ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে রচিত হয়েছিল এই সংবিধান। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য সত্তরের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছিলেন, তাদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির গণপরিষদ। ফলে বাহাত্তরের সংবিধান এবং গণপরিষদ উভয়ের বৈধতা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছিল। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর বাহাত্তরের সংবিধানকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইশতেহার হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র দেওয়ার অধিকার এই সরকারের নেই। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরির জন্যই জনগণ তাদের নির্বাচিত করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির জন্য নয়।’ (গণকণ্ঠ: ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২)
বাহাত্তরের সংবিধানে কয়েকটি মারাত্মক অসংগতি রয়েছে। পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি অগণতান্ত্রিক এবং সংবিধানের পরিপন্থি কিছু ধারা। সবচেয়ে পরিহাসের বিষয় এই যে, বাহাত্তরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত তিন মূলনীতিসমূহ উপেক্ষিত হয়েছে। উপরন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চার মূলনীতির একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নাগরিক হিসেবে দেশের সব স্তরের মানুষের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথকে রুদ্ধ করা হয়েছে সাংবিধানিকভাবেই। বিভাজনের রাজনীতিকে দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানিক রূপ। আবার এই সংবিধানে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য না রেখে প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে আমাদের দেশে সরকারপ্রধানরা চরম কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী, গণবিরোধী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সাংবিধানিকভাবে কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার পথটি তৈরি করেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ প্রধান খোদ শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি যখন খসড়া সংবিধান শেখ মুজিবের কাছে পেশ করেন তখন তিনি নিজের হাতে কেটেছেঁটে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে রাষ্ট্রপতির তুলনায় একচ্ছত্র করেন। গণপরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করতে বা পাল্টে দিতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। শেখ মুজিব কর্তৃক কাটাছেঁড়া করা খসড়া সংবিধানটি যখন কমিটির কাছে ফেরত আসে তখন কারও সাহস হয়নি মুজিবের এ ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরোধিতা করার। আমাদের পর শ্রদ্ধেয় গুরুজন প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ এবং আতাউস সামাদের কাছ থেকে এ কথা বহুবার শুনেছি। তারা তাদের জীবদ্দশায় এ ব্যাপারে লিখেছেনও নিশ্চয়ই। তবে গত বছর ২৫ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম তার ‘যে ভুল সংশোধন না করলে রাষ্ট্র সংস্কার অসম্ভব’ শীর্ষক কলামে শেখ মুজিবের এই হস্তক্ষেপের বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছেন। এতে মইনুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন যে, বিষয়টি তাকে বলেছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক খালেদ।
শেখ হাসিনার পলায়নপর রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে চেয়ারম্যান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। যারা সংবিধান কোনো দিন খুলে দেখেননি, কিংবা সংবিধান সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই, তারাও বাহাত্তরের সংবিধানকে ভিত্তি হিসেবে ধরে সংস্কার করার পক্ষে মত দিচ্ছেন এবং অনেকেই এ সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার না করার পক্ষে খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে মায়াকান্নাও শুরু করেছেন। সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে একটি গোষ্ঠী বরাবরের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে আনছেন। যদিও তাদের রাজনৈতিক জীবনের কোনো স্তরেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক এবং আর্থিক সুবিধা লাভের আশায় তারা অবিরাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুলি আওড়ান। তারাই এখন মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতিকে ভিত্তি হিসেবে ধরেই সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন। বিষয়টি সতিকার অর্থেই জাতির সঙ্গে এক বিরল প্রজাতির রাজনৈতিক প্রহসন। আমরা যদি এ প্রহসনে পা দিই এবং সংবিধানের মারাত্মক ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে না পারি, তাহলে কোনো দিনই আমাদের পক্ষে জাতির সব স্তরের মানুষের সমন্বয়ে একটি অসম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথকে উন্মুক্ত করতে পারব না।
এবার আসি যেভাবে ৭২-এর সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা উপেক্ষিত হয়েছে সেই প্রসঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের সময় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হয়। এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের অন্যতম হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। একাত্তরের ১০ এপ্রিল এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হয়েছিল। এই ঘোষণাপত্র একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি।’ কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার—এ তিন মূলনীতি উপেক্ষিত হয়েছে। এর পরিবর্তে চার মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা। এ চার মূলনীতির মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা একে অন্যের পরিপূরক ও সম্পূরক। বিশেষভাবে সমাজতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। ফলে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র উল্লেখ থাকলে ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আলাদাভাবে উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয়। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া সমাজতন্ত্র হয় না।
বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়টি হলো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। এর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে এবং জাতিকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। কেননা বাঙালি ছাড়াও আমাদের দেশে মগ, চাকমা, মুরং, টিপরা, গারোসহ আরও বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। তাদের ভাষা বাংলা নয় এবং তারা বাঙালি নন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তাদের জাতীয়তার স্বীকৃতি উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ তারাও এ দেশের নাগরিক এবং তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন। সাংবিধানিকভাবে তাদের জাতীয়তার স্বীকৃতি না দেওয়াটা অন্যায্য ও অন্যায়। সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। গণপরিষদের সাধারণ আলোচনায় ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, ‘এই সংবিধানে বাংলাদেশের নিপীড়িত সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা পুরোপুরিভাবে প্রতিফলিত হয়নি। এ সংবিধানে মারাত্মক ত্রুটি রয়ে গেছে। যদি সংবিধানে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল-ত্রুটি রাখা হয় তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না। জোর করে জনগণের ওপর যদি সংবিধান চাপিয়ে দেওয়া হয় তবে তা একদিন প্রত্যাখ্যাত হবে। জোর করে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যায় না। রাষ্ট্রের অবহেলিত জনগণের সুযোগ-সুবিধা সমভাবে যদি সংবিধানে প্রতিফলিত না হয় তবে সেই রাষ্ট্র এবং সেই সংবিধান কোনো দিনই টিকে থাকতে পারে না।’
একপর্যায়ে মানবেন্দ্র লারমা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সাংবিধানিকভাবে জাতীয়তার স্বীকৃতি চান। এর উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘তোরা বাঙালি হয়ে যা।’ অর্থাৎ তিনি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ত্যাগ করতে বলেছিলেন। কোনো জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য এর চেয়ে বড় অপমান, অবহেলা, অবজ্ঞা আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মানুষের সঙ্গে যে অন্যায় আচরণ করেছিলেন, শেখ মুজিব স্বাধীন দেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে জাতীয়তার স্বীকৃতি না দিয়ে উল্টো তাদের ভাষা, সংস্কৃতি পরিত্যাগের নিদের্শ দিয়ে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর চেয়েও গর্হিত কাজ করেছেন। শেখ মুজিবের এ আচরণ মানবেন্দ্র লারমা মেনে নিতে পারেননি বা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধানের মূলনীতি করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীকালে নিছক গোঁজামিল দিয়ে এ সংকটের আপাত সমাধান করা হয়েছে। সংবিধানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গোঁজামিল কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই অবস্থার অবসান জরুরি। নইলে আমাদের পক্ষে কোনো দিনই জাতির সব স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে না, বিভাজন থেকেই যাবে।
২০০৬ সালে এ বিষয়ে আমি কথা বলেছিলাম জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি বাড়াবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘একসময় যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল আমরা বাঙালি সেটাও একটু সংশোধন করা প্রয়োজন। কারণ এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ বাঙালি হলে আমাদের ভাষা সংস্কৃতির একটি ভিন্ন পরিচয় আছে। আমাদের স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বাঙালি হলেও এর মধ্যে মগ, চাকমা, মুরং, হাজং, গারো, মারমা, চাকমা, সাঁওতাল ইত্যাদি জনগোষ্ঠী আছে।’ অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর এ সাক্ষাৎকারটি ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
এবার আসি ৭২-এর সংবিধান প্রণয়নকারীদের এখতিয়ার প্রসঙ্গে। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করা প্রয়োজন। এই অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন হয় এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন। আইয়ুবের সংবিধান বাতিল হয়ে যায়। ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দেন, অচিরেই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। এরই ধারাবাহিকতায় সত্তরের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরপর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে একচেটিয়া জয় পায়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল একাত্তরের ৩ মার্চ। এর এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। এরই প্রতিবাদে শুরু হয় আন্দোলন এবং একপর্যায়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন বসে। সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের নিয়েই গঠিত হয় এ গণপরিষদ। সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদেরও গণপরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত গণপরিষদে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য থেকেই এটি করা হয়। ১৯৭২ সালে এ সম্পর্কে জারি করা অস্থায়ী সংবিধান আদেশ অনুসারে গণপরিষদের আসনসংখ্যা ছিল ৪৬৯ (এর মধ্যে ১৬৯টি জাতীয় পরিষদের এবং ৩০০টি প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্বাচিত)। নির্বাচিতদের মধ্যে ৫ জন ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এবং ৫ জন এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। নিজেদের দল (আওয়ামী লীগ) থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার কারণে ২৩ জনের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার কারণে দুজনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে চারজনকে কারাবন্দি করা হয়। ফলে ১০ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন বসার দিন এর সদস্য ছিলেন ৪৩০ জন। পরে দল থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগসহ বিভিন্ন কারণে বাদ পড়ায় ১৯৭২ সালের অক্টোবরে গণপরিষদের সদস্যসংখ্যা ৪০৪ জনে নেমে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কোনো এখতিয়ার বা ম্যান্ডেট তাদের ছিল না। বৈষম্য সৃষ্টিকারী বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে আমাদের মায়াকান্না বন্ধ করা উচিত। সেইসঙ্গে প্রহসনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রের সব স্তরের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন জরুরি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে বিদ্যমান জটিলতা আরো ঘনীভূত হবে। সেইসঙ্গে আরো বিস্তৃত ও গভীর হবে রাজনৈতিক সংকট।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক