ধানমন্ডির ঘটনায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়েছেন মেজর (অব.) হাফিজ। দলের ভেতরে এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা রয়েছে। দলের বাইরেও কথা কম নয়। এর মধ্যে কেউ দেখছেন বিএনপির ম্যাচিউরিটি, স্মার্টনেস। কারও কাছে এটি সময়ের চাহিদায় স্ট্যান্ড চেঞ্জ। সময়ের অনিবার্যতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গেও তাদের দূরত্ব কমানোর কিছু মেকানিজম ভেতরে ভেতরে অনেকদূর এগিয়েছে বলে কানাঘুষা রয়েছে
না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, না নাগরিক কমিটি। ৩২ ধানমন্ডিসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে ভাঙচুরের নেতৃত্বে বুলডোজার অ্যাকশনের স্টেকহোল্ডার ‘২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’। নাম হিসেবে এটি নতুন। এতে অংশগ্রহণকারীরাও অচেনা মুখ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কথাবার্তা ও ভূমিকা এর পক্ষে। তবে কোথাও সশরীরে দেখা যায়নি তাদের কাউকে। বিএনপি থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে, ধানমন্ডির ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কী? এটি গণতন্ত্রের পথে বাধা দিতে কারও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অংশ হতে পারে বলে ধারণার কথা জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। এতে ভারতের ইন্ধন থাকতে পারে বলেও সন্দেহ তার।
৫ আগস্ট নিদারুণভাবে বিতাড়নের অর্ধবার্ষিকী ৫ ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনাই প্রকারান্তরে বুলডোজার ডেকে আনলেন। তার প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নসিহত ছিল কথা কম বলার। তা পাগলকে নৌকা না নাড়ানোর আহ্বানের মতো বুমেরাং হয়েছে। শেখ হাসিনা ও তার হিতাকাঙ্ক্ষীদের বরাবরই উপলব্ধি মুখ কম চালালে শেখ হাসিনার ঝামেলা কম হতো। বাস্তবে এগুলো কথার কথাতেই থেকেছে। শেখ হাসিনা পতনের পর মুখ আরও বেশি চালাচ্ছেন। চট করে যে কোনো সময় চলে আসা, জিরো পয়েন্টে নেতাকর্মীদের জড়ো হওয়া, ৩২ নম্বরের দিকে যাত্রা করা ইত্যাদি হালকা কথায় বারবার গন্ডগোল পাকিয়েছেন। নতুন করে আবারও পাকাতে গেলেন ৫ ফেব্রুয়ারি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দলে দলে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা জড়ো হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। এরপর বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে রাত ৮টা নাগাদ ভবনটির গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে তারা। এর আগে, জাতীয় নাগরিক কমিটির ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়, ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল করা হবে। সেখানে বলা হয়, হাজারো ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই খুনি হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার প্রতিবাদে ‘২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার’ উদ্যোগে রাত ৯টায় এ কর্মসূচি পালিত হবে। তার আগে টানা ৩৬ দিন কোটা সংস্কারের প্রবল গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতের উদ্দেশে যাওয়ার খবরের কয়েক ঘণ্টা পর গণভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার মানুষ।
ওইদিন রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় শেখ মুজিবের বেশ কিছু ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর বিকেল ৪টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। একই সময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ভবনের সামনের দিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশে রাখা তার প্রতিকৃতিও। ঘটনার ওজন বিচারে ৫ আগস্টের সঙ্গে ৫ ফেব্রুয়ারির তুলনা খাটে না। আবার প্রেক্ষিতও ভিন্ন। শেখ হাসিনার সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আত্মদান করেছেন, শেখ হাসিনা তাদের অপমান করেছেন। শহীদের মৃত্যু সম্পর্কিত অবান্তর, আজগুবি ও বিদ্বেষমূলক কথা বলে পলাতক শেখ হাসিনা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অবজ্ঞা করেছেন। দ্বিতীয়ত শেখ হাসিনা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অমানবিক প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালে যে সুরে কথা বলতেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরও তিনি একই হুমকিধমকির সুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন, হুমকি দিচ্ছেন।
মানুষের মনে জুলাই গণহত্যা নিয়ে যে ক্ষত রয়েছে, তাতে শেখ হাসিনা একের পর এক আঘাত করে চলছেন বলে উল্লেখ রয়েছে সরকারের বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি শেখ হাসিনা বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে এ বিষয়ে একটি প্রোটেস্ট লেটারও ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বুধবার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণের প্রতিবাদ জানিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে লেটারটি ধরিয়ে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনার বক্তব্য শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে না নেওয়ায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পররাষ্ট্র উপদেষ্টার। ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে দেওয়া প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্য দেওয়া থেকে শেখ হাসিনাকে বিরত না রাখলে দুই দেশের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে না।
সরকারের এসব প্রকাশনার মাঝে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে তাকত (সক্ষমতা)-এর কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। বলেছেন, মূর্তি না ভেঙে শত্রুর শক্তির বিপরীতে পাল্টা চিন্তা, শক্তি ও কর্তৃত্ব গড়ে তুলতে। ‘গড়ার তাকত আছে আমাদের’ শিরোনামে তিনি লেখেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিছক কিছু মূর্তি বা দালান নয়। ভাঙার প্রকল্প থেকে সরে এসে দিনকে দিন গড়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত। মাহফুজ বলেন, লীগ বা হাসিনা সে অর্থে কিছুই না, বরং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের সম্প্রসারণ। ভাঙার পরে গড়ার সুযোগ এসেছে, কিন্তু অনন্ত ভাঙা প্রকল্প ভালো ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবহ না। গড়ার প্রকল্পগুলো খুব দ্রুতই শুরু ও বাস্তবায়ন হবে। সবাইকে গড়ার কাজে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন শিগগির শুরু হবে। আহত ও নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসন ও জুলাই গণহত্যার বিচারের কাজও চলমান। এ মাসেই এ কাজগুলো আরও গতি পাবে। খুনি হাসিনার বক্তব্য প্রচার এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ দায়ী থাকবে বলেও মন্তব্য করেন মাহফুজ আলম।
এর বাইরে ‘উৎসব হোক!’ লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেদের অবস্থা জানান দিয়েছেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে দুই শব্দের এ স্ট্যাটাসটি দেন তিনি। তবে এ স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তা পরিষ্কার নয়। সেটি পরিষ্কার হয়েছে এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহর স্ট্যাটাসে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।’ এ দুয়ের মধ্য দিয়ে ‘২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’র ধানমন্ডি ৩২-এ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণার একটি সংযোগ রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য বাড়তি উপাদান যোগ করেছে। তিনি বলেছেন, আগে শত্রু মনে হতো একটা, এখন মনে হচ্ছে চতুর্মুখী।
নাহিদের এমন মন্তব্যের নানা বিশ্লেষণ চলছে। বড় দল বিএনপির প্রতি বক্তব্যটিতে বড় রকমের খোঁচা রয়েছে। এর আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়েছে নাহিদসহ সমন্বয়কদের। এর একটা ফয়সালা হলেও বিএনপির জন্য তা অ্যালার্মিং। বিএনপিও এরই মধ্যে নিজেদের আপডেট করছে। স্ট্যান্ড চেঞ্জও করছে। তারা আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ চাচ্ছে না। আবার আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে দিতেও নারাজ। জনগণ আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করায় তারা আর আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি করতে পারবে না বলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনার ঝড় তুলেছে। কথাটি তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন।
বাংলাদেশের মানুষ গণঅভ্যুত্থান, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের বিতাড়ন করেছে। সেই আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ নামে আর রাজনীতি করতে পারবে না—তার এমন কয়েকটি বাক্যের নানা অর্থ হচ্ছে রাজনীতির বিভিন্ন মহলে। আবার বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নির্ধারণের আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। বিএনপি সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের ব্যবস্থা চেয়েছে বলে তথ্য দেন সালাহউদ্দিন। আওয়ামী লীগকে নিয়ে সরকার দ্বিচারিতা করছে বলেও অভিযোগ তার। সেখানে এখন ধানমন্ডির ঘটনায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়েছেন মেজর (অব.) হাফিজ। দলের ভেতরে এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা রয়েছে। দলের বাইরেও কথা কম নয়। এর মধ্যে কেউ দেখছেন বিএনপির ম্যাচিউরিটি, স্মার্টনেস। কারও কাছে এটি সময়ের চাহিদায় স্ট্যান্ড চেঞ্জ। সময়ের অনিবার্যতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গেও তাদের দূরত্ব কমানোর কিছু মেকানিজম ভেতরে ভেতরে অনেকদূর এগিয়েছে বলে কানাঘুষা রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন