স্বাধীনতা অর্জনের পর ব্রিটিশ শাসনামলে জন্ম নেওয়া ভারতবর্ষের একশ্রেণির নাগরিক বলতেন, আগেই ভালো ছিলাম। অনভিজ্ঞ নতুন ভারতীয় সরকারের সামান্য় ত্রুটি-বিচ্য়ুতিতে অসামান্য় হতাশা ব্য়ক্ত করতেন তারা। দখলদার ব্রিটিশ সরকারের কঠোরতার প্রশংসায় কোনো লজ্জা ছিল না। নিষ্ঠুর শাসন পদ্ধতি এ জাতির জন্য় অনিবার্য বলে বিশ্বাস করতেন। যুগের পর যুগ এরকম ব্য়ক্তিদের দেখা পাওয়া গেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও এরকম অনুভূতি প্রকাশ করতেন অনেকে। শাসনের নামে পাকিস্তানি শোষণের কারণে এ কথা আরও জোরেশোরে উচ্চারিত হতো। বিশেষ করে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে ব্রিটিশের গুণগান গাইত পূর্ববাংলা তথা নাম বদলে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানের অনেকে। দেশ ভাগের অবাস্তব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শুরু থেকেই অস্বস্তি ছিল এই অঞ্চলে। তবু হোসেন সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন। জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে পূর্ব পাকিস্তান সরকারও গঠন করেছেন তারা। কিন্তু তাদের ভঙ্গুর সরকার ব্য়বস্থায় হতাশ হয়েছে জনগণ। এরকম পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ রাজের স্মরণ নিয়েছেন কেউ কেউ। অসম শাসন পদ্ধতির কারণে ধাপে ধাপে অসন্তোষ বাড়ে। এর চূড়ান্ত পরিণতিতে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এই অনিবার্য বাস্তবতার পরও স্বাধীন বাংলাদেশে আয়ুবীয় শাসনের বায়বীয় প্রশংসা করে থাকেন অনেকে। নির্মম সামরিক শাসন ও তথাকথিত উন্নয়নের উৎকট বয়ানে আস্থা রাখে।
এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের আমলে গত সরকারের প্রশংসার একটা রীতি চালু হয় একশ্রেণির নাগরিকের মাঝে। এটা বোধহয় মানুষের সহজাত স্বভাব। এখন যেমন হচ্ছে। নবীন-প্রবীণ, গতানুগতিক ও বিপ্লবী ধাঁচের মানুষ নিয়ে গঠিত হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে ওই বিশেষ শ্রেণির মানুষ মন্তব্য় করে, ‘আগেই ভালো ছিলাম’। যদিও গত দেড় দশক সাধারণ মানুষ মুক্তভাবে এ কথা বলতে ভয় পেত। এই আপ্তবাক্য়কে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য় ভূমিকা রাখছে পরাক্রমশীল আওয়ামী লীগের পলাতক সেনারা। তবে এ ধরনের ক্য়াম্পেইন কেন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে? সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। যদিও তথ্য়প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অস্থিরচিত্তের অধিকারী হয়ে উঠেছে। হাতে হাতে স্মার্টফোন। স্পর্শ করলেই তথ্য়-অপতথ্য়ে ভরা শত শত নিউজ পোর্টাল সামনে হাজির হয়। এসব দেখেও বিচলিত হয়ে পড়ে চঞ্চলমতি জনগণ।
গণঅভ্য়ুত্থানে প্রায় দেড় হাজার শহীদ আর কয়েক হাজার মানুষের অঙ্গহানির বিনিময়ে ফ্য়াসিস্টমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। গত দেড় দশকের হিসাব ধরলে সংখ্য়াটা আরও বেড়ে যাবে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে কাঙ্ক্ষিত দেশ গড়তে সাধারণ মানুষের প্রত্য়াশা বেড়েছে কয়েকগুণ। নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে কর্মজীবী, শিক্ষার্থী-বেকার-ভবঘুরেও বলছে; জাতির জীবনে একটি সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে পস্তাতে হবে। যে কোনো মূল্য়ে বিপ্লবের পক্ষে ঐক্য় ধরে রাখতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। যে যেভাবে পারছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। অথচ এসব বিবৃতি-বক্তব্য়কে কেন্দ্র করে ফ্য়াসিস্টবিরোধীদের মধ্য়ে অনৈক্য়ের বিষবাষ্প দেখা যাচ্ছে। অস্ত্রের ঝনঝনানির মতো চলছে কথার কচকচানি। মার্কিন উদ্ভাবক টমাস এডিসন বলেছেন, ‘অধিকাংশ মানুষ সুযোগ হাতছাড়া করে; কারণ, সুযোগ আসে কাজের বেশে। দেখে মনে হয়, এটাও আর দশটা কাজের মতো।’ প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এই উক্তির আবেদন আজও এতটুকু কমেনি। মুখে জাতির জন্য় সুযোগ বললেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নিজ নিজ সুবিধা নিশ্চিতে ব্য়স্ত সবাই। কাজের চেয়ে কাছের মানুষের পুনর্বাসনে ব্য়স্ত প্রভাবশালীরা। কাজের নামে মুক্ত সংগঠক ও দায়িত্বশীলদের দৌড়ঝাঁপকে ‘কমিটি কমিটি’ খেলা মনে করছেন অনেকে। জুলাই বিপ্লবে হতাহতদের পুনর্বাসনে দৃশ্য়মান অগ্রগতি নেই। হুইলচেয়ার আর ক্রাচে ভর করে চিকিৎসার দাবিতে আহত শিক্ষার্থীদের রাজপথ অবরোধ করতে দেখা গেছে। কী তাজা তাজা প্রাণ! সাহসী তরুণরা দেশের জন্য় লড়ে সুচিকিৎসার অভাবে ধুঁকছে। এ থেকে জাতি কী বার্তা পাচ্ছে? এদিকে, বৈষম্য়বিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেতাদের নানামুখী তৎপরতা নিয়ে কানাঘুষায় কৌতূহল বাড়ছে আমজনতার। গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের কর্মসূচি দিয়েছিল তারা। তখন বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই কর্মসূচির আগের দিন ৩০ ডিসেম্বর রাতে রাষ্ট্রীয় এক জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’ এ কথা বলায় ঘোষিত কর্মসূচি পরিবর্তন করে আন্দোলনকারীরা। ঘোষণাপত্রের ঘোষণা থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ করে তারা। তবে সরকারি উদ্য়োগের সময়সীমা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বেঁধে দেয়। সর্বশেষ গত রোববার সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলে সেই আলোকে সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করবে। তিনি বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কথাবার্তা এবং এটি নিয়ে কাজ হচ্ছে। এ নিয়ে সামনে আরও অগ্রগতি দেখা যাবে।’ তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কবে আলোচনা হবে, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট তারিখ ঠিক হয়নি বলে জানান প্রেস সচিব। তবে শুরুতে এ উদ্য়োগের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এখন প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক ঐকমত্য় ছাড়া এরকম উদ্য়োগ নেওয়া হলো কেন?
পতিত আওয়ামী লীগের পলাতক সেনাসহ রাষ্ট্রের অসন্তুষ্ট একটা অংশ বসে নেই। অভ্য়ুত্থান ঠেকাতে হিটলারের মতো পৈশাচিক আচরণের পরও অনুশোচনা হয়নি তাদের। আত্মগোপনে থেকেও সমানতালে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। যে কোনো ইস্য়ু কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্য়র্থ প্রমাণের চেষ্টা চলছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন ব্য়ক্তি ‘খেলা হবে’ বলে দিন-রাত চিৎকার করতেন। তারা মাঠে নেই। কিন্তু খেলা থেমে নেই। অজ্ঞাত সাজঘরে বসে কলকাঠি নাড়ছেন কুশীলবরা। এরকম টালমাটাল সময়ে তাদের হাতে ইস্য়ু তুলে দিলে সরকার ও তাদের নিয়োগ কর্তাদের ভবিষ্য়তে কড়া মাশুল দিতে হতে পারে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাহসী সমন্বয়কদের হিরো মনে করে বারবার প্রতারিত দেশের সাধারণ জনগণ। যে কারণে সারাক্ষণ গণপর্যবেক্ষণে থাকেন শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেতারা। তারা কী বলছেন, কী গাড়িতে চলছেন, কোন বাড়িতে যাচ্ছেন-খাচ্ছেন সবই দেখছে মানুষ। যার যার মতো করে বুঝছে এবং নিজেদের মধ্য়ে বলাবলি করছে। সেসব কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্য়মে প্রকাশিত হচ্ছে। গণমাধ্য়ম সবসময়ের মতোই তথ্য়-প্রমাণ সংগ্রহ করছে। উপযুক্ত সময়ে ভোক্তাদের হাতে তুলে দিতে হয়তো প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্য়ে বৈষম্য়বিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিকে রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি খরচে কিংস পার্টি গঠনের দাবি করছেন অনেকে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সমন্বয়করা। কিন্তু সত্য়ের চেয়ে অনেক সময় গণধারণা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সত্য় সম্প্রতি আন্দোলনকারীরা রক্ত দিয়ে আবারও প্রমাণ করেছেন। পছন্দের হিরোদের সামান্য় স্খলনও মেনে নিতে পারে না ভক্তরা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয় দেশ ও জনগণ। কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধা অপরাধে জড়ালে মুহূর্তেই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় মানুষ। এই নির্মম সত্য় ধারণ করতে হবে সংস্কারকদের। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একবার বলেছিলেন, ‘যেসব রাজনৈতিক নেতা জনগণের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত না করে শুধু বিলাসবহুল জীবনযাপন করে, তাদের জন্য রাজনীতি করাকে আমি কঠিন করে তুলব।’ জিয়াবিরোধীরা নিজেদের স্বার্থে এই উক্তির ভুল ব্য়াখ্য়া দিয়ে যাচ্ছে আজও। পুরো কথাটা না বলে শুধু প্রচার করে, ‘রাজনীতিবিদদের জন্য় রাজনীতিকে কঠিন করে তুলতে চেয়েছিলেন জিয়া।’ যদিও সাধারণ মানুষের ভালোবাসার কাছে এসব অপপ্রচার টেকেনি। তবে রাজনীতিতে শুধু সদিচ্ছা থাকলে চলে না। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে করে দেখাতে হয়। মহৎ উদ্য়োগ হলেও জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না। তাই বলা-চলায় সরকার ও সমন্বয়কদের আরও বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্য়বস্থাকে ২০২৪ সাল প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। জাতির মননে দাগ কেটেছে। সবার প্রত্য়াশা এ দাগ থেকে ভালো কিছু হোক। বৈষম্য়বিরোধী এ চেতনা জাগ্রত রাখাটা মহান মুক্তিযুদ্ধের আকুতি। কোনো পক্ষের একগুঁয়েমিতে লাল জুলাই-আগস্টের রং ফিকে করা যাবে না। ঐক্য়বদ্ধ জাতি পারে আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদীদের দমিয়ে রাখতে। রাজনীতি হোক মানুষের কল্য়াণে। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে তথাকথিত পলিটিকস কেউ পছন্দ করে না। রাজনীতি হতে হবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে। যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো জনগণের ভোটাধিকার। উন্নয়ন, সংস্কার, ঐতিহ্য় সবকিছু ভেসে যায় অধিকারহারা মানুষ ঘুরে দাঁড়ালে। ২০২৪ সেই বার্তাই দিয়ে গেছে সবার জন্য়।
লেখক: সাংবাদিক। হেড অব নিউজ, আরটিভি