নিপাহ ভাইরাস একটি জুনোটিক ডিজিজ, যা প্রাণীর দেহ থেকে মানব শরীরে সংক্রমিত হয়। ভাইরাসটি অতি সহজেই বাদুড় জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। শুধু বাদুড় নয়, নিপাহ শূকরের বর্জ্য থেকেও ছড়াতে পারে। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার ‘কামপুং সুঙ্গাই নিপাহ’ গ্রামে প্রথম এ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়, পরে ওই গ্রামের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘নিপাহ’ ভাইরাস। সেখানে বাড়ির পোষ্য কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহে এ ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ওই অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই শূকর প্রতিপালন হয়। গবেষণার পর দেখা যায়, শূকর থেকেই নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়েছে পোষ্যদের দেহে। মালয়েশিয়ার পর তা সিঙ্গাপুরেও দেখা যায়। ১৯৯৯ সালে শূকরের শরীর থেকে ভাইরাসটি আবিষ্কার করেন ড. কো বিং চুয়া।
মালয়েশিয়ায় ১৯৯৮ সালে শূকরের খামার থেকে মানবদেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে, ২৬৫ জন আক্রান্ত হয় এবং ১০৮ জন মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০০১ সালে মেহেরপুরে। ওই বছর শনাক্ত হয় ১৩ জন এবং অনেকেই মারা যায়। ২০০৪ সালে দেশে খেজুরের রস খেয়ে সর্বোচ্চ ৬৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল এবং মারা গেছে ৫০ জন। ২০১২ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয় ১৮ জন। সর্বশেষ গত সাত বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। কিন্তু ২০১৭ সালে ৩, ২০১৮ সালে ৪, ২০১৯ সালে ৮, ২০২০ সালে ৭, ২০২১ সালে ২, ২০২২ সালে ৩ এবং ২০২৩ সালে ১১ জন শনাক্ত হয়। ২০২৪ সালে আক্রান্ত হয় ৫ , যাদের সবাই মারা গেছে। গত ২৪ বছরে দেশে ৩৪৩ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ২৫৫ জন মারা গেছে, যা মোট আক্রান্তের ৭১ শতাংশ। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ পুরুষ আর ৩৮ শতাংশ নারী। ৮৮ জন বেঁচে থাকলেও বিভিন্ন জটিলতায় ভুগেছে। সবচেয়ে বেশি ৭১ জন শনাক্ত হয় ফরিদপুরে। এরপর রয়েছে রাজবাড়ীতে ৩৫, নওগাঁয় ৩২, লালমনিরহাটে ২৪, মানিকগঞ্জে ১৭, রংপুরে ১৬, মেহেরপুরে ১৩ জন। দেশের ৩৪টি জেলায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। তাই বর্তমানে বাংলাদেশকে এ রোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিপাহ ভাইরাসের বাহক এবং কীভাবে ছাড়ায়: নিপাহ ভাইরাস একটি জুনোটিক ভাইরাস, অর্থাৎ প্রাণীর মাধ্যমে মানবদেহে আসে। প্রাণীর দ্বারা দূষিত খাবার বা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশুও আক্রান্ত হতে পারে। নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত পশুপাখি বিশেষ করে বাদুড়ের মাধ্যমে। বাদুড় থেকে মানুষে এ রোগের সংক্রমণ হয়। বাংলাদেশে শীত মৌসুমে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত খেজুরের কাঁচা রস পানের মাধ্যমে এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়। কারণ এ সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। এমনকি রস খাওয়ার সময় বাদুড় মলমূত্র ত্যাগ করলে সেই রসে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস পান করলে মানুষের মধ্যেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া বাদুড়ে খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলেও রোগ ছড়াতে পারে।
রোগের লক্ষণ: নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কেউ কেউ উপসর্গহীন থাকতে পারে, কারও আবার শুধু সাধারণ জ্বর-কাশি দেখা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে জটিল অবস্থা হলো যখন মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা এনসেফালাইটিস দেখা দেয়। নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় ভাইরাসটি শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ও পেশিতে ব্যথা, খিচুনি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেটব্যথা, বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ রোগে মস্তিষ্কে এনসেফালাইটিস জাতীয় ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, ঘুম ঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, খিচুনি এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আর যারা বেঁচে যান তারা অনেকেই স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না, এমনকি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন চিরতরে।
নিপাহর পরীক্ষা: অ্যালাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে এ ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব।
চিকিৎসা: এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের কোনো ওষুধ নেই। রোগের লক্ষণ দেখামাত্রই রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, প্রয়োজনে আইসিইউও লাগতে পারে। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়, আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
সেবাদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্কতা: এ রোগে আক্রান্তদের পরিচর্যা করতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্সদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। যেমন মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, সারা শরীর আবৃত করে গাউন বা পিপিই ব্যবহার করতে হবে। রোগী দেখার পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমক্ত করা খুবই জরুরি। রোগীর ব্যবহার করা কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার না করে আবার ব্যবহার করা যাবে না। রোগীর কফ ও থুতু যেখানে-সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
এ রোগ প্রতিরোধের জন্য: এ কথা সত্যি যে, শীতের সময়ে খেজুরের রস পান করা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
১. খেজুরের কাঁচা রস কোনোভাবেই পান করা উচিত নয়, পান করতে হলে টগবগ করে ফুটিয়ে নিতে হবে। তবে খেজুরের রসের তৈরি গুড় ক্ষতিকর নয়। এমনকি খেজুরের রসের রান্না করা পায়েস, পিঠা খাওয়া নিরাপদ।
২. গাছ থেকে খেঁজুরের রস সংগ্রহের হাঁড়ি ঢেকে রাখতে হবে। কোনোভাবেই যেন বাদুড়ের লালা, মলমূত্র, খেজুর রসের সঙ্গে মিশে না যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৩. যারা রস সংগ্রহ করেন, তারা যেন সতর্ক থাকেন। কারণ হাঁড়ির আশপাশে বাদুড়ের লালা লেগে থাকতে পারে। মাস্ক পরতে হবে এবং রস সংগ্রহের পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
৪. ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া আংশিক ফল যেমন—আম, লিচু, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কাঁঠাল, ডেউয়া, পেঁপে, পেয়ারা, বড়ই ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো।
৫. হাতের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে, তাই নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
৬. আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে এবং রোগীর পরিচর্যা করার পর সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।
৭. আক্রান্ত মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে।
সাবধানতা: এ রোগের কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। নিচে কিছু টিপস দেওয়া হলো:
১. যেহেতু নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়, তাই নিকট সময়ে যারা খেজুরের রস খেয়েছেন, তাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
২. আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। তাই যারা রোগীদের সেবা দিয়েছেন এবং মৃতদের সৎকার করেছেন, তাদের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে।
৩. রোগীর সঙ্গে একই পাত্রে খাওয়া বা একই বিছানায় ঘুমানো যাবে না।
৪. রোগীর ব্যবহার করা কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
৫. রোগীর কফ ও থুতু একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৬. রোগীর শুশ্রূষা করার সময় মুখে কাপড়ের মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে নিতে হবে।
৭. যে এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সে এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হওয়ার পর আরও অন্তত ২১ দিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে এবং যে এলাকায় প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেখানে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
খেজুরের কাঁচা রস খেয়ে যে কোনো রোগী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট বা অজ্ঞান হলে দেরি না করে নিকটস্থ রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন, প্রয়োজনে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। তা ছাড়া নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া কোনো দেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে এলে তাকে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সর্বোপরি আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়