তছলিম উদ্দিন খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, এসএমসি। তিনি সুপরিচিত জনস্বাস্থ্য পেশাদার হিসেবে। তার রয়েছে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য কর্মসূচির নকশা, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়নের বিস্তৃত অভিজ্ঞতা। তিনি ২০০২ সালে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিতে (এসএমসি) যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে যাত্রা করে এসএমসি। তিনি এসএমসির স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পুষ্টি কার্যক্রম সফলভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং এটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তসলিম উদ্দিন খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং মার্কেটিংয়ে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার থেকে পরিবার পরিকল্পনা প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেন। বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি কর্মসূচিতে অবদান রেখে চলেছেন তিনি। তার বেশ কয়েকটি প্রকাশনা রয়েছে, টিভি টক শোর ১০০টিরও বেশি পর্বে অংশ নিয়েছেন এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। তার কাজ ও দক্ষতা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এসএমসির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোতাসিম বিল্লাহ
কালবেলা: এসএমসির ৫০ বছর পূর্তি। এসএমসির প্রতিষ্ঠা ও পথচলা সম্পর্কে জানতে চাই।
তছলিম উদ্দিন খান: ১৯৭৫ সালে প্রথমে একটি প্রজেক্ট হিসেবে এসএমসি যাত্রা করে। সে সময় প্রজেক্টটি পিএসআই নামে ইন্টারন্যাশনাল উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, ইউএসএআইডি এবং বাংলাদেশ সরকার—এই তিন পক্ষ মিলে একটি অ্যাগ্রিমেন্টে আসে। এই অ্যাগ্রিমেন্টের অধীনে ‘সোশ্যাল মার্কেটিং ফ্যামিলি প্ল্যানিং প্রজেক্ট’ নামে এসএমসির পথচলা শুরু হয়। প্রথমে ছিল শুধু দুটি কনট্রাসেপটিভ-ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল এবং কনডম। তখন পরিবার পরিকল্পনাসামগ্রীর ব্যবহারকারী ছিল অনেক কম। ১০ শতাংশের নিচে। মানুষের মধ্যে অনেক কুসংস্কার ছিল। তারা পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে অতটা গ্রহণ করত না। সেরকম একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এসএমসি কাজ শুরু করে। প্রথমে প্রায় ১০ বছর আমরা শুধু পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি নিয়ে কাজ করি। শুরুতে কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকলেও একটা সময় আমরা ব্যাপক সাফল্য লাভ করি। সেই সাফল্যের পেছনে ছিল আমাদের তৎকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রম। যাত্রার এক দশক পর ১৯৮৫ সালের দিকে স্বল্প সময়ের মধ্যেও দেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ভালো অগ্রগতি হয়েছে। তখন আমরা মনে করলাম, আমাদের সঙ্গে জনগণের একটি সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে।
১৯৮৫ সালে আমরা ওরস্যালাইন বাজারে নিয়ে আসি। সে সময় দেশে শিশু মৃত্যুর হারের দিক থেকে এক নম্বর অসুখ ছিল ডায়রিয়া। আমরা মূলত পাঁচ বছরের কমবয়সী ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য ওরস্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ দিই। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সফল হয়েছিলাম তেমনটি নয়, কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। বিস্ময়কর হলেও এখন আমরা প্রতি বছর ১৫০ কোটি ইউনিট ওরস্যালাইন বাজারে সরবরাহ করি। আর এর ফল হলো এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মধ্যে ডায়রিয়া ছিল এক নম্বর সংক্রমিত রোগ, সেটা এখন আট নম্বরে নেমে গেছে।
সফলতার সঙ্গে সঙ্গে একসময় আমরা চিন্তা করি, এখন আর প্রজেক্ট হিসেবে নয়, বরং একটি স্থায়ী হওয়া দরকার। শুধু আমরা নই, বরং এ দেশে যারা অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন, আমাদের সহযোগীরা, এমনকি সরকারি পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা হলো। আর সেই চিন্তার প্রকাশ হিসেবে ১৯৯০ সালে এসএমসি আত্মপ্রকাশ করল একটি অলাভজনক কোম্পানি হিসেবে। সেখান থেকে আজকের দিন পর্যন্ত, এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার দিকেও মনোনিবেশ করেছি। আমাদের কার্যক্রমের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রোডাক্ট আমরা বাজারে এনেছি। আমাদের প্রায় সব প্রোডাক্টই বাজারে ছাড়ার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এগুলো বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
কালবেলা: সামাজিক বিপণনে এসএমসির সাফল্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বে একটি মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, এ সাফল্যের পেছনের গল্প জানতে চাই।
তছলিম উদ্দিন খান: আমরা মূলত কমার্শিয়াল টেকনিক ব্যবহার করি। মার্কেটিংয়ের ভাষায় প্রোডাক্ট, প্রাইসিং, প্রমোশন এবং প্লেসমেন্ট; এ টেকনিকগুলোই ব্যবহার করি আমাদের মতো করে। আমরা অনেক চিন্তাভাবনা এবং মার্কেট রিসার্চ করে আমাদের পণ্য বা সেবার ব্র্যান্ডিং করি। আমাদের প্রচারণাগুলো হয় খুবই স্ট্র্যাটেজিক পদ্ধতিতে। আমরা প্রত্যেকটা সেবা বা পণ্যের জন্য একটি টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ করি এবং তাদের কাছে কোনো চ্যানেলে সহজে পৌঁছানো যায়, সেটা খুঁজে বের করি। একই সঙ্গে আমরা আমাদের পণ্য বা সেবার গুণগত মানের সঙ্গে কখনো কম্প্রোমাইজ করি না। আমরা সবসময় গুণগত মান বজায় রাখি এবং সাধারণ মানুষও সেটাই চায়। মানুষের মধ্যে এ বিশ্বাসটা আমরা তৈরি করতে পেরেছি যে, এসএমসির প্রোডাক্ট খারাপ হবে না।
কালবেলা: এসএমসি দেশব্যাপী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এটি কোনো বিদেশি অনুদানে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না?
তছলিম উদ্দিন খান: আমরা সেই শুরুতে অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে যখন আমাদের কার্যক্রম শুরু করি তখন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএসএআইডি আমাদের সঙ্গে ছিল। এখনো আমরা সংস্থাটির সহায়তা নিই। তবে আমাদের সব প্রকল্পের বড় একটি অংশ বাস্তবায়ন হয় আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে। আমরা এখনো আন্তর্জাতিক এনজিওর সহায়তা নিই এ কারণে যে, এই অর্থ দিয়ে আমরা আরও বেশি সেবা পৌঁছে দিতে পারি মানুষের কাছে। বাংলাদেশে এখনো এসব সেবার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমি এখন ১২০টি উপজেলায় আমার কার্যক্রম পরিচালনা করি, আমরা যদি আরও ১০০টি উপজেলায় পৌঁছাতে পারতাম তাহলে আরও অনেক বেশি জনগণের সেবা করতে পারতাম। এজন্য আমরা তাদের সহযোগিতাকে সবসময় স্বাগত জানাই। ইউএসএআইডি নিরবচ্ছিন্নভাবে গত ৫০ বছর আমাদের সঙ্গে রয়েছে।
কালবেলা: আপনার প্রতিষ্ঠানের কাঠামো এবং এটি কীভাবে পরিচালিত হয় সে বিষয়ে বলুন।
তছলিম উদ্দিন খান: আমাদের প্রতিষ্ঠানটি মূলত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। আমরা ফর প্রফিট একটি সাবসিডিয়ারি এনটিটি করেছি। তাদের কাজ হলো সারপ্লাস রেভিনিউ জেনারেট করা। সেই রেভিনিউ কেউ নিয়ে যাবে না। এটা আমরা আবার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিনিয়োগ করি। একটি বোর্ডের মাধ্যমে আমাদের এ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। এই বোর্ডের সদস্যরা বিভিন্ন পেশার সমাজের নেতৃস্থানীয় অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। এই বোর্ডের একজন চেয়ারম্যান রয়েছেন। বেশ কয়েকজন ডিরেক্টর রয়েছেন। তারাই আমাদের দিকনির্দেশনা দেন এবং আমাদের পলিসি নির্ধারণ করেন। তারাই আমাদের পরামর্শ দেন যে কোথায় আরও উন্নতি করা লাগবে। আমরা যারা ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে রয়েছি, তারা বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
কালবেলা: ৫০ বছরের পথচলায় আপনারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন?
তছলিম উদ্দিন খান: যে কোনো উদ্যোগেই চ্যালেঞ্জ থাকে। আমাদের সামনেও সবসময় চ্যালেঞ্জ ছিল, সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমরা সামনের দিকে এগিয়েছি। আমরা একটি পণ্য যখন বাজারে নিয়ে আসি তখন চিন্তা করি, এ পণ্যটির ব্যবহার বৃদ্ধি দরকার। যত বেশি মানুষ সেটা ব্যবহার করবেন তত স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হবে। এটা খুব সহজ কোনো কাজ নয়। প্রথমে মানুষকে মোটিভেট করতে হয় এবং তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হয়। এরপর মানুষের বিহেভিয়ার পরিবর্তন করতে হয়। মানুষ যখন আমাদের সার্ভিস ব্যবহার করে তখনই তারা এর ভালো দিকগুলো জানতে পারেন। মানুষের কাছে যখন একটি পণ্য বা সেবা পরিচিত হয়ে ওঠে, তখন সেটা সফল হয়।
আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের সচেতনতার অভাব। একটি প্রোডাক্ট বাজার আনতে গেলে তার দুটি দিক থাকে। একটি হলো সাপ্লাই সাইড এবং অন্যটি হলো ডিমান্ড সাইড। আমি সাপ্লাই সাইড সব রেডি করে রাখলাম কিন্তু ডিমান্ড সাইড নেই, তাহলে সেটা কেউ ব্যবহার করবে না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ প্রেগন্যান্ট মা সাধারণত এএনসি সার্ভিস নিয়ে থাকেন চারবার। সব মায়ের জন্য এটা চারবার করা ইউনিভার্সাল। কিন্তু সবাই সেটা করেন না। এটা শুধু অর্থের জন্য তা নয়, আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা উদ্যোগ রয়েছে যেখানে বিনা টাকায় এ সেবাগুলো দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু অনেকে সেটা নেন না শুধু সচেতনতার অভাবে। আমরা এ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
কালবেলা: দেশের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে এসএমসির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।
তছলিম উদ্দিন খান: দেশের ১০০ জন মায়ের মধ্যে শুধু ৪১ জন চারটি এএনসি সার্ভিস পান। বাকি ৫৯ শতাংশই এ জরুরি সেবাটি পাচ্ছেন না। তাহলে কি এসএমসির কাজ এবং দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে? ওই যে ৫৯ শতাংশ মায়েরা সেবা পাচ্ছেন না তাদের জন্য তো আমাদের কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে এখনো ১০০টি বাচ্চা ডেলিভারির মধ্যে ৩৫টি নিজ বাড়িতেই হয় যেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দেখা যায় মা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছেন, তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া অনেক রিস্কি এবং কঠিন। অনেক সময় রাস্তাতেই মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে। আমরা তো চাই না কোনো মা এভাবে মৃত্যুবরণ করুক।
বাংলাদেশে এখনো মাতৃমৃত্যু সাড়ে তিন থেকে চার হাজার। আমরা চাই না একজন মাও যেন তার গর্ভকালীন সময় অর্থাৎ শিশুসন্তান জন্মগ্রহণের সময় মারা যান। এভাবে বাংলাদেশে এখনো পাবলিক হেলথের অনেক সূচক রয়েছে, যেখানে আমাদের অবস্থান অনেক নিচে। এ জায়গাগুলোতে আমাদের উন্নতি করতে হবে। এসএমসির এখানে বড় ধরনের দায়িত্ব রয়েছে। এসএমসি এসব সমস্যার সমাধান করতে চায়। এটাই আমাদের আগামী দিনের লক্ষ্য।
শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম