অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন ড. মনজুর হোসেন। জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ থেকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণা করেন অর্থনৈতিক নীতি, মুদ্রানীতি, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। তার গবেষণা দেশের অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ম্যাক্রো ইকোনমিক পলিসি’ ও ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ শীর্ষক তার দুটি বই সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা পেলগ্রেভ ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি, মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক খাতের অবস্থাসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুর হোসেন—
কালবেলা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন দেখছেন?
ড. মনজুর হোসেন: কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা-পরবর্তী পুনর্গঠন ধাপেও কিছুটা সমস্যা ছিল। তার ওপর যুক্ত হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব। তবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি ছিল, তা হলো—অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। এ অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে সংকটগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকারসূত্রেই সমস্যাগুলো পেয়েছে। আমি মনে করি না এগুলোর সমাধান সহজ হবে। গত ১০-১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। আমরা তার মাশুল দিচ্ছি। অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রয়োজন ছিল সেগুলো ঠিকমতো কাজ করেনি। এটাকেই বলেছি অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। উদাহরণস্বরূপ, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে ধরনের উদ্যোগগুলো নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা নেওয়া হয়নি। নয়ছয় ধরনের একটি সুদের হার নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল কিছু কায়েমি গোষ্ঠীর স্বার্থে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চাইলেও সেটা ওঠানো যাচ্ছিল না। এর মূল কারণ, গভর্নর পদটাকেই রাজনৈতিক করে ফেলা হয়। ফলে গভর্নরের পক্ষে স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।
ব্যবসায়ীরা একটা জায়গা থেকে চাপ দিচ্ছে। রাজনীতিকরা সেটাকে অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকীকরণ করে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে মূলত দুটি ঘটনা ঘটেছে। একটি হলো নীতি গ্রহণে প্রক্রিয়াগত সমস্যা এবং অন্যটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা। কিছু ক্ষেত্রে অযোগ্য লোকদের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে যাতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো সহজে বাস্তবায়ন করা যায়। ফলে সব মিলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যা চাইলেই দ্রুত সমাধান করা সম্ভব নয়।
কালবেলা : সমস্যা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি কতটুকু?
ড. মনজুর হোসেন: অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যাগুলোর শিকড় এতটাই গভীরে যে, চাইলেই রাতারাতি তা উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি লম্বা সময় ধরে চলছে, এক্সচেঞ্জ রেটের স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি, রিজার্ভের অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও তা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য যথেষ্ট নয়। ঋণের বোঝা বেড়ে চলেছে। সে তুলনায় রাজস্ব আয় বাড়ছে না। সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আমরা জানি শ্রীলঙ্কায়ও এরকম একটি বড় ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে দুর্বল করা হয়নি। যার কারণে তারা খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল। কিন্তু আমরা সেটা পারছি না।
সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এখানে ‘টাইমিংটা’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন যে পলিসি নেওয়া দরকার ছিল বিগত সরকার তা সেভাবে না নেওয়ায় চতুর্মুখী সমস্যা তৈরি করেছে। মূল্যস্ফীতি এখন শুধু সামগ্রিক চাহিদা ব্যবস্থাপনার জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের সাপ্লাই চেইনে সমস্যা তৈরি হয়েছে, দেশের ব্যবসা খাতের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত পতিত সরকারের আস্থাভাজনরা। তারা এখন বিভিন্নভাবে পরিস্থিতিকে খারাপ করার চেষ্টা করছে। ফলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের গ্যাপ তৈরি হচ্ছে।
দেশের বাজার ব্যবস্থা, বিনিয়োগ, উৎপাদন, ব্যাংক খাত, কর্মসংস্থান সবকিছু এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, যার কারণে কোনো ব্যবস্থাই ভালো ফল দিচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে সরকারকে দৃঢ়ভাবে এগোতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালাতে ভালো ও দক্ষ নেতৃত্ব লাগবে। সর্বোপরি এসব কিছুকে ঠিক করতে সরকারকে সময় দিতে হবে। আমি মনে করি অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে একটি ‘অর্থনৈতিক অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল’ গঠন করে সময়ে সময়ে তাদের মতামত নিয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এতে সরকারের নেওয়া অর্থনীতি-সংক্রান্ত নীতিগুলোর একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে এবং এ ধরনের একটি কালচার ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কালবেলা: দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এই কাজের অগ্রগতি কতটুকু?
ড. মনজুর হোসেন: দেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা লুটপাট এবং বিদেশে পাচার হয়েছে সেই টাকা ফেরানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। কিন্তু সেই টাস্কফোর্সের কাজ খুব একটা নজরে আসছে না। এখানে প্রশ্ন হলো টাস্কফোর্স কত দিন সময় নেবে? আমরা এখনই সংকটের মধ্যে রয়েছি। আমানতকারীরা তাদের টাকা পাচ্ছে না, লুটপাট হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোকে লিকুইডিটি সাপ্লাই দিতে গিয়ে টাকা ছাপাতে হচ্ছে। ফলে এ জায়গায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন করে হলেও ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমি মনে করি এখানে বেশি সময় নিলে সমস্যাগুলো আরও গভীর হবে।
কালবেলা: আপনি বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরা একটি নেক্সাসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ধরনের সমস্যা সরকার কীভাবে মোকাবিলা করতে পারে?
ড. মনজুর হোসেন: আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছি। একটি টেকসই গণতান্ত্রিক উত্তরণের কথা বলছি। এ গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটাতে পারলেই রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ‘আনহোলি নেক্সাস’ বন্ধ হবে বলে মনে করি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেই এ নেক্সাস অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আর ব্যাংক লুটপাট হচ্ছে না। ফলে এ বার্তাটা এখন অনেক পরিষ্কার। ভবিষ্যতে যদি আমরা একটি যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে পারি, তাহলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় যে স্বৈরাচারী কাঠামো তৈরি হয়েছে, তা হয়তো ভাঙা সম্ভব হবে।
কালবেলা: অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. মনজুর হোসেন: আমাদের মনে রাখতে হবে, সংস্কার কখনোই খুব সহজ নয় এবং স্বল্প সময়ের বিষয় নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে যে কমিশনগুলো করা হয়েছে, তারা যে সুপারিশগুলো জমা দেবেন সেখান থেকে ভালো সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সবার একতা প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং জনগণ সবাইকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংস্কারগুলো নিরপেক্ষ সরকারকেই করতে হয়। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক স্টেকহোল্ডার থাকে। সংস্কার করতে গেলে তার স্টেকহোল্ডারদের কেউ না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের সংস্কার এগিয়ে নিতে পারে না। সুতরাং আমি আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একটি ঐকমত্য নিয়ে এ সরকারকে দিয়েই সংস্কার কাজগুলো করিয়ে নেবে।
কালবেলা: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা জিডিপির গ্রোথ একসময় সারা বিশ্বের কাছে প্রশংসা পাচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সেই দৌড়ে হঠাৎ পতন ঘটল কেন?
ড. মনজুর হোসেন: তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে কিছুটা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু একেবারে যে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি সেটা আমি বলব না। সেই অতিরঞ্জিত করার বিষয়গুলো যদি আমরা বাদও দিই, তবুও আমি বলব বাংলাদেশ একটা সময়ে ভালো করছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরের মধ্যে হঠাৎ করে বাংলাদেশের ঊর্ধ্বগতি মুখ থুবড়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকার যখন থেকে নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবা শুরু করল তখন থেকেই পতনটার শুরু।
মূলত আওয়ামী লীগ ওভার কনফিডেন্সের ফলে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। যোগ্য লোকগুলোকে যোগ্য জায়গায় দেওয়া হয় না। এমন সব পলিসি নেওয়া হলো, যেগুলো অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এর মধ্যে আবার করোনা মহামারি চলে আসে। বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠল। কারণ একটি সংকট যখন আসে তখন বোঝা যায় আমার সক্ষমতা কেমন। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলে সেখান থেকে টেনে তোলার জন্যও যোগ্য ব্যক্তিদের খোঁজা হয়নি। শুধু খোঁজা হয়েছে দলীয়ভাবে কে কতটা অনুগত।
এ সময় আমলাতন্ত্র সবকিছুতে একটি শক্ত ভূমিকা রাখা শুরু করে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অর্থনীতি এক ধরনের মন্দা অবস্থার মধ্যে পড়ে। একটা সময় মানুষ অধৈর্য হয়ে ওঠে। সবকিছুর পরিণতি আমরা দেখেছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
কালবেলা: সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে তার অগ্রগতি কতটুকু? এ সরকার কি একটি টেকসই সংস্কার করে যেতে পারবে?
ড. মনজুর হোসেন: সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য একটি সঠিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মোটা দাগে যোগ্য লোকদেরই দায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এ সংস্কারগুলো যদি সঠিকভাবে হয় এবং কাজগুলোকে যদি বেগবান করা যায়, তাহলে ভালো কিছু আশা করি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার কাজগুলো করছে তাই সমাধানটাও অন্তর্বর্তী। এটি টেকসই সমাধান যদি করতে হয় তাহলে তা রাজনীতিকদেরই করতে হবে। দেশের রাজনীতিকরা যদি বর্তমান সেন্টিমেন্টকে ধারণ করতে পারে, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে আমরা একটি ভালো পরিবেশের প্রত্যাশা করতে পারব, যা দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে দ্রুত ধাবিত করবে।
কালবেলা: ২০২৬ সাল নাগাদ আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করব। এটা আমাদের অর্থনীতির ওপর আরও চাপ তৈরি করবে কি?
ড. মনজুর হোসেন: সম্প্রতি সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিআইডিএসের একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমরা চাইলেও সম্ভবত এখন আর এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সময় পিছিয়ে নিতে পারব না। কারণ পরপর দুবার যখন কোনো দেশ কোয়ালিফাই করে যায়, তখন আর পেছানোর আবেদন করা সম্ভব হয় না। আমরা এরই মধ্যে দুবার সময় পিছিয়ে দিয়েছি। আর ব্যক্তিগতভাবে আমিও মনে করি এটা পিছিয়ে দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। বরং বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত।
সম্প্রতি আমরা গার্মেন্টস সেক্টরের সাপ্লাই চেইনের ওপর একটি জরিপ করেছিলাম। যখন আমরা তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছেন? তারা বললেন, কোনো প্রস্তুতি নিইনি। যেহেতু আমরা গত পাঁচ বছর ধরেই জানি এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করলে বাজারটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও কঠিন হবে, তারপরও তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমরা আরও দুই বছর সময় বাড়িয়ে নিলেও এরকমই হবে। এখন বাংলাদেশের জন্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনটা হয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ বাংলাদেশে এখন আর এলডিসি গ্রুপের মধ্যে ফিট করে না।
কালবেলা: আমরা দেখেছি, যখন আমাদের গ্রোথ ৭-৮ শতাংশও হয়েছে, তখনো আমাদের কর্মসংস্থান বাড়েনি। এমনকি নতুন বিনিয়োগও বাড়েনি। এটা কেন হলো এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কী করা উচিত?
ড. মনজুর হোসেন: আমাদের প্রবৃদ্ধিকে আগে থেকেই জবলেস গ্রোথ বলা হচ্ছিল। কর্মক্ষেত্র তৈরির ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল। এ ছাড়া বিজনেস এনভায়রনমেন্ট অতটা ভালো হয়নি। বাংলাদেশে বিনিয়োগের গ্রোথ দেখলে বোঝা যায়, এখানে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বেশিরভাগ ইনভেস্ট হয়েছে গার্মেন্টস সেক্টরসহ অল্প কয়েকটি সেক্টরে। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরিতে প্রয়োজন ছিল নতুন বিজনেস ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন। কিন্তু তা হয়নি। আমাদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য তেমন কোনো ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থা রয়ে গেছে গতানুগতিক। এখান থেকে লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েশন করা ছেলেমেয়ে পাস করে বের হয়েছে। কিন্তু স্কিলফুল মানবসম্পদ তৈরি হয়নি। অথচ এ দক্ষ জনশক্তিই দরকার ছিল।
একটি দেশের কর্মসংস্থান তৈরির প্রক্রিয়াটা সহজ নয়। এর জন্য একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার; একই সঙ্গে অর্থনীতির ধারাবাহিক ঊর্ধ্বমুখী গতি দরকার। অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণীতে যে শক্তিশালী টিমের প্রয়োজন ছিল আমরা তা পাইনি। সর্বোপরি অর্থনৈতিক সুশাসনের ঘাটতি পুরো প্রক্রিয়াকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
কালবেলা: বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে বাজারটি আসলে ব্যক্তি খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। যেহেতু এখানে সরকারের ক্ষমতা খুবই কম তাই সরকার চাইলেও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. মনজুর হোসেন: সরকার টিসিবির মাধ্যমে কম মূল্যে মানুষের কাছে পণ্য বিক্রি করে। কিন্তু এই সক্ষমতা খুবই কম। টিসিবি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। সমগ্র সাপ্লাই চেইনের প্রত্যেকটা ধাপে এক ধরনের অশুভ চক্রের প্রভাব রয়েছে। এটাকে আমি ঠিক সিন্ডিকেট বলব না, তবে অনেকটা সিন্ডিকেটের মতোই। এ অশুভ চক্র সমগ্র বাজার ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বাজারের ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল করছে, ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল করছে। বিভিন্ন ধাপে বহু গ্রুপ চাঁদাবাজি করছে। ফলে ব্যবসার ক্ষেত্রে খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।
যেহেতু ব্যবসার খরচ কমানো যাচ্ছে না সুতরাং ব্যবসায়ীরাও অনেকটা সংকটে রয়েছেন। অনেকে ইনভেস্ট করতে দ্বিধান্বিত হচ্ছেন। ফলে বাজারে বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কম হচ্ছে। আর এর ইমিডিয়েট প্রভাব হলো—আমরা গ্রোথ মোমেন্টাম থেকে কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। এ সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণে একটি অলআউট এফোর্ট দরকার। সরকার চেষ্টা করছে, আমরা আশাবাদী এ পরিস্থিতির আস্তে আস্তে পরিবর্তন হবে।
আরেকটা বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পাবলিক কমিউনিকেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতি বা এসব ক্ষেত্রে এক্সপেকটেশন ডেভেলপ করে কথাবার্তায়। উচ্চপর্যায়ের সিনিয়র লিডাররা যখন কথা বলেন তখন সতর্ক না হলে তা আবার মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। সুতরাং নেতৃত্বের জায়গা থেকে ভরসা দেওয়ার একটা বিষয় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে মনিটরি কমিটি রয়েছে, তা আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার। একটা ভালো মনিটরি পলিসি বোর্ড থাকা দরকার। তাহলে ক্রেডিবিলিটি আরও বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের আস্থা ফিরে আসে। আমি মনে করি, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো বাংলাদেশে সম্ভব নয়। কারণ এখানে মুদ্রানীতির ট্রান্সমিশন চ্যানেলগুলো দুর্বল, আর্থিক খাত দুর্বল। তাই অতি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলব, একটি একোমোডেটিভ মুদ্রানীতি; অর্থাৎ খুব সংকোচনমূলকও নয়; আবার সম্প্রসারণমূলকও নয়—এমন একটি মুদ্রানীতি অর্থনীতির গতি বজায় রাখার জন্য সহায়ক হবে।
কালবেলা: সরকার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। আপনি সেই টাস্কফোর্সের একজন সদস্য। সে হিসাবে আগামী ২০ বছরে দেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য কী দেখছেন?
ড. মনজুর হোসেন: আমাদের এ টাস্কফোর্সের মূল এজেন্ডা দেওয়া হয়েছে শর্টটার্মে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে তার সুপারিশ করা। এটিকে সরকারের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদের পরিকল্পনার একটি রূপরেখা বলা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রায় ২০-২৫টি কনসালটেশন মিটিং করেছি সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে। আমাদের কাজের রিপোর্ট ড্রাফটিং চলছে। কিন্তু বিষয় হলো, খুব ইমিডিয়েট সলিউশন অনেক কিছুতেই নেই। আমাদের সুপারিশগুলো দেওয়ার পর পরবর্তী ধাপে তা কে প্রয়োগ করবে, কীভাবে করা হবে সেই জায়গাগুলো সরকারকে ভাবতে হবে। আমরা আশা করছি, এ টাস্কফোর্সের আওতায় যে সাজেশনগুলো আমরা দেব, সেগুলো যদি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে হয়তো এখনই তার দৃশ্যমান সুফল দেখা যাবে।