খালেদ আবু জাহের
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৪৯ এএম
আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উত্তর মেরু অঞ্চল কি ভূরাজনীতির কেন্দ্র হতে যাচ্ছে

উত্তর মেরু অঞ্চল কি ভূরাজনীতির কেন্দ্র হতে যাচ্ছে

গত ২০ বছরে রাজনৈতিক আলোচনার আসরে উত্তর মেরু অঞ্চল বারবার উঠে এসেছে। বরফ গলার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নৌপথ উন্মোচনের সম্ভাবনা তুলে ধরে লেখা হয়েছে অসংখ্য প্রতিবেদন। বৈশ্বিক অর্থনীতির বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার নতুন দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে এ অঞ্চলে। ধারণা করা হচ্ছে যে, সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে আর রাশিয়ার কৌশলগত ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এই নতুন নৌপথ। তবে এর কোনোটারই বাস্তব রূপ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

নৌপথ ঠিক কতদিনে ব্যবহার উপযোগী হবে, তা এখনো ঠাহর করা যাচ্ছে না। বছরের কোন সময়টা অবধারিত পথে বরফের পরিমাণ কম থাকবে, তা না জেনে যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো নকশাও তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। গবেষকদের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ বরফের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে বারো মাসব্যাপী ব্যবহারযোগ্য পথ উন্মোচিত হবে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক অন্যান্য পূর্বাভাসের মতো এই পূর্বাভাসেও সম্পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত নয়, কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায়, তা হলো, নিকট ভবিষ্যতে পূর্বাঞ্চলে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে রাশিয়ার পুনরুত্থান ঘটতে চলেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বা নৌপরিবহনের নতুন পথ আবিষ্কার নয়; বরং আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার কর্মতৎপরতাই মূলত বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রকে এই অঞ্চলের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। তিন বছর ধরে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার বৈদেশিক নীতিতে আগ্রাসী মনোভাবের উদ্রেক ঘটিয়েছে। উত্তর মেরু অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য রাশিয়া এখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর রাশিয়ার পাশাপাশি আরও এক পরাশক্তি এই অঞ্চলে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে—চীন। বেশ কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্পর্ক বজায় ছিল। মহাকাশ প্রকল্পের মতো তাদের উত্তর মেরুবিষয়ক নীতিতে সহযোগিতামূলক আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেই নীতিতে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এই পরিবর্তন কী রূপ ধারণ করবে, তা আন্দাজ করা দুষ্কর।

উত্তর মেরু অঞ্চলে সামুদ্রিক সীমানা আছে এমন পাঁচটি দেশ হলো কানাডা, ডেনমার্ক, নরওয়ে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে চীন হলো উত্তর মেরু অঞ্চলের নিকটবর্তী রাষ্ট্র। চীন আর রাশিয়া এমনিতেই মিত্র শক্তি। কাজেই এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার মনোভাব এবং সংলাপের আগ্রহ স্পষ্টতই দৃশ্যমান। বরফজনিত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও উত্তর মেরু দিয়ে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাকে সরাসরি নৌপথে সংযুক্ত করা সম্ভব, তাই ভৌগোলিকভাবে নিঃসন্দেহে এই অঞ্চল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

তবে কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগই নয়, এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। অনুমান করা হয় যে, সম্পূর্ণ বিশ্বের মোট ১৩ শতাংশ অনাবিষ্কৃত তেল আর প্রায় ৩০ শতাংশ আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এই অঞ্চলে বিদ্যমান। তদুপরি বিরল খনিজ উপাদান যেমন নিকেল, প্লাটিনাম, স্বর্ণ এবং হীরকের বিশাল ভান্ডার রয়েছে এই অঞ্চলে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নের খাতিরে এই সম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘের একটি কনভেনশন দ্বারা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সমুদ্রসীমা এবং তাদের একচেটিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে রাশিয়া ও কানাডার মতো কিছু দেশ জাতিসংঘের কাছে ভূতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের দাবি উত্থাপন করেছে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাশিয়া সোভিয়েত আমলের ৫০টি আর্কটিক সামরিক ঘাঁটি ফের সচল করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৩টি বিমানঘাঁটি, ১০টি রাডার স্টেশন এবং ২০টি সীমান্ত চৌকি। অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, মস্কো নতুন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিশেষ সামরিক ব্রিগেড মোতায়েন করেছে। উপরন্তু রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম বরফভেদী নৌবহরের অধিকারী, যার মধ্যে পারমাণবিক শক্তিচালিত জাহাজও রয়েছে।

এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালে থুল বিমানঘাঁটিকে পিটুফিক মহাকাশ ঘাঁটিতে রূপান্তর করে এবং উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে তাদের দ্বিতীয় নৌবহরের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে। অন্যদিকে কানাডা, নরওয়ে এবং ডেনমার্কও উত্তর মেরু অঞ্চলে তাদের নিরাপত্তা জোরদার করেছে, যদিও তা রাশিয়ার সমপর্যায়ে নয়।

চীনও বরফভেদী জাহাজ মোতায়েন করেছে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। চীনা সরকার রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে আর্কটিক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তবে চীনের মহাকাশ প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পও দ্বৈত-উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। আর্কটিক অঞ্চলের পরিকাঠামো এবং নৌবহর পরবর্তী সময়ে সামরিক রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গ্রিনল্যান্ডকে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহের একটি মূল কারণ এটি। রাশিয়া-চীন জোটের মোকাবিলা করা কেবল ইউরোপের পক্ষে সম্ভব নয়। বেইজিং আর মস্কোর মধ্যে আর্কটিক এলাকাভিত্তিক কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব এককভাবে তাদের হাতে চলে যাবে। গ্রিনল্যান্ডকে নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনা পছন্দ না হলেও, ডেনমার্ক ও ইউরোপ এ বিষয়ে অবগত যে, রাশিয়া-চীন জোটকে প্রতিহত করতে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন।

ডেনমার্ক ও নরওয়ের সামরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে ন্যাটো। কিন্তু এ দুটি দেশই তাদের জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করে থাকে, যা কেবল ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৫ শতাংশ লক্ষ্যমানের চেয়েই কম নয়। একই সঙ্গে ন্যাটোর বর্তমান ২ শতাংশ লক্ষ্যমানের চেয়েও কম। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কৌশলগত সুবিধাগুলোর একটি হলো, এর ভূখণ্ড কখনো বহিরাগত আক্রমণের শিকার হয়নি। তাই দুটি বিশ্বযুদ্ধের দরুনই যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে পর্যাপ্ত সাহায্য পাঠাতে সমর্থ হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য দেশের ওপর যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে উত্তর মেরু অঞ্চলে রাশিয়া আর চীনের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলগত সুবিধা ক্ষুণ্ন হতে পারে। সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর সীমান্ত দিয়ে তার ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারে। আবার একই পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। এজন্য পানামা খালের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরাবরই আগ্রহ প্রকাশ করে আসছেন।

স্নায়ুযুদ্ধের শেষের দিকে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বরফভেদী জাহাজগুলো দুই দেশের মধ্যে নবপ্রতিষ্ঠিত সহযোগিতার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। আর্কটিক অঞ্চলে বরফের মধ্যে আটকে যাওয়া তিনটি তিমি মাছ উদ্ধারে তাদের সম্মিলিত প্রয়াসের ঘটনা সমগ্র বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষিত করেছিল। ‘অপারেশন ব্রেকথ্রু’ নামে পরিচিত এই অভিযানকে পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রে রূপায়িত করা হয়। তবে বিশ্বজুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাত আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় আর্কটিক অঞ্চল নতুন করে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠছে। স্থায়ী বাণিজ্যিক পথ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হোক বা না হোক, এই অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা যায়। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা এলে তবেই বোঝা যাবে, উত্তর মেরু অঞ্চল থেকে শুরু করে মহাকাশ ক্ষেত্র পর্যন্ত কোন জায়গায় কী ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী হবে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো।

লেখক: আল-ওয়াতান আল-আরাবি সাময়িকীর সম্পাদক।

ইউরেবিয়া মিডিয়া কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং মহাকাশবিষয়ক বিনিয়োগ সংস্থা স্পেসকোয়েস্ট ভেঞ্চারসের প্রতিষ্ঠাতা। নিবন্ধটি আরব নিউজ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঈদ বোনাসসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ

কুষ্টিয়ায় ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে সাব-রেজিস্ট্রার অবরুদ্ধ

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন আন্তোনিও গুতেরেস

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠক

বাড়িতে একা পেয়ে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা, আটক ১

ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে ইউক্রেনে শান্তি প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ

যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে দাবিনামার তালিকা পেশ রাশিয়ার

মুহূর্তেই শেষ পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের ১৫ হাজার টিকিট

চাকরি দিচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট, বেতন লাখের ওপরে

সাবেক এমপি আবু জাহিরসহ ৪০ জনের নামে মামলা

১০

দুপুরের মধ্যে দেশের যেসব জায়গায় বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে

১১

বিআরডিবির অর্থ কেলেঙ্কারি / আ.লীগ নেতার ১১ বছর জেল, জরিমানা ৩১ লাখ টাকা

১২

ট্রেনে ঈদযাত্রার অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু 

১৩

শুয়ে ফোন ঘাঁটছিলেন যুবক, তখনই হাজির চিতাবাঘ

১৪

এসির ভেতর বাসা বেঁধেছে সাপ, পরিষ্কার করতে গিয়ে হতবাক যুবক

১৫

কেমন থাকবে আজ ঢাকার আবহাওয়া

১৬

সোনারগাঁয়ে ‘পাঁচ’ বছরের শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা, অভিযুক্তকে গণধোলাই

১৭

বায়ুদূষণে শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার কী পরিস্থিতি?

১৮

১৪ মার্চ : ইতিহাসের এই দিনে যা ঘটেছিল

১৯

১৪ মার্চ : আজকের নামাজের সময়সূচি

২০
X