ছাত্র সমন্বয়কদের ঘোষণাপত্র জারির উদ্যোগটি স্মার্ট মুভ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রাক আলোচনাটা প্রয়োজন ছিল। এখনো তা করা সম্ভব। আওয়ামী লীগবিরোধী ঐক্যকে জাতীয় পুনরেকত্রীকরণের মাধ্যমে সত্যিকারের জাতীয় সমঝোতা এই মুহূর্তে কাম্য
বিশ্বকাঁপানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের একটা প্রোক্লেমেশন বা ঘোষণাপত্র জারি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন যথেষ্ট উত্তপ্ত। ছাত্রদের এ উদ্যোগকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে। সরকার নিজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঘোষণাপত্রটি দেবে। এতে ছাত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদজনিত উত্তপ্ত সাময়িকভাবে খানিকটা স্তিমিত। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কেন এই ঘোষণাপত্র? তাও আবার পাঁচ মাস পর। আর এ নিয়ে মতের পার্থক্যইবা কেন?
ইতিহাসের ভেতর দিয়ে বিশ্বের সব জাতিই কোনো সমস্যার মীমাংসা খোঁজে। কোনো একটা চরম সত্যকে সন্ধান ও লাভ করতে চায়। নেশন হচ্ছে গোটা এক জাতির ঐক্যবদ্ধ আত্মস্বার্থ। একটা জাতি স্বাধীন হয় তার নিজস্ব কতকগুলো লক্ষ্য, সদিচ্ছা ও শর্তপূরণের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশ শাসিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে মহান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ওই যুদ্ধ এবং বিজয় দুনিয়াকে আলোড়িত করেছিল। সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ঘোষণা করেছে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিবাদকে হটানোর সাফল্যের জন্য ২০২৪ সালে বিশ্বে বাংলাদেশ এক নম্বর দেশ। বিশ্বে স্বৈরাচারের ব্যাপক উত্থানের বিপরীতে দেশে দেশে গণআন্দোলন যখন ব্যর্থ হচ্ছিল (যুক্তরাষ্ট্রের গাজাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ভারতের কৃষক আন্দোলন, ভেনেজুয়েলায় স্বৈরশাসকবিরোধী আন্দোলন) সেখানে বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় এসে গণহত্যার পরোয়া না করে খুনি হাসিনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যা পারেনি, কোটাবিরোধী আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাকে গণমানুষের একদফা সফল আন্দোলনে পরিণত করেছে।
ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, পঁচাত্তরের সিপাহি জনতার জাতীয় বিপ্লব, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানগুলো মূলত বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আকুতিতে এ দেশে সম্পন্ন হয়েছে। সবগুলোর মর্মমূল ছিল তাই। তারপরও মানুষের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উল্টো আমরা পিছিয়ে গেছি অনেকদূর। জাতীয় ইতিহাসের ওই আলোড়ন তোলা পর্বগুলোর মধ্যে একমাত্র নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাহসী নেতৃত্বে সংঘটিত হয় এবং জনগণ সেজন্য অভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচনে তাকে বিজয়ী করে।
ভাষা আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। তবে এ সাফল্যের সুফল পেয়েছিল যুক্তফ্রন্ট ৫৪-এর নির্বাচনে। মূলত ৪৭-এর আগেই বুদ্ধিজীবীরা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একে চূড়ান্ত রূপ দেয়। ৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম-বরকতদের আত্মদানের পথ ধরে চূড়ান্ত বিজয় আসে। তার আগে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যাত্রা অনুষ্ঠানে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা বাংলা ভাষার জন্য এক দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটান। পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান সেখানে তার বক্তৃতায় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের উর্দুতে কথা বলার নির্দেশ দিলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর গণি দাঁড়িয়ে ওঠেন এবং প্রতিবাদ করে বলেন, পাঞ্জাবি সৈন্যরা যদি পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলতে পারে, তাহলে বাঙালি সৈন্যরা কেন বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারবে না। আইয়ুব খান এতে এতই রেগেছিলেন যে, মেজর গণিকে পরে অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়। ভাষার জন্য ওই প্রতিবাদ সৈনিকদের পক্ষ থেকে এসেছিল।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা জাতির অবিসংবাদিত মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর দ্বারা। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য এর শুরু। কিন্তু স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল এবং পাকিস্তানি শাসকদের সৃষ্ট বৈষম্যের কারণে ক্ষুব্ধ মানুষ সরাসরি রাস্তায় নেমে আসে এবং আইয়ুবশাহীর পতন ঘটায়। গণঅভ্যুত্থানের অন্তিম পর্বে আর কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নয় বরং দলমতশ্রেণি নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত বদ্ধস্বর তাকে সফল করে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে সেই অভ্যুত্থানের মাইলেজ পায়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্রের ক্ষমতা হস্তান্তরের অনীহা এবং তার বদলে গণহত্যা চাপিয়ে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধে নেমে যায়। তখনকার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছায় এবং শেষমুহূর্তে রাজনৈতিক সমঝোতার অপেক্ষায় তখন আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি এবং তার দলও। কিন্তু অরাজনৈতিক ব্যক্তি, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়া পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিল। ওই অভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন ছিল মেজর জিয়ার কণ্ঠে এবং ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের সময় এই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এটি পাঠ করেন জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের অন্যতম হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ঘোষণাপত্রটি একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’
কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে না থাকলেও বাহাত্তরের সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ ও ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্র এটা ঘটায়। সত্তরের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র বা সংবিধান তৈরি করা। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়। সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদেরও গণপরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত গণপরিষদে সদস্য বাড়ানোর লক্ষ্য থেকেই এটি করা হয়।
১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এ প্রয়াত সম্পাদক আবদুস সালাম ‘দ্য সুপ্রিম টেস্ট’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে নতুন নির্বাচিত গণপরিষদ দ্বারা নতুন সংবিধান প্রণয়নের আহ্বান জানালে ক্ষুব্ধ মুজিব সরকার তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল।
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের নেপথ্যে ছিল ৭২-৭৫ মুজিবীয় অপশাসন, দুর্ভিক্ষ, ফ্যাসিবাদ, গুম, খুন রাজনৈতিক, বিচার বিভাগ ও মতপ্রকাশের ওপর বীভৎস খড়গ, ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ভারতের হস্তক্ষেপ ও সেনা বিশৃঙ্খলা অপচেষ্টা, স্বাধীনতার ঘোষককে বন্দি ইত্যাদি ঘটনাবলি। এ অভ্যুত্থানের কোনো রাজনৈতিক মালিকানা ছিল না এবং তাৎক্ষণিক কোনো প্রোক্লেমেশনও নয়। ৭১-এর ২৬ মার্চ ও ৭৫-এর ৭ নভেম্বর শুধু ভাত-কাপড় ও রুটি-রুজির জন্য আসেনি। জাতি হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রিক সত্তাকে সুকঠিন শিলান্যাসের জন্যও এসেছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া ৭ নভেম্বরের চেতনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন এবং পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের বদলে সামাজিক ন্যায়বিচারকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা যেমনি ছিল জিয়ার কণ্ঠে, ৭ নভেম্বরের জাতীয় বিপ্লবের পর আবার জিয়া জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতিকে নবদিশা প্রদান করেন।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচার এরশাদের পতনের মূল প্রেক্ষাপট ছিল দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন আন্দোলন। উল্টো আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী আপস মত্ত হয়েছিল। Choice for new generation এই মন্ত্রে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের বীরোচিত উত্থান এবং তার নেতত্বে সম্মিলিত ছাত্র ঐক্য, পেশাজীবীদের সুতীব্র আন্দোলন এবং শ্রমিক কর্মচারীদের সম্মিলিত সংগঠন স্কপের দুর্বার ভূমিকার মার্শালে এরশাদের তখতে-তাউস উড়ে যায়। গণঅভ্যুত্থানের আগেই সব বিরোধী দল তিন জোটের রূপরেখা নামে একটি রাজনৈতিক সনদে ঐক্য হয়। সেজন্য ওই পর্বের আর কোনো প্রোক্লেমেশনের প্রয়োজন হয়নি। দেশনেত্রী বেগম জিয়া ও জননেত্রী শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে জাতির প্রতি ভাষণ দিয়েছিলেন। বেগম জিয়ার ভাষণ মুসাবিদার সময় সাংবাদিক ইউনিয়নে নেতা সৈয়দ জাফর, মানু মুন্সী, প্রেস ক্লাব নেতা মোজাম্মেল হক ও আমি বেগম জিয়ার অনুরোধে ভূমিকা রেখেছিলাম। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে মরহুম ব্যারিস্টার জুলমত আলী খানের বাড়িতে।
এখন আসুন চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে। শেখ হাসিনার ভারত সমর্থিত বীভৎস ফ্যাসিবাদে ১৫ বছর ধরে হাজার হাজার গুম, খুন, মিথ্যা মামলায় লাখো মানুষের কারাবাস, দুর্নীতি-দুশাসনের মচ্ছবের প্রতিবাদে বিএনপি ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করেছে। ২০২২-এর শেষদিকে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলো ছিল একেকটি মিনি গণঅভ্যুত্থান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ভোট ছিল বিরোধী দলের দাবি। কিন্তু বিএনপি কৌশল নেয় নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত আন্দোলন করার। সরকারকে খেয়ে ফেলার একটি সর্বাত্মক পরিপূর্ণ রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থান সংগঠনে বিএনপি-জামায়াত এবং অন্যান্য দলের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলে আসে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এতে শান্তিপূর্ণ ওয়ার্ক কভারের ফয়সালাও তারা করে ফেলে। অথচ জনগণ চাইছিল ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, ডলার ও টাকার সংকটে সরকারের দিশেহারা অবস্থা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারবিরোধী স্পষ্ট মনোভাব এবং একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংকল্পে ফ্যাসিবাদী সরকার বিদায় নিক। ২০১৬ সালে বিএনপি-জামায়াত শেখ হাসিনার ভরপেট মধ্যাহ্নভোজ খেয়ে ভোটে গিয়েছিল যে পরিস্থিতিতে, তাও বেগম জিয়ার অমতে, ২০২৪-এ সরকারের অবস্থা ছিল তার চেয়েও খারাপ। ২৪-এর ভোটে সরকার ব্যালট বিপ্লব ঠেকাতে যতই অপচেষ্টা করুক, হার এড়াতে পারত কি না সন্দেহ। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রখর দৃষ্টির মধ্যে কারচুপি করলেও ৭ জানুয়ারি প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় সীমিতসংখ্যক আইনরক্ষাকারী সদস্যের বিপরীতে গণঅভ্যুত্থান ঘটে যেত যার রূপ নিত জাতীয় রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানে। কিন্তু তা হয়নি। পিছিয়ে পড়ে গণঅভ্যুত্থান। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন আবার শুরু করে। সরকার মারাত্মক চাপে পড়ে। সরকারের প্রচারণার মুখে বিরোধী দল নেতারা তখন বলতে থাকেন, এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, তবে নৈতিক সমর্থন আছে। অথচ সাধারণ মানুষ আন্দোলন অংশ নিতে শুরু করেছে এবং হাসিনার খুনি বাহিনীর ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞ আন্দোলনের দাবানলে সমগ্র বাংলাদেশ প্লাবিত হয়। এতে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের এবং জামায়াতের কর্মীরা দলীয় ব্যানার গুটিয়ে সক্রিয় ভূমিকায় যায়। ছাত্র-যুবদলের অনেক কর্মী নিহত হয়। অরাজনৈতিক ছাত্রনেতারা একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনে চলে যায় এবং শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ছাত্ররা শুধু হাসিনার পতন নয়, ফ্যাসিবাদকে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ঘোষণা দেয়। এ অরাজনৈতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সাফল্যের ঘোষণা কে দিয়েছিল? কোনো ছাত্রনেতা বা কোনো রাজনৈতিক নেতা নন, দিয়েছিল অরাজনৈতিক ব্যক্তি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি সবাইকে ডাকেন সেনাসদরে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আন্দোলনকারীরা পরে যান বঙ্গভবনে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন বিজয়ী অভ্যুত্থানের নেতারা বলছেন, এতে রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন মালিকানা ছিল না। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে, এ আন্দোলনের বারুদ স্তূপীকৃত করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো, কিন্তু বিস্ফোরণের পর্বটি ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর অপসারণ, সরকার থেকে ছাত্রদের নতুন দল গঠনের উদ্যোগ, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন না হওয়া এমনিতর ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে ছাত্রদের বিভাজনটা স্পষ্ট। এরপর গত ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রদের পক্ষ থেকে অভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন জারির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়, সেই উত্তাপ এখনো আছে। অবশেষে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নিজেই ঘোষণাপত্র জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাত্ররা মনে করছে এটা তাদের প্রাথমিক বিজয়। এরা এই বিজয়ী অভ্যুত্থানকে অমরত্ব দিতে চায়। আলোচ্য ঘোষণাকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে চাইবে। পূর্ণাঙ্গ বিজয়ের জন্য বিশেষ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কাঠামো দাঁড় করতে নতুন রাজনৈতিক দলের গঠন পর্যন্ত যেতে তারা আগ্রহী। অভ্যুত্থানের চেতনায় নতুন দলের গঠন তো নতুন নয়। এদের অবমূল্যায়ন করা ভুল হবে। আমি মনে করি, ছাত্র সমন্বয়কদের ঘোষণাপত্র জারির উদ্যোগটি স্মার্ট মুভ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রাক আলোচনাটা প্রয়োজন ছিল। এখনো তা করা সম্ভব। আওয়ামী লীগবিরোধী ঐক্যকে জাতীয় পুনরেকত্রীকরণের অর্থাৎ national reconciliation মাধ্যমে সত্যিকারের জাতীয় সমঝোতা এই মুহূর্তে কাম্য।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনীতি বিশ্লেষক
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি