ভ্যাটসংক্রান্ত মামলা ও বকেয়া মিলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা মাঠে আটকে থাকা সত্ত্বেও নতুন করে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্কের দুটি অধ্যাদেশ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষ হয়েছে ক্ষুব্ধ। কেননা নিত্যপণ্যের বাজারে দীর্ঘদিনের বিরাজমান উত্তাপে এমনিতেই হাঁসফাঁস অবস্থায় তারা। তার ওপর নতুন করে এ সম্পূরক মূল্য সংযোজন কর যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হবে এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
সোমবার কালবেলায় প্রকাশিত ‘মাঠে ৫০ হাজার কোটি অনাদায়ি রেখে টাকা খুঁজছে এনবিআর’ শীর্ষক প্রধান প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ভ্যাটসংক্রান্ত মামলা ও বকেয়া মিলে মাঠে আটকে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভ্যাটসংক্রান্ত মামলায় আটকে আছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার কাছেই বকেয়া পড়ে আছে ২০ হাজার কোটি। বড় বড় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছেও আটকে আছে ভ্যাটের টাকা। মাঠের এ টাকা আদায়ে গতি না বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ে নতুন ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। অধ্যাদেশ জারির পরপরই এনবিআরের এ বিষয়ে নির্দেশনা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়।
এরপর থেকেই নানা মহলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ সিদ্ধান্তকে রাজস্ব আহরণের ‘সহজ পথ’ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বছরের মাঝপথে ভ্যাট বাড়ানো অযৌক্তিক এবং এ সিদ্ধান্তের আগে বিকল্প চিন্তার অবকাশ ছিল বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে এনবিআরের বকেয়া পাওনা আদায়ে জোর দেওয়া যেত। মামলাসংক্রান্ত জটিলতায় আটকে থাকা ভ্যাট আদায়েও জোর পদক্ষেপ নিতে পারত। এ ক্ষেত্রে অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে কথা বলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে পারত। এদিকে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপকে সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা দ্রুত সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী মহল থেকেও এসেছে প্রতিবাদ। তারা বলছেন, ‘আত্মঘাতী’ এ পদক্ষেপ জনগণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কারণ, এ খরচ পুরোটাই জনগণের ঘাড়ে পড়বে। ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এবং ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হবে বলেও তাদের মত। অন্যদিকে ভ্যাট আদায় এবং নতুন করে রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে এনবিআরে গতি নেই বললেই চলে। তাদের অডিট ও প্রিভেন্টিভ প্রায় বন্ধই রয়েছে। ভ্যাট আদায়ের গতিও তলানিতে ঠেকেছে। এরই মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে।
আমরা মনে করি, দেশের বাজারে বিরাজমান বাস্তবতায় এনবিআরের নতুন সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জন্য ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’—এতে কোনোই সন্দেহ নেই। স্মরণে রাখা উচিত, উচ্চমূল্যস্ফীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, সেই অনুপাতে মানুষের আয় বৃদ্ধি হয়নি। ফলে জনগণের মাথার ওপর এমনিতেই একটি বৃহৎ ব্যয়ের বোঝা, তার ওপর এ সিদ্ধান্ত তাদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলবে। সুতরাং নতুন সিদ্ধান্ত শুধু অযৌক্তিকই নয়, অমানবিকও। আমাদের প্রত্যাশা, সংশ্লিষ্টরা এ সিদ্ধান্ত দ্রুত পুনর্বিবেচনা করবেন। পাশাপাশি এনবিআরের উচিত বিপুল পরিমাণের বকেয়া আদায় এবং রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এ ছাড়া রমজানে বাজার পরিস্থিতি যেন ‘অতীত ঐতিহ্য’ অনুযায়ী অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কালো থাবায় পতিত না হয়, তার জন্যও আগেভাগে সতর্ক থাকতে হবে।