল্প ব্যয়ে সরকারের যাবতীয় নীতি ও কর্মসূচির বাস্তবায়ন করে। তৃতীয়ত, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিবাদ-বিসম্বাদের ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করে। প্রথম কাজ করে থাকে রাষ্ট্রের আইনসভা বা ‘লেজিসলেটিভ ব্রাঞ্চ’। দ্বিতীয় কাজটি করে নির্বাহী বিভাগ বা ‘এক্সকিউটিভ ব্রাঞ্চ’ এবং শেষ কাজটি করে বিচার বিভাগ বা ‘জুডিশিয়াল ব্রাঞ্চ’। রাষ্ট্রের এই তিনটি শাখাই স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বা ‘প্রেসিডেন্সিয়াল’ পদ্ধতিতে এই তিনটি শাখা তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অনেক অংশে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বা ‘ক্যাবিনেট ফর্ম অব গভর্নমেন্টে’ এই স্বাতন্ত্র্য ও ভারসাম্য সহজে পাওয়া যায় না। কারণ যে রাজনৈতিক দল বা জোট নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে তারা আপনা আপনিই আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব পেয়ে যায়। ‘জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্যের’ জন্যে এর ফল মোটেও ভালো হয় না। এজন্যে আমার মতে প্রকৃতিগত দিক থেকে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের চেয়ে বেশি গণতন্ত্রী ও কল্যাণকামী।
এ প্রসঙ্গে আমি ইতিহাসের আলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের রাজনীতির একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক আলোচনা করেই আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। আমরা সবাই জানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ‘প্রেসিডেন্সিয়াল’ পদ্ধতির। সোয়া দুইশ বছরের অধিককাল আগে আমেরিকার ‘ফাউন্ডিং ফাদাররা’ তাদের সংবিধানে ‘জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্যের’ যে বিধান রেখে গেছেন, তা আজও অটুট আছে এবং বেশ ভালো ও কার্যকরভাবেই কাজ করেছে। আইনসভায় আছে দুটি কক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ বা ‘হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ’ এবং ‘সিনেট’। এই দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনকে বলে কংগ্রেস। মার্কিন সংবিধান প্রেসিডেন্টকে অনেক নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছে; কিন্তু একচেটিয়া ক্ষমতা দেয়নি। যেমন আইন তৈরি, বাজেট পাস, যুদ্ধ ঘোষণা এবং শাসনতান্ত্রিক পদে পদায়নের ব্যাপারে কংগ্রেসের এক বা উভয় কক্ষের অনুমোদন ছাড়া প্রেসিডেন্ট এসব কাজ করতে পারেন না। আবার প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়া কংগ্রেসে নিছক সাধারণ সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে পাস করা কোনো বিল আইনে পরিণত করতে পারে না এবং তার পক্ষে কোনো বাজেট প্রস্তাবও পাস করা সম্ভব হয় না। এসব বিষয়ে প্রেসিডেন্টের ভিটো পাওয়ার আছে। তবে কোনো বিল বা বাজেটে যদি আইনসভার নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন থাকে, তবে প্রেসিডেন্টের ভিটো আপনা আপনি খারিজ হয়ে যায়।
যে কোনো বিতর্কিত ও জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রতিনিধি পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাওয়া যে কোনো দলের পক্ষে যেমন শক্ত, তেমনি পুরো টার্ম ধরে প্রেসিডেন্ট বা কোনো দলের পক্ষে কংগ্রেসের দুই কক্ষের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাও কঠিন। দৈবক্রমে পেলেও সেটা বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। প্রথমত, প্রেসিডেন্ট এবং আইনসভার দুই কক্ষের সব সদস্যের নির্বাচন একসঙ্গে কখনো হয় না। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট এবং তার সরকার চার বছরের জন্যে ক্ষমতাসীন হলেও প্রতি দুই বছর পর পর হাউস পূর্ণভাবে এবং সিনেট আংশিকভাবে নির্বাচিত হয়। যার ফলে প্রতিটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একদিকে প্রেসিডেন্ট কংগ্রেস এবং অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুই দলের মধ্যে চলে অনবরত রশি-টানাটানি এবং দর-কষাকষি। কেউ কারও ওপর গায়ের জোরে একচেটিয়াভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। দিনের শেষে বিবদমান দুই দলকেই জাতীয় স্বার্থে বাগাড়ম্বর ছেড়ে, দেওয়া-নেওয়ার ভিত্তিতে আপসের পথে আসতে হয়। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এটাই গণতন্ত্রের সফলতা। এটাই তার সার্থকতা।
গণতন্ত্রের এই সুবাতাসের ছোঁয়া বাংলাদেশের মানুষের গায়ে কোনো দিন লাগেনি। প্রথমদিকে অল্প কিছুদিনের মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার এবং তৎপরবর্তী বাকশাল আমলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হলেও সংবিধানে ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যান্ড চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স অব পাওয়ার’ এর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। উনিশ একানব্বই সালের পর ক্যাবিনেট পদ্ধতির সরকার ফিরিয়ে আনা হলেও তথাকথিত ‘রুলস অব বিজনেসের’ কারণে বাংলাদেশে যা হয়েছিল তা হলো, ‘উইনার্স টেক অল। লুজারস গেট নাথিং’। সরকারি দলের হাতে প্রকৃতপক্ষে দল নয়, দলের একনায়ক নেত্রীর হাতে দীর্ঘ পাঁচ বছরের জন্যে আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের একচেটিয়া ইজারা আপনা আপনিভাবে চলে যায়। সরকারি দলের তথা তার এই নেত্রীর বিশাল ক্ষমতার দাপটে বিচার বিভাগও সহজেই কাবু হয়ে পড়ে। সরকার, সরকারি দল, তথা প্রধানমন্ত্রী সব ধরনের জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্যের বাইরে চলে যান। এমতাবস্থায় তার পক্ষে ধরাকে সরাজ্ঞান করা হয়ে ওঠে গরিবের ডাল ভাত।
এই অগ্নিগর্ভ বাস্তবতার মধ্যে গত জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান জন্ম নিয়েছে। এতে শত শত তরুণ-তরুণী, এমনকি শিশুও প্রাণ দিয়েছে। আরও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। জনগণের মনে আশার আলো জ্বলেছে। সবাই ভাবছেন—একটা কিছু হবে। ভালো কিছু হবে। তরুণদের কাছ থেকে দেশ ও জাতি একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা পাবে। অবশ্য এরই মধ্যে গত সাড়ে পাঁচ মাসে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। আমি এখনো আশা ছাড়িনি। দেখা যাক কী হয়।
লেখক: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর, জার্নাল অব ডেভলপিং এরিয়াজ