নির্বাচন দ্রুত না ধীরে, এত দেরিতে কেন অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র—এসব বিতর্কের মাঝেও ঐক্যে আবার শান পড়েছে। ৫ আগস্টের পূর্বাপর গড়ে ওঠা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবার অবদানকে সম্মান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দাবি মেনে জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এজন্য যে শুক্র-শনিবার লাগে না, তা আবার প্রমাণিত। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার এক বৈঠকেই সেতুবন্ধটা করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এ নিয়ে গোলমাল পেকে যাচ্ছিল। ৫ আগস্টের ফ্রন্টলাইনার ছাত্রসমাজ, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি এবং অন্তর্বর্তী সরকার—এ তিনপক্ষের মধ্যে কথা চালাচালিতে ভিন্নতা ছিল লক্ষণীয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ রেখে ছাত্রদের প্রোক্লেমেশন কার্যকরে আগুয়ান ভূমিকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। তির্যক কথাবার্তাও হতে থাকে। বৃহস্পতিবার সেখানে ফুলস্টপ না হলেও একটি সেমিকোলন পড়েছে। সবার সঙ্গে আরও আলোচনা করে জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরিতে একমত রাজনৈতিক দলগুলো। কেউ যেন ঐক্যে ফাটল ধরাতে না পারে সেদিকে সজাগ থাকার তাগিদ এসেছে সব দিক থেকেই।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা কয়েক শব্দে জানিয়ে দেন, সবাইকে নিয়ে ঘোষণাপত্রের সিদ্ধান্তে ছাত্ররা শুরুতে খুশি না হলেও, পরে তারা তার বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে। দশ কথার এক কথা যাকে বলে। নিজের অবস্থানও জানান দেন আবার। বলেন, যতদিন (দায়িত্বে) আছেন ঐক্যতেই থাকবেন। বক্তব্যে ঐক্যের মাঝে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্ম হয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, ৫ আগস্টের পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। একতাতেই আমাদের জন্ম, একতাই আমাদের শক্তি। জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তাদের সঙ্গে ফটোসেশনে শরিকও হন তিনি। পুরো আবহটাই ছিল ভিন্ন।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে আরও আলোচনা হবে। কাজটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য কমিটিও গঠন করা হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে এ বিষয়ে দ্রুত একটি কর্মকৌশল ঠিক করা হবে। এ ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিষয়টি নিয়ে সরকারের এ অবস্থান জানিয়েছেন। এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ওই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচিও দেয় তারা। পরে সর্বদলীয় বৈঠকের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির ঘোষণা দেয় সরকার।
বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবার অবদানকে সম্মান করে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের এ সিদ্ধান্তের আগপর্যন্ত গত কদিন রাজনীতিতে বেশ অস্থিরতা চলেছে। বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মতামত এসেছে, তড়িঘড়ি না করে একটি কমিশনের মাধ্যমে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি ঘোষণাপত্র সরকারের পক্ষ থেকে জাতির উদ্দেশে জানানো উচিত। সেই ঘোষণাপত্রে বলা থাকবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা কী ছিল। শত শত বছরের লড়াইয়ের ইতিহাস, পলাশী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান রাষ্ট্র নির্মাণ, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদি উপকরণ ঘোষণাপত্রে আসা উচিত। সবাই একমত হয়েছেন, এ ধরনের একটা ঘোষণাপত্র করার দরকার আছে। ঘোষণাপত্রে সবার অবদান বলতে হবে, ধারাবাহিকতা উল্লেখ করতে হবে। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক বা আইনি প্রকৃতি কী হবে, সেটা স্পষ্ট করতে হবে। আরও বেশি আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ও ছাত্র-জনতা সবার মধ্যে আলোচনা করে সর্বসম্মতভাবে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ঘোষণায় দেরি হওয়ার ত্রুটিটি ছাত্ররাই আগে উপলব্ধি করেছে। গোপন না করে তা প্রকাশও করেছে। সচরাচর এ ধরনের ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লেমেশন বিপ্লব বা অভ্যুত্থান চলাকালে বা আগে-পরে দেওয়ার প্রথা রয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সেটি না করায় চলতিপথে প্রায়ই বিপত্তি বাধছিল। আন্দোলনে কার কী ভূমিকা—এ নিয়ে মন্দকথাও উচ্চারিত হতে থাকে। সংস্কার, নির্বাচন, গণহত্যার বিচার নিয়েও পাল্টাপাল্টি কথাবার্তা হতে থাকে। একপর্যায়ে ছাত্ররা নতুনভাবে মাঠে নামে। দেশ সফরও শুরু করে। আর জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব বলে বিএনপি নেতারা মনে করেন। সংসদ নির্বাচনের আগে যেন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চিন্তা করা না হয়, সেই সতর্কতাও দিতে থাকেন। এও বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের যে আলোচনা-চিন্তা, সেটা জাতীয় নির্বাচনের সময়ক্ষেপণের চেষ্টা। এ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন থেকে নিশ্চিত করা হয়, সংসদ নির্বাচনই তাদের মূল ফোকাস। এই ফয়সালার পর এখন ঘোষণাপত্র তৈরির বিষয়েও আপাতত একটি নিষ্পত্তি ঘটল। সেইসঙ্গে ঐক্যেও নতুন শান পড়ল।
এরই মধ্যে ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কাজও হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে ২০২৩ সালে পাস হওয়া আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্বাচন ভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসি এম এম নাসির উদ্দিন জানান, ওই আইন বাতিল করতে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া চিঠি অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নির্বাচন কমিশনের অধীনেই থাকবে। নির্বাচন ভবনে পিঠা উৎসবে পিঠা খেতে খেতেই এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানানো হয়। সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দুয়েকজনের সঙ্গে আলাপের পর নাসির উদ্দিন বলেছিলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখতে হবে। এজন্য যা যা করার তিনি করবেন। করেছেনও। ওই আইন বাতিল করতে চিঠি দিয়েছেন। ফল মিলেছে।
গেল আন্দোলনে মীর মুগ্ধকে কারা হত্যা করেছে নতুন করে সেই ভিডিও ফুটেজেরও দেখা মিলল বৃহস্পতি নামের দিনটিতে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান মীর মুগ্ধর হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছে তার পরিবার। ট্রাইব্যুনালে এসে অভিযোগ দায়ের করেন মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ও বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত। অভিযোগ দাখিলের পর সাংবাদিকদের শহীদ মুগ্ধের যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে একটা বিতর্ক ছিল যে, গুলিটা পুলিশের মধ্যে থেকে করা হয়েছে নাকি বাইরের কারও থেকে করানো হয়েছে। অথবা স্নাইপার থেকে করা হয়েছে কি না। তবে তাদের কাছে যে প্রমাণাদি আছে, তার মাধ্যমে তারা পুলিশকেই দুষছে। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন, সেখানে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের গুলিতেই মুগ্ধের জীবন গেছে। বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত বলেন, এ ছয় মাসে হত্যাকাণ্ডের বিষয় যতটুকু প্রমাণ বের করা সম্ভব তা তারা নিজ উদ্যোগেই করেছেন। মুগ্ধর লাশ কবর দিতে গিয়েও তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
একইদিন ২০১৩ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. ফয়েজ আহমেদকে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দিয়েছে তার পরিবার। লক্ষ্মীপুরের ডা. ফয়েজ আহমেদকে গুলি করে ছাদ থেকে ফেলে হত্যার ওই ঘটনা তখনকার সময়ের এক বর্বরকাণ্ড। অভিযুক্ত অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন—সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক, র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক সিইও তারেক সাইদ মোহাম্মদ। ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে র্যাবের স্টিকারযুক্ত একটি গাড়িতে করে ফয়েজ আহমেদের বাসায় যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সে সময় তারা বাসার লোহার গেট ভেঙে ফেলেন এবং ডা. ফয়েজকে ভবনের ছাদে নিয়ে গুলি করে নিচে ফেলে দেন। সুষ্ঠু বিচার পেতে তারা ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেছেন।
টানা ১৫-১৬ বছরের নানা মর্মান্তিক ঘটনা ও বেদনার পরতে পরতে গড়ে ওঠা এই ঐক্যেরও বিস্ফোরণ ৫ আগস্ট। এখন মানুষ কি কেবল শেখ হাসিনার বিদায়ে খুশি থাকবে, না কিছু অর্থবহ পরিবর্তন দেখবে সেই অপেক্ষা। এ অপেক্ষার মাঝেই অনৈক্যের তাড়না। আবার সংস্কারের জোর আয়োজন। অবাধ, সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের জন্য মানুষ উন্মুখ। সেইসঙ্গে চায় হত্যা-গণহত্যা, লুট-পাচার, দুর্নীতিতান্ত্রিকতার বিচারও। যেখানে ঐক্য বড় প্রাসঙ্গিক। কাঙ্ক্ষিত সেই ঐক্যের জায়গায় টোকা পড়ল অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত ঘিরে। নানা কাজ ঘটনায় ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সমালোচনা হচ্ছে। তার মানে এই নয় তারা শত্রু ছিল। তাদের ডাকে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, জুলাই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে সবার আগে তাদের ফাঁসি হতো। তারা সেটা মনে রাখেনি। সামনে কেবল ফ্যাসিস্টের পতন আশা করেছে। দলমত সবাই এ জায়গায় অকাতরে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই সাফল্যের ওপরই সরকার গঠন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অভিষেক।
ঘোষণামতো তার হাতে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে চার কমিশন। তাও তিনি বাস্তবায়ন বা শুরু করতে চান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত সংবিধানে শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কোনো দফা সন্নিবেশিত হয়নি। এমনকি যতবারই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এ বিষয়টি সুচতুরভাবে শাসকগোষ্ঠী এড়িয়ে গেছেন যার পরিণতিতে দেশে স্বৈরশাসক এবং ফ্যাসিস্টের উত্থান হয়েছে। এর নিষ্পত্তির জন্যও দরকার ঐকমত্য। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মাধ্যমে তাদের এ বার্তা পরিষ্কার যে, প্রশাসন-পুলিশ-ক্যাডারের মাধ্যমে চিরকাল শাসনক্ষমতায় থাকা যায় না। সেই বোধকে প্রাতিষ্ঠানিক করতেও ঐক্য বড় প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেরাদের দমনেও ঐক্যের বিষয়আসয় রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন