মানুষ এক বিচিত্র প্রাণী। ধর্ম-বর্ণ-দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আলাদা হলেও দেখতে মোটামুটি একইরকম। কিন্তু স্বভাবে বাঘ-সিংহ-হায়েনা-হরিণ-বানর-গাধাসহ নানারকম পশুর মতো। যে কারণে প্রতিনিয়ত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এ জীবের পাশবিকতার খবর পাওয়া যায়। কারও কারও স্বভাব আবার তুলতুলে বিড়াল বা বিশ্বস্ত কুকুরের মতো। এজন্য হয়তো সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার লিখেছিলেন, ‘মানুষ আসলে চিন্তাশীল পশু।’ এসব কোনো নতুন কথা নয়। তবে নতুন নতুন ঘটনায় পুরোনো প্রবাদ ফিরে আসে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা নষ্ট করায় বাঙালির জুড়ি নেই। নিজের দুঃখে কাঁদলেও অন্যের বিপদে সুখ খোঁজে—এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয় এই সমাজে। ছাত্র-জনতার এত বড় রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরও বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়া নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সংশয়-সন্দেহ। পলাতক স্বৈরাচারী সরকার ও তাদের বিপন্ন দোসরদের সুযোগসন্ধানী পদক্ষেপের বিপরীতে যেন অসহায় ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানকারীরা। বিপ্লবের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণে দেখা যায় দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র। এমনকি অবৈধ অটোরিকশাও রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। কোথাও যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, সরকার খুব ঢিমেতালে চলছে। খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। স্বৈরাচারের অনেক দোসরকে এখনো বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের মাথায় দেখা দিয়েছে নানামুখী রাজনৈতিক সংকট। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেতাদের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে। কমিটি গঠন নিয়ে প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই বিভিন্ন জেলায় গ্রুপিং, মারামারি হচ্ছে। এ ছাড়া, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি খোলামেলাভাবেই সমালোচনা করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠনের অভিযোগ এনে তাদের ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে উল্লেখ করছে। সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে তারা। যদিও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন দাবি করেছেন, ‘কিংস পার্টি’ বলা হলেও এরকম পার্টির কোনো আলামত বা বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে নেই। একইভাবে গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটারও কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু আন্দোলনের সমন্বয়কদের সরকারি গাড়ি ব্যবহারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়ার উদাহরণ ঘুরছে লোকমুখে। বিচ্ছিন্নভাবে চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্যের অভিযোগও প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। এসব অভিযোগের সামান্যতম অংশ সত্যি হলে, তা হবে জাতির জন্য চরম হতাশার। কেননা, অতীতেও কাঙ্ক্ষিত দেশ গঠনের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে বারবার। একাত্তরের মৃত্যুঞ্জয়ী কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক প্রভাবে দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সাজা ভোগের পাশাপাশি গণধিকৃত হয়েছেন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সিপাহসালাররা ধরে রাখতে পারেননি তাদের ঐক্যবদ্ধ ইমেজ। সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হলেও রোধ করা যায়নি স্বৈরতন্ত্রের উত্থান। এক-এগারোর সুযোগকে বিতর্কিত করেছে ওই ঘটনার কুশলীবরাই। নির্দিষ্ট কিছু লোক ক্ষমতা উপভোগ করায় উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। ইতিহাসে সেই ঘটনা এখন বিরাজনীতিকরণের পরিকল্পিত ব্লুপ্রিন্ট বলে নিন্দিত। বারবার আশায় বুক বাঁধলেও হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে জাতি। এবার ব্যর্থ হলে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ কথা অভ্যুত্থানকারীরাই বিভিন্ন সময় বলে থাকেন। কিন্তু সহজ পথে না হেঁটে নানারকম বন্ধুর পথ তৈরি করে দ্রুত বন্ধুহীন হয়ে পড়ছেন বিপ্লবীরা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, হঠকারিতা করে, ভুল সিদ্ধান্ত বা ভুল পদক্ষেপের কারণে সেই সম্ভাবনা যাতে বিনষ্ট না হয়। দ্রুত নির্বাচন হলে আমাদের শক্তি আরও বাড়বে এবং যেসব সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো দূর হয়ে যাবে।’ গত শনিবার একটি রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশেরই কিছু মানুষ বিভিন্নভাবে ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন।’ তার এ আশা এবং আশঙ্কা থেকে বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্রের ধারণা পাওয়া যায়। স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের বিপরীতে গত দেড় দশকে ভেতরে ভেতরে মজলুম জনতার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অস্তিত্বের প্রশ্নেই প্রকৃতিগতভাবে যূথবদ্ধ হয়েছিল তারা। ফ্যাসিস্ট পতনের পর এখন নিজেদের উত্থানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির বীভৎসতা ফুটে ওঠে। সেরকম উত্তাল আন্দোলনের দিনগুলো জুড়ে ছিল শুধুই আত্মোৎসর্গের লাল রং। এখন শান্ত দিনে উৎকটভাবে বেরিয়ে পড়ছে লোভের কদর্যতা। স্বার্থ লাভের কালো পঙ্কিলতা। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালালেও, অনাগত ভবিষ্যৎ শঙ্কায় হাসি নেই সাধারণ মানুষের মনে। ফ্যাসিস্ট মানসিকতারও দেখা মেলে প্রভাবশালীদের আচরণে। গত দেড় দশকে রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সেসব জায়গায় এখনো সংস্কারের বাতাস সেভাবে লাগেনি। অথচ নানা স্বার্থান্বেষী মহল সংস্কারের অভিপ্রায়কে কুসংস্কারে পরিণত করে ফেলেছে প্রায়। এসব দেখে হয়তো পরদেশে আশ্রিতা শেখ হাসিনা আর তার পলাতক দোসররা হাসিতে আটখানা হয়ে পড়ছেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার! বিভিন্ন সময় দেশের জন্য লড়াই করা মানুষগুলো ঝগড়া করে ভারত বা পাকিস্তানপন্থি হিসেবে। অথচ বাংলাদেশপন্থি হিসেবে দেশপ্রেমিক মানুষের গর্বের পরিচিতি পাওয়ার কথা। বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত দেবে কি না—এ নিয়ে তর্কের সময়ও কেউ কেউ ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু ভারত তার জাতীয় স্বার্থে একাট্টা। ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থানকে বিজেপি প্রশ্নবিদ্ধ করায় কঠোর সমালোচনা করে কংগ্রেস। তবে বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের অবস্থান অভিন্ন। এমনকি শেখ হাসিনার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাতে প্রতিযোগী হয়ে ওঠে তারা।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও কংগ্রেস নেতা মণি শঙ্কর আইয়ার মনে করেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের (ভারত) জন্য অনেক ভালো কাজ করেছেন। আমি আশা করি, এ বিষয়ে আমরা কখনো দ্বিমত হব না। তাকে আশ্রয় দেওয়ায় আমি খুশি। আমি মনে করি, আমাদের উচিত তিনি যতদিন চান তাকে আথিতেয়তায় রাখতে হবে। এমনকি যদি তা সারা জীবনের জন্যও হয়।’ তবে মণি শঙ্কর আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে সত্য। তবে এটি প্রধানত হাসিনার সমর্থকদের ওপর আক্রমণ। এ ধরনের প্রতিবেদন সত্য, কিন্তু কিছুটা অতিরঞ্জিত। কারণ অনেক সংঘর্ষের মূল বিষয়ই রাজনৈতিক।’ এটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে মণি শঙ্করের এ মন্তব্য বাংলাদেশের ভারতপন্থিদের ভালো লাগেনি। তারা সবসময় এ ইস্যুটি বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। সীমান্ত হত্যা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তাদের কাছে কখনো বাড়াবাড়ি মনে হয় না। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে উল্টো পাকিস্তানপন্থি ট্যাগের শিকার হয়েছেন অনেকে। এখন অবশ্য এ বিষয়ে সরকার সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিজিবিকে আবু সাঈদের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সীমান্তের জনগণ দেশপ্রেমের উত্তেজনায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিজিবির পাশে থেকে মহড়া দিয়েছে। ভারত প্রেমে অন্ধ পতিত সরকার গত দেড় দশক এসব লোকদের দাবিয়ে রেখেছিল। শত অত্যাচারের পরও সম্মানজনক কোনো প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। তবে কূটনীতিতে আরও কৌশলী হতে হবে সরকারকে। অসম শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে শুধু আবেগ দিয়ে জেতা যাবে না। তাদের কাছে নিজেদের অনিবার্য করে তুলতে হবে। বিশাল হাতিও কিন্তু সামান্য কাঁটাকে এড়িয়ে চলে। এজন্য দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য দরকার নির্বাচিত সরকার। কেননা, রাষ্ট্র কোনো দল বা গোষ্ঠীর চেয়ে জনগণের কাছে অধিকতর নিরাপদ। দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে।’
গত রোববার অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এ যাবৎকালের সেরা নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে সরকার। যাতে এটি গণতন্ত্রের একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তার এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চায় রাজনীতিবিদ তথা দেশের জনতা। কেননা, নির্বাচনই এখন পুরো জাতির অনিবার্য প্রত্যাশা। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সরকারকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পাহারাদারের দায়িত্ব নিতে হবে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনে জনগণের প্রত্যক্ষ ম্যান্ডেটের বিকল্প নেই। দেশপ্রেমের যে নতুন চেতনা তৈরি হয়েছে, সেটিকে পরিচর্যা করতে হবে। প্রেশার গ্রুপ হিসেবে নির্বাচিত নতুন সরকারকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে, হাজার প্রাণের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিস্টমুক্ত হয়েছে। তেলবাজি ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘স্তবস্তুতি মানুষকে নষ্ট করে। একটি শিশুকে বেশি স্তুতি করুন, সে কয়েক দিনে পাক্কা শয়তান হয়ে উঠবে। একটি নেতাকে স্তুতি করুন, কয়েক দিনের মধ্যে দেশকে সে একটি একনায়ক উপহার দেবে।’
বাংলাদেশের মানুষ এমনটি আর দেখতে চায় না। হাতেগোনা রাজনৈতিক টাউট বা দুর্নীতিবাজ আমলাই শেষ কথা নয়। সামান্য চাহিদা পূরণের প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছে কোটি কোটি সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি