মাঠের ফসল, পুকুরের মাছ, বাড়ির গাছ, সীমানার বেড়া নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া খুব সাধারণ ব্যাপার। যুগ যুগ ধরে চলা এসব ঘটনা ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। বিপদ-আপদে আবার প্রতিবেশীই সবার আগে পাশে দাঁড়ায়। মান-অভিমান ভুলে নিজ এলাকার ইজ্জত রক্ষায় আত্মত্যাগেও দ্বিধা করে না। কিন্তু সেই প্রতিবেশী যদি ভিন্ন রাষ্ট্র হয়; তবে পরিণতি এক হয় না। সম্পর্কটি তখন আর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কূটনীতি, রাষ্ট্রীয় চরিত্র, স্থানীয় সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুভূতি, বাণিজ্যিক লাভ-ক্ষতি সর্বোপরি রাজনীতি ঢুকে যায়। বছরের পর বছর পাশাপাশি বসবাস করলেও, মুহূর্তে অচেনা হয়ে যায় তারা। প্রতিবেশী হলেও, আলাদা দেশ হওয়ায় বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় ইন্ধনে হঠাৎ মারমুখী হয়ে পড়ে একে অন্যের প্রতি। বিভিন্ন সময় এরকম দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে আত্মীয়তা এবং নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও, আচমকা অবিশ্বাসের দেয়াল ওঠে। দেশপ্রেমের উত্তেজনায় মাটির চেয়েও মানুষকে মূল্যহীন মনে করে। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে এরকম অস্থিরতা চলছে। মাঠের ফসল পদদলিত করে এরই মধ্যে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছে দুই দেশের প্রতিবেশীরা। সংঘর্ষ ঠেকাতে দুই রাষ্ট্রের সশস্ত্র সীমান্তরক্ষীরা নিজ নিজ নাগরিকদের শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো উগ্র দেশপ্রেমিক, অবিবেচক গণমাধ্যম ও দুষ্টু রাজনীতিবিদ অশান্তির উসকানি দিচ্ছে। একে অন্যের রাষ্ট্রদূতকে পাল্টাপাল্টি তলব করে আত্মসম্মান প্রদর্শন করছে দেশ দুটি। সর্বশেষ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে এ ক্ষেত্রে প্রকাশের চেয়ে দুঃখ ধারণ করা জরুরি।
প্রতিবেশী হিসেবে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছেন, ‘এ সম্পর্কে বিদ্বেষ কোনো পক্ষের জন্যই ভালো ফল আনবে না। আমরা প্রতিবেশী, আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে, পরস্পরকে বুঝতে হবে। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্পর্কের কথা আমরা তখনই বলতে পারি; যখন একটি নির্বাচিত সরকার থাকবে। সেনাবাহিনী পর্যায়ে দুই দেশের সম্পর্ক ভালো এবং একদম ঠিক আছে।’ ভারতীয় সেনাপ্রধানের বক্তব্যের শুরুটা ইতিবাচক হলেও শেষটা নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। যৌক্তিক সময় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো বদ্ধপরিকর। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অনানুষ্ঠানিক জনআকাঙ্ক্ষারই ফসল। তারা রুটিনওয়ার্কের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করছে। পুরো পৃথিবীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গতিশীল রেখেছে। আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাহলে ভারতের সমস্যা কোথায়? আসলে গত আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এ কথা আড়াল করার সুযোগ নেই। সারা বিশ্ব জানে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে টানা দেড় দশক ভারত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় জেঁকে বসে কর্তৃত্বপরায়ণ হাসিনা সরকার। গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠালেও গণতান্ত্রিক ভারত এ ব্যাপারে আপত্তি করেনি। বরং একতরফা স্বার্থ আদায়ে সুবিধাজনক অবস্থান দৃঢ় করেছিল। দাদাগিরির প্রতিভূ মোদি সরকারের মনোরঞ্জনে অনুগত হাসিনা সরকার কত কি না করেছে। সেসব প্রকাশ্যে বলতেও দ্বিধা করেনি পতিত সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলরা। যদিও এসব শুনে লজ্জা পেয়েছে সাধারণ মানুষ।
আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি মোদির ভারতকে আগ্রাসী করে তুলেছিল। যদিও অন্য দেশগুলোর বেলায় হাসিনা সরকারের কূটনীতি ছিল ভিন্ন। এমনকি বিশ্বের এক নম্বর দেশ যুক্তরাষ্ট্রকেও দেখে নেওয়ার হুমকি দিতেন পলাতক হাসিনা। সস্তা আবেগ আর মিথ্যা বাগাড়ম্বরে তোষামোদকারীরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলত। শেখের বেটি বিশ্বনেত্রী বলে মুখে ফেনা তুলেছে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক অনুসারী। পরিণামে সভ্য দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাধা পড়েছিল নিষ্ঠুর কাপালিকের হাতে। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অনেকটা জন্মদাগের মতো। কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। তবে দীর্ঘদিনের সম্মানের সম্পর্কটির অবনমন ঘটেছে গত দেড় দশকে। মুজিব-ইন্দিরার পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক তলানিতে নামিয়েছে বশংবদ হাসিনা। তার পরিণামও ভোগ করছেন তিনি আশ্রিতা হয়ে। ভারতের সাম্প্রতিক আচরণে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার উদ্দেশ্য নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশিদের মুক্ত করতে নাকি নিজেদের স্বার্থে যুক্ত করতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ভারত? সে সময় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় পত্রপত্রিকা, সরকারি নথিপত্র, রেড ক্রসের চালানে সে সংখ্যা মাত্র ২০ থেকে ২৭ লাখ। স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বাছাই করা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে ‘বিশেষ গ্রুপ’ তৈরি করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী। তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখন সর্বজনবিদিত। এমনকি একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ চুক্তিতে সই করে ভারতীয় জেনারেল অরোরা। ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মারপ্যাঁচে উপেক্ষিত হন বাংলাদেশের বৃদ্ধ সেনাপতি ওসমানী। একাত্তরে বাংলাদেশিদের বাঁচা-মরার লড়াইকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে দাবি করে আসছে হিন্দুস্তান। এ নিয়ে অগুনতি সিনেমা-নাটক বানিয়ে চলেছে তারা। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে সব প্রতিবেশীই ভারতকে সম্প্রসারণবাদী বলে সন্দেহের চোখে দেখে।
বাংলাদেশে দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা অনেক নারীর নাম ফেলানী। অনাদরে অবহেলায় ফেলনা জিনিসের মতো বড় হতে থাকে তারা। তাদেরই প্রতিনিধি কুড়িগ্রামের ফেলানী আজ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সম্পর্কের করুণ প্রতীক। ১৪ বছর আগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের গুলিতে মরে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলেছিল কিশোরী ফেলানী। আজও বিচার হয়নি সেই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের। বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। পৃথিবীর যুদ্ধরত দেশগুলোর সীমান্তেও রক্ষীদের হাতে এত নিরীহ মানুষ খুন হয় না। গত দেড় দশক মোদি ও হাসিনা সরকার বারবার গর্ব করে বলেছে, বাংলাদেশ-ভারত যে কোনো সময়ের তুলনায় উষ্ণ সম্পর্কের শিখরে অবস্থান করছে। অথচ এ সময়ে সীমান্তে বিএসএফের হাতে মারা গেছে ছয় শতাধিক বাংলাদেশি। বিশ্বে মরণঘাতী সীমান্ত হিসেবে এটাও একটা রেকর্ড। যদিও স্বপ্ন দেখা এবং সবকিছুতে রেকর্ড রোগে ভোগা হাসিনা সরকার এ রেকর্ড চাপা দিয়ে রেখেছে। ভারতের সঙ্গে ৪ হাজার ১৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত ফেলানীর মতোই ফেলে রেখেছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। যে কারণে ভারত সরকার সীমান্তে যথেচ্ছার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি ভারতের সীমান্ত রাজ্য সরকারগুলোও ন্যায্য হিস্যায় বাধা দেয় এবং চোখ রাঙায়। ইচ্ছেমতো কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া, পাখির মতো মানুষ মারা ডাল-ভাত করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক আইনকানুনের ধার ধারছে না। অবৈধ অনুপ্রবেশের অজুহাতে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে গুলি করে। লাশ আটকে রাখার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড করে হরহামেশা। সবাই জানে, দুই দেশের সীমান্তের একশ্রেণির মানুষ বছরজুড়ে মিলেমিশে চোরাকারবার করে। তাদের সহযোগিতার জন্য প্রায়ই দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। অথচ সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এখন তারা মুখোমুখি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনেছে। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের সীমান্তে কেউ আসতে পারবে না। রক্ত ঝরবে কিন্তু দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত থাকবে। আগের সরকার কিছুটা ছাড় দিত। এখন অধিকার আদায়ে ছাড় দিচ্ছি না। তাই কিছু বিষয়ে ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। বিজিবি সবসময় সতর্ক রয়েছে। এ সীমান্তে ওপারের কেউ আসতে পারবে না। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ডিজি লেভেলের বৈঠক হবে। সেখানে সমাধান হবে বলে আশা করছি।’
দেশের সাধারণ জনগণও এ আশা করে। কিন্তু সাহসিকতার নামে হঠকারিতা করা যাবে না। সামর্থ্য অনুযায়ী কথা বলতে হবে। কূটনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে কৌশলী হতে হবে। সবসময় বলা হতো, রাজনৈতিক কারণে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে। সেটা সরকার তার কূটনীতি দিয়ে সমাধান করবে। বড়জোর নিরাপত্তা বাহিনী হস্তক্ষেপ করবে। কিন্তু বেসামরিক নাগরিক থাকবে এর আওতামুক্ত। এবার সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই দেশের উত্তেজিত জনগণ। গত দেড় দশকে রাষ্ট্রীয় মদদে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে ভারতীয় সীমান্তবাসী। আর অধিকার আদায়ে ফুঁসে উঠছে দাবিয়ে রাখা বাংলাদেশিরা। মুজিব হত্যাকাণ্ডের চার দিনের মাথায় মোশতাক সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশকে আরও বেশি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে হত্যাকাণ্ডকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করেছিল ইন্দিরা সরকার। সে খবর পঁচাত্তরের ১৯ আগস্ট মিশরের আল আরহাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মিশর সফরে থাকা মিসেস গান্ধীর নির্দেশে হাইকমিশনার সমর সেন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দেখা করে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তোলেন। অথচ গণঅভ্যুত্থানে পদচ্যুত শেখ হাসিনার জন্য মোদি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। এটিও কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এজন্য দুই দেশের কোটি কোটি জনগণ ভুক্তভোগী হতে পারে না। প্রতিবেশী তো পাল্টানো যায় না! মিলেমিশে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে হয়। নিশ্চয়ই দ্রুত শুভবুদ্ধির উদয় হবে। জনপদ হবে জনগণের। কোনো উচ্চাভিলাষী বা ফ্যাসিস্টের জন্য সাধারণ মানুষ জিম্মি হতে পারে না।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি