মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:১২ এএম
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার অবসান হোক

লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার অবসান হোক

লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা রেলযোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ট্রেনের টিকিট পেতে ভোগান্তি, ট্রেনের ছাদে যাত্রী বহন, ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় নিয়ে রয়েছে যাত্রীদের এন্তার অভিযোগ। গত ৭ জানুয়ারি ফরিদপুর-ভাঙ্গা রেলপথে ট্রেন ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়। পরদিন জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও ট্রাকের ধাক্কায় ট্রেন ও ট্রাকের চালকসহ চারজন আহত হয়। বিগত দিনে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনায় অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ ধরনের বড় দুর্ঘটনায় মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে ১১ জন তরুণ শিক্ষার্থী পর্যটকের মৃত্যু ঘটে এবং আহত হয় অনেকে। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের পুরানাপৈল লেভেল ক্রসিংয়ে বাস ও ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে ১২ জন নিহত এবং ৬ জন গুরুতর আহত হয়। একই বছর ১৫ জুলাই ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলসড়কের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় পঞ্চক্রোশী এলাকার বেতকাকান্দিতে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত এবং অন্তত ৬ জন আহত হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে সারা দেশে রেলের ১ হাজার ২২৮টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪০৩ জন নিহত এবং ১ হাজার ২৬৯ জন আহত হয়েছে। সেলফোনে কথা বলা ও ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলার কারণেও এ যাবৎ নিহত হয়েছে অনেকজন। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর অসতর্কভাবে বসে থাকা ও লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে চলা, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে এবং অন্যান্য কারণে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে।

যে কোনো লেভেল ক্রসিংয়ে একটি রেললাইন সড়কপথ অতিক্রম করে যায়। উন্নত রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় লেভেল ক্রসিংয়ে রেলপথ ও সড়কপথ আলাদা দুটি লেভেল বা স্তর দিয়ে যায়। কাজেই সেখানে ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের সংঘর্ষের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেরকম ব্যবস্থা না থাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে গেটবার দিয়ে সড়কপথ আটকে রেখে ট্রেনকে চলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আর সেই ব্যবস্থাটি যথাযথভাবে কাজ করে না বলেই লেভেল ক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু লেভেল ক্রসিংয়েই সড়কপথ ও রেলপথ এ দুই ধরনের যানবাহনের সাক্ষাৎ হয়। কাজেই রেললাইনের ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অথচ লেভেল ক্রসিংগুলো অরক্ষিত থাকার কারণেই বারবার দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারায় মানুষ।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে রয়েছে শত শত অবৈধ লেভেল ক্রসিং। পরিসংখ্যান মতে, সারা দেশে বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় ৮৪ শতাংশ লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত রয়েছে এবং দেশে যত রেল দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৮৯ শতাংশই ঘটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ, অর্থাৎ এসবের কোনো অনুমোদন নেই। এর মধ্যে ৯৬১টি লেভেল ক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। আর ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টির নেই কোনো গেটম্যান। কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও নেই এসব অরক্ষিত, গেটম্যানবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে। অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগ রাস্তাই এলজিইডি এবং ইউনিয়ন পরিষদের। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইনে শুধু ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। এ ছাড়া এসবের ৬৬১টিতে কোনো গেটম্যানই নেই। পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৩৭৭টি ক্রসিংয়ের ৮১১টি অবৈধ আর ৩০০ বৈধ ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। রেল কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি করে। অনেক জায়গায় বেআইনিভাবে রেললাইন অতিক্রম করে যে যার প্রয়োজনে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রেললাইন পেরোতে হচ্ছে। লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগ গেটবারের অবস্থাও করুণ। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা ভাঙা গেটবার নামানো হচ্ছে কোনো উপায়ে। এমনকি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন এসে পৌঁছার আগাম সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থাও নেই সব জায়গায়। লেভেল ক্রসিংয়ের আশপাশে গড়ে উঠেছে বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। রেলপথের ওপর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করে থাকে সরকারের নানা সংস্থা। বিভিন্ন এলাকার অসচেতন জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ির রাস্তা সোজা করতে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখানে-সেখানে অবৈধভাবে অ্যাপ্রোচ সড়ক তৈরি করে। রেললাইনের ওপরই প্রতিদিন পণ্য বেচাকেনা করতে জড়ো হয় অসংখ্য মানুষ। পথচারী ও যানবাহনকে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং দ্রুত পেরোতে গিয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

বিশ্বের মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত রেলপথ। শুধু যাত্রী পরিবহনই নয়, মালপত্র পরিবহনের জন্যও বিশ্বব্যাপী রেলপথকেই সর্বাগ্রে বেছে নেওয়া হয়। ট্রেনে চেপে অধিকসংখ্যক যাত্রী দ্রুততম সময়ে নিরাপদে অতিক্রম করতে পারে। ট্রেনের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। অথচ দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরাজমান নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে রেলযোগাযোগের তেমন প্রসার লাভ করছে না। যাত্রীসেবা মানের কোনোরকম উন্নয়ন না ঘটায় বাংলাদেশ রেলওয়ে অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে। একসময় আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বড়ছড়া রেলব্রিজ ভেঙে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস নিচে পড়ে উল্টে চারজন যাত্রী নিহত এবং দুই শতাধিক যাত্রী আহত হওয়ার পর রেলওয়ের নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র নজরে আসে। রেলসেতু ভেঙে ট্রেন নিচে পড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করা হয়।

বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে যাত্রী হতাহত ছাড়াও পঙ্গুত্ববরণ করে অনেকে। এদের পরিবার-পরিজন নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু এসবের জন্য মামলা হলেও সহসা মামলার নিষ্পত্তি হয় না। হতাহতদের মেলে না ক্ষতিপূরণ। একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় রেললাইন, ট্রেনের বগি, যন্ত্রাংশ ছাড়াও যাত্রীদের মালপত্রের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর রেললাইন সচল করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেশে রেললাইনের প্রয়োজনীয় উপকরণ চুরি হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। রেললাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারেরও অভাব রয়েছে। জরাজীর্ণ প্ল্যাটফর্ম, মান্ধাতা আমলের রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি এবং অদক্ষ চালক দিয়ে চলছে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা। অব্যাহত ট্রেন দুর্ঘটনা বন্ধ করতে লেভেল ক্রসিংয়ের সংস্কার, রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা সব অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার অনতিবিলম্বে উচ্ছেদ করা জরুরি। রেলওয়ে ১৮৯০ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটলেও দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। বর্তমান রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়নকল্পে রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিয়মিত সংরক্ষণ ও মেরামত করাসহ রেলওয়েকে প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে শুধু ‘সতর্কীকরণ’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দায় এড়িয়ে গেলে চলবে না। ট্রেন আসার সময় রেলগেটে সাইরেন বা সতর্কীকরণ হুইসেল বাজিয়ে গেটম্যানকে সজাগ করে তুলে আসা বাসকে সাবধান করতে হবে। লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যানের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির পাশাপাশি রেলওয়ে ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করা জরুরি। লেভেল ক্রসিংয়ের সংস্কারসহ ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দক্ষ চালক নিয়োগ, রেল বিভাগের সর্বস্তরে যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো সুদৃঢ় করা আবশ্যক। অনতিবিলম্বে অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করে বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতে প্রশিক্ষিত গেটম্যান নিয়োগ করে লেভেল ক্রসিংয়ে তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। রেলওয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন করা গেলে ট্রেনে যাত্রা নিরাপদ হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ডিইউএমসিজেএএ’র

আ.লীগ নিষিদ্ধে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম

তিলকারত্নের বিদায়: নারী দলের কোচ খুঁজছে বিসিবি

রূপগঞ্জে ছুরিকাঘাতে আহত ২ কিশোরের মৃত্যু

টেন্ডার ছাড়াই ৭০ হাজার টাকায় ১৮ বিঘা জমি নিলেন বিএনপি নেতা

সরকারি চাকরির স্বেচ্ছায় অবসরের বয়স-পেনশন নিয়ে যেসব প্রস্তাব

হাজিদের মোটা অঙ্কের অর্থ ফেরত দিচ্ছে এশিয়ার মুসলিম দেশ

‘বিএনপি ও প্রশাসনের কতিপয় লোকজন আ.লীগকে রক্ষা করছে’

ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে নির্বাচন যেন বিলম্বিত না হয় : সাইয়েদুল আলম

বিইউ’র নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম

১০

কামরুলের ১৫ হিসাবে সাড়ে ৩ কোটি টাকা অবরুদ্ধ

১১

দেশকে খুনি হাসিনা ধ্বংস করে গেছে : ড. খন্দকার মারুফ

১২

রংপুর শহরে বন্ধ সব পেট্রল পাম্প, ভোগান্তি চরমে

১৩

কমেছে বিদেশগামী অভিবাসীর সংখ্যা, বেড়েছে নারীদের বিএমইটি নিবন্ধন  

১৪

পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার 

১৫

বাংলাদেশকে চার প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ

১৬

৫০ হাজার টন গম এলো আর্জেন্টিনা থেকে

১৭

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় খালাস পেলেন যারা

১৮

নতুন রাজনৈতিক দলের জন্য নাম ও প্রতীক চাইলেন শিক্ষার্থীরা

১৯

আহতদের জন্য আসা বিদেশি চিকিৎসকদের সুখবর দিল এনবিআর 

২০
X