যতই দিন যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার যেন তত বেশি বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। এক মাসেরও বেশি সময়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করতে না পারা, সংস্কার কর্মসূচির শম্বুকগতি, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐকমত্যের অভাব—জনমনে অনিশ্চয়তা ও সংশয়ের কুয়াশার জাল বিস্তার করছে। এ পরিস্থিতিতে জুলাই গণহত্যার বিচার এবং নজিরবিহীন দুর্নীতির জন্য পতিত স্বৈরাচারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, তার সহযোগী, মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের বিচার অনুষ্ঠান কতটা সম্ভব হবে, সে প্রশ্ন বেশ জোরেশোরেই উঠছে। অথচ ফ্যাসিবাদি শাসনের পুনরুত্থান রুখতে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ও মদদে সংঘটিত দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করা একান্তই জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারকেই এ বিচারের বিষয়টি নিশ্চিত করে যেতে হবে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস অতিবাহিত না হতেই জুলাই অভ্যুত্থানের লাল রং ফিকে হতে শুরু করেছে, এমনটাই বলাবলি হচ্ছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আসন্ন রাজনৈতিক দল গঠনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও সমমনাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে বিতর্ক তুঙ্গে উঠছে, ছড়াচ্ছে উত্তাপ।
রাজধানী রাজপথ বিশেষ করে শাহবাগ, প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ, সচিবালয় মোড়, মহাখালী প্রতিদিনই অবরোধের কবলে পড়ছে। চাকরি জাতীয়করণ, কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরসহ এন্তার দাবিদাওয়া নিয়ে যার যখন খুশি সড়কে বসে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ উপেক্ষিত হচ্ছে। একদল দাবি পূরণের আশ্বাস পাওয়ার পরপরই আরেক দল দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। দাবি আদায়ের জন্য অস্ত্র হিসেবে তারা সড়ক অবরোধ করছে, ট্রেন থামিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি রেলওয়ের রানিং স্টাফরা সারা দেশে রেলের চাকা বন্ধ করে দিয়ে দাবি আদায় করে। এসব দাবিদাওয়ার আন্দোলন সামাল দিতে সরকার যেন দিশেহারা। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা বিভিন্ন বিষয়ের সংস্কার এবং নির্বাচন আয়োজনের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হচ্ছে, অক্টোবরের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা তৈরি থাকবে। তবে নির্বাচন ডিসেম্বরে নাকি আগামী বছরের প্রথমার্ধে হবে—সেই সিদ্ধান্ত সরকারের, কমিশন এরকমই জানিয়ে রাখছে। অথচ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় যেসব সংস্কার জরুরি, তা যেন কিছুতেই গতি পাচ্ছে না। সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ ও দুদক সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে তাদের সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ। আগের যে চারটি বিষয়ে সংস্কার প্রতিবেদন জমা পড়েছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় এখনো বসতে পারেনি সরকার। জমা পড়া প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনের অনেক সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনের আপত্তি ও মতভিন্নতা আছে। বর্তমানে রাজনীতির ময়দানের প্রধান দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো থেকে বারবার দাবি জানানো হচ্ছে, সরকার যেন সংস্থার প্রস্তাব নিয়ে দ্রুত তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। নির্বাচনের জন্য যতখানি সংস্কার দরকার হবে, তা করতে হলেও রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিকল্প নেই। অথচ সরকার দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না এবং কালক্ষেপণ করছে বলে তারা অভিযোগ করছে। তাদের জোর অভিযোগ হচ্ছে যে, গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের দল গঠনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই অন্তর্বর্তী সরকার সময়ক্ষেপণের নীতি নিয়েছে।
এই অবস্থার মধ্যে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে রাজনৈতিক দলগুলো সন্দেহের চোখে দেখছে। প্রফেসর ইউনূস সেখানে বলেছেন, ‘পরিস্থিতির প্রয়োজনে ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার। তারা দেশ জুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে।’ প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোস সফর করেন। সেখানে তিনি ফিন্যন্সিয়াল টাইমসের প্রধান পররাষ্ট্র ভাষ্যকর গিয়েডেন রেসম্যানের উপস্থাপনায় পডকাস্টে অংশ নেন। ওই পডকাস্টের কথোপকথন পরে লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়। প্রফেসর ইউনূস পডকাস্টে বলেন, ‘তরুণরা সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে সংস্পর্শ নেই বা নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাও নেই। পরিস্থিতির প্রয়োজনে তারা রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার। কারণ রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদের রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো সেসব ব্যক্তি নিয়ে যাবে, যারা বিগত প্রশাসন ও অন্যদের মতো সবকিছুর পুনরাবৃত্তির সুযোগ খুঁজছে। এটাই বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ। সুতরাং তারা এটা রক্ষার চেষ্টা করছে।’
প্রধান উপদেষ্টার এসব বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে গুঞ্জন তৈরি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক দল গঠন এবং তারা সংগঠিত না হওয়া পর্যন্ত কি সংস্কার প্রক্রিয়া থেমে থাকবে? জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, চলতি মাসেই তাদের রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে।
এদিকে সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে রাজনৈতিক দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের আলোচনা শুরু না হওয়া এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের ঘোষণা না আসার মধ্যেই পতিত সরকারের কিছু কিছু সুবিধাভোগী ও সমর্থক নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার আগেই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত দলটির প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা শুরু হয়েছে। সরকারি কলেজের শিক্ষক পর্যন্ত লিফলেট বিতরণে নেমে পড়ছে। দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় ঝটিকা মিছিল করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ। কোথাও কোথাও দেয়ালে শেখ হাসিনা ও নৌকার ছবি সংবলিত পোস্টার লাগানো হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে ইউটিউব এবং সামাজিকমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সোমবার এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সহযোগীরা বিশৃঙ্খলা উসকে দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে।’ প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেন। প্রফেসর ইউনূস জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেন।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতা। আবার গণহত্যা ও দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই এদেরও অনেকে পালিয়ে যান। পরবর্তী বিভিন্ন সময়েও অনেকে পালিয়ে গেছেন। তাদের পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারও কারও সহযোগিতা ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি গণহত্যার সঙ্গে জড়িত বা নির্দেশদাতা। চিহ্নিত অনেক বড় ধরনের দুর্নীতিবাজও বিদেশে পালিয়ে গেছেন। কীভাবে তারা পালাল, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত সেই বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি। গণহত্যা ও দুর্নীতির দায়ে চিহ্নিত এসব ব্যক্তিকে আদৌ দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনা যাবে কি না, সে বিষয়ে অনেকেরই ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। এরা বড় ধরনের দুই অপরাধের দোষী প্রমাণিত হলেও হয়তো শেষ পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হবে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকবে—এটাই প্রত্যাশিত। নিরপরাধ কেউ যেন শুধু রাজনৈতিক কারণে সাজা না পায়। কারণ দেশে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, জাতীয় নেতা ও বামপন্থি দলের নেতাদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়েও কম রাজনীতি হয়নি। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার অনেক মামলার দুর্বলতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো হত্যা মামলায় ৫০ থেকে ২৮১ জনকে পর্যন্ত আসামি করা হয়েছে। এসব মামলা নিয়ে একশ্রেণির মামলাবাজ রীতিমতো বাণিজ্য করছে। এসব মামলাবাজের সঙ্গে কোথাও কোথাও পুলিশের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে।
গণহত্যায় নিহতদের পরিবারে এখনো নীরব কান্না চলছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাত, পা ও চোখ হারানোদের আর্তনাদ কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না। আগামী দিনের রাজনীতিতে হত্যা, গুম-খুন, আয়নাঘর যাতে আর কখনোই ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। আর প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরই এই দায়িত্ব পড়েছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক