বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১
ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৩ এএম
আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কথা কেউ শোনে না

খাল গালিচায় লাল বিপ্লব

খাল গালিচায় লাল বিপ্লব

পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তির ছিল দুই স্ত্রী। একজন স্বামীর বয়সের কাছাকাছি। অন্যজন অপেক্ষাকৃত তরুণী। কাঁচা-পাকা চুলের ওই লোক স্ত্রীদের সঙ্গে পালাক্রমে ঘুমাতেন। দ্বিতীয় স্ত্রী তার পাকা চুল তুলে দিতেন। আর বড় স্ত্রী সুযোগ পেলেই কাঁচা চুল তুলতেন। দুজনই স্বামী অন্তপ্রাণ। নিজ নিজ রুচি, শিক্ষা ও প্রয়োজন বিবেচনায় ভালোবেসে কাজটি করতেন তারা। এতে এক সময় স্বামী বেচারার মাথাটি চুলশূন্য টাকে পরিণত হয়। পরিণতি দেখে আফসোস হলেও কেউ অনুতপ্ত হননি। দুই স্ত্রীই মনে করেন, তারা নিজ নিজ অবস্থানে সঠিক। কোণঠাসা স্বামী যেন বাংলাদেশের অসহায় জনগণ। স্বস্তিতে থাকতে অশান্তি এড়িয়ে চলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক বিভিন্ন বাহিনী, রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক গ্রুপ, সুশীল সমাজ, সামাজিক সংগঠন নিজেদের মতো করে দেশ গড়ে তুলতে দিনরাত এক করে ফেলছেন। তাদের অদম্য চেষ্টায় মাঝেমধ্যে সাধারণ মানুষ দমবন্ধ পরিস্থিতিতে পড়ছেন। সবাই দাবি করেন, জনগণ তাদের পক্ষে রয়েছেন। জনতার কথা বলে প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষ তৈরি করছেন তারা। এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যেও বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে। তারা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ ভাবছেন। দীর্ঘ আন্দোলনের ভুক্তভোগী বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দলের মধ্যে বাড়ছে সন্দেহ-অবিশ্বাস। রাষ্ট্র পরিচালনায় আছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রতিনিধি। আবার সরকারের সক্ষমতা নিয়ে ক্ষোভ জানাচ্ছেন তাদের সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সুচিকিৎসার দাবিতে জুলাই বিপ্লবে আহতদের রাতদুপুরে প্রধান উপদেষ্টার বাড়ি ঘেরাও করতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে লাল গালিচায় খাল খননের দৃশ্য দৃষ্টিকটু মনে হয় মানুষের কাছে।

গত রোববার রাজধানীর মিরপুরে বাউনিয়া খাল সংস্কার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তিন উপদেষ্টা। অতিথিরা লাল গালিচায় হেঁটে খালে নামেন এবং ভাসমান এক্সক্যাভেটরে উঠে কাজের সূচনা করেন। এ নিয়ে দিনভর সমালোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার ও কার্যক্রম নিয়ে নিষ্ঠুর ট্রল করেন অনেকে। গণমাধ্যমেও বেশ গুরুত্ব দিয়ে এ খবর ছাপা হয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘যেখানে ভাসমান এক্সক্যাভেটর রাখা হয়েছে, তা কোনো স্থায়ী পন্টুনে স্থাপিত নয়। এ ছাড়া এক্সক্যাভেটরে ওঠার রাস্তাটি অনেক ঢালু ও কাদা মাটির। এক্সক্যাভেটরের ফ্লোর পিচ্ছিল থাকায় অতিথিদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত এবং চলাচল এলাকা দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে একটি লাল রঙের কার্পেটসদৃশ ম্যাট ব্যবহার করা হয়েছে। এটি কোনো আনুষ্ঠানিক লাল গালিচা নয়। নিরাপত্তার স্বার্থে রাখা একটি ব্যবস্থা।’ কর্তৃপক্ষের এ ব্যাখ্যার আগেই এ নিয়ে নানা পক্ষ মাঠ গরম করে ফেলেছে। এর সংগত কারণও আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো রুটিন ওয়ার্কেও সফলতা দেখাতে পারেনি সরকার। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা পাহাড়সমান। এ ছাড়া, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। কিন্তু তার অন্ধ অনুসারীরা সক্রিয় রয়েছেন প্রশাসন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পান থেকে চুন খসলেই অন্তর্বর্তী সরকারের দফারফা করে ছাড়বেন তারা। এ কথা সবাই জানে। তার পরও সরকারের আমলানির্ভর বিভিন্ন উদ্যোগে শৈথিল্য দেখা যায়। সমালোচনামুখর জাতির হাতে খোরাক তুলে দিলে কিছুটা তো সহ্য করতেই হবে।

এদিকে, গত রোববার বিকেলে পাবনার সুজানগর পৌর এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওহাবকে তার সমর্থকরা পুলিশি হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নেয়। এতে পুলিশের আট সদস্য আহত হয়েছেন। আব্দুল ওহাব ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় একাধিক মামলার পলাতক আসামি। পুলিশের ওপর হামলার প্রতিবাদে উপজেলা বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা পৃথক পৃথক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। এ ঘটনা একই সঙ্গে হাস্যকর এবং ভয়ংকর। গত দেড় দশক ধরে পুলিশি নির্যাতনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী মতের মানুষ। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের বর্বর হামলা পাকিস্তানি বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। অমানবিক আক্রমণে পুলিশের হাত থেকে পুলিশের সন্তানও রেহাই পায়নি। শিশু-কিশোর হত্যায় নাৎসি বাহিনীর বদনাম কামিয়েছে আওয়ামী ভাবাদর্শের পুলিশ। সেই পুলিশকে আক্রমণ করে আসামি ছিনতাই করছে আওয়ামী লীগ। আর পুলিশের পক্ষে বিক্ষোভ করছে বিএনপি-জামায়াত। সত্যি সেলুকাস! যদিও কোনো আক্রমণই গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশ রাষ্ট্রের, কোনো দলের নয়—এসব আপ্তবাক্য প্রণিধানযোগ্য এবং প্রচলিত। তবু মানুষ সন্দেহ করে। ক্ষমতায় যেতে বা অংশ হতে পুলিশ তথা সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতসহ আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলো। কিন্তু পুলিশ কতটা রাষ্ট্রের বা জনগণের বন্ধু হতে পেরেছে? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রশ্নটি আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পুলিশের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি-চুরি-ছিনতাই বেড়েছে। গণমাধ্যম ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সে কথাই লেখা হচ্ছে। দিনদুপুরে আসামি ছিনতাই! কোনো স্বাভাবিক সময়কে নির্দেশ করে না। তাও আবার পরাজিত শক্তির প্রতিনিধি! নিখোঁজ আওয়ামী লীগ এত সাহস পায় কীভাবে। কতটা জনপ্রিয় নেতা হলে এই সময় কর্মীরা এত বড় ঝুঁকি নেয়! এসব ভাবা দরকার ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল বা গোষ্ঠীর। তারা প্রতিনিয়ত বলছে, ‘আওয়ামী লীগ চিরতরে হারিয়ে যাবে। ওই নামে আর রাজনীতি করা যাবে না। তাদের কোনো কর্মসূচি করতে দেওয়া হবে না। অন্তত আগামী ২০ বছর রাজনীতিতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’ বাস্তবতা বিবেচনায় এসব উক্তি তেমন কোনো জনভক্তি অর্জন করতে পারবে না। জনগণের মনে দৃঢ় ভিত্তি গড়তে না পারলে সবকিছু ভেসে যাবে খালের জলে।

শুধু পুলিশ নয়, কী করছে যৌথ বাহিনী! সম্প্রতি কুমিল্লায় গভীর রাতে বাড়ি থেকে যৌথ বাহিনীর হাতে আটক তৌহিদুল ইসলাম নামে এক যুবদল নেতার মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক। পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতনের কারণে তিনি মারা গেছেন। স্বজনরা জানান, একই এলাকার ফজলু মিয়ার ছেলে তানজিম আহমেদের সঙ্গে তৌহিদের জমি নিয়ে ঝামেলা ছিল। তাদের অভিযোগ, তানজিমরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে যৌথ বাহিনীকে তৌহিদের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করছে। যখন যৌথ বাহিনী তৌহিদকে আটক করে নিয়ে যায়, তখন সঙ্গে ছিল আরেক স্থানীয় রহমত আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম। তারাই যৌথ বাহিনীকে দিয়ে তৌহিদকে হত্যা করেছে বলে গণমাধ্যমকে জানান। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে গুম ও হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। সেইসঙ্গে যৌথ বাহিনীর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার দাবি তুলে ধরে সংগঠনটি বলে, ‘বছরের পর বছর আমরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়েছি। ছাত্র-জনতা রক্ত ঢেলেছে। তবু কেন নিরপরাধ মানুষ এভাবে প্রাণ হারাবে? কেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবে?’

খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিরুদ্ধে গুম, খুন, অপহরণের অভিযোগ ছিল। রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বিরোধী মত দমনে ব্যবহার করা হতো। সেই সুযোগে কতিপয় সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তা খুনে ভাড়াটে দল বানিয়ে ফেলেছিল দেশপ্রেমিক বাহিনীগুলোকে। তার খেসারত এখন দিচ্ছে রাষ্ট্র। কারাবন্দি অথবা পলাতক জীবন কাটাচ্ছেন সেসব উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তা। এখনো কি যৌথ বাহিনীকে কেউ ব্যবহারের ধৃষ্টতা দেখাতে পারে? সংস্কার চলছে দেশের সর্বত্র। অথচ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‍উন্নতি নেই। বিপ্লবোত্তর আশার আলো ফিকে হয়ে আসছে। হতাশার কালোয় নিমজ্জন ঠেকানো জরুরি।

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় নয়। সড়কে গণপরিবহনের নৈরাজ্য শুধু হাতবদল হয়েছে। এসব কথা বিভিন্ন সময় সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা এবং সমন্বয়করা বলে থাকেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখে এসব কথা শুনে বিরক্ত হন লোকজন। তাদের সমাধানের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু সমস্যার কথা বলে বাণী দেওয়ার জন্য নয়। গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিকতা দ্বারা পরিচালিত হলে ফলাফল হবে তথৈবচ। খাল খননের আয়োজনে কোনো বাস্তব বুদ্ধিদীপ্ত আমলাতন্ত্র কাজ করেনি। দেশি-বিদেশি হাজারো চোখ দেখছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ। কী হলে কী হবে, ভাবতে হবে। অথর্ব, গতানুগতিক এবং গত সরকারের দোসর আমলা-পুলিশ নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। যে কোনো ভুক্তভোগীই এ কথা বিশ্বাস করে। পরিষ্কার ধারণা নিয়ে প্রশাসনের খোলনলচে সংস্কার করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। লাল গালিচার সম্মান ধরে রাখতে হবে। খালে বিসর্জন দিলে চলবে না। বিপ্লবের লাল রং উজ্জ্বল রাখতে যত্ন নিতে হবে নবচেতনার।

লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গোষ্ঠীর ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ

স্বামীর কবর দেখতে গিয়ে ‘মারধরের’ শিকার জুলাই শহীদের স্ত্রী

বিএনপি কারো কাছে মাথা নত করেনি, করবে না : এ্যানী

ঈদে মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রই আর টিকবে না’

চাঁদপুরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া

ঈদ মিছিল নিয়ে হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি

সিলেটে মধ্যরাতে বিএনপি-যুবদল সংঘর্ষ

প্রতারণার শিকার জবি শিক্ষার্থীর পাশে ছাত্রদল নেতা

১০

৩২ শহীদ পরিবারের সঙ্গে জামায়াত আমিরের ঈদ উদযাপন

১১

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের চেষ্টা প্রকৌশলী হাবিবের

১২

৩ যুগ ইমামতি শেষে রাজকীয় বিদায়

১৩

আমরা একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই : ডা. শফিকুর রহমান

১৪

রুনা লায়লাকে নিয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে যে কথা হয়েছিল শাহবাজ শরিফের

১৫

চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত

১৬

সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চাওয়া ফ্যাসিবাদের অংশ : সারোয়ার তুষার 

১৭

আজ থেকে সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু

১৮

ইন্ডিয়া টুডেকে মাহফুজ আনাম / ‘বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, ছাত্রদের অনাগ্রহ, অস্পষ্টতায় জামায়াত’

১৯

কেউ আ.লীগকে পুনর্বাসিত করতে পাববে না : হান্নান মাসউদ

২০
X