এ দেশের মানুষ বিরাট লাইন করে ভোট দিয়ে পৃথিবীতে সুনাম পেয়েছে। নারীরাও দীর্ঘ লাইন ধরে ভোট দিয়েছেন। সেসব দৃশ্যকে ইতিহাস করে দিয়ে গেছে তারা। ভোটের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ তৈরির ষোলোকলা পূরণ করে গেছে বিদায়ী পতিত সরকার। কম ভোটার উপস্থিতি, ভোটার দেখাতে কৃত্রিম লাইন, বিরোধী দলকে ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া, বের করে দেওয়া, ইভিএম মেশিনে জটিলতাসহ নানা ক্যারিকেচারে মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে তারা। এর মাশুল তাদের দিতে হয়েছে নিদারুণভাবে
খসড়া তালিকায় নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন। তাদের নিয়ে দেশে এখন মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২। এ ছাড়া প্রবাসী ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করা হয়েছে ১৩ হাজার ১৫১ জনকে। বৃহস্পতিবার সকালে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত খসড়া তালিকা অনুযায়ী ভোটার বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। দাবি-আপত্তি থাকলে ১৭ জানুয়ারির মধ্যে আবেদন করা যাবে। দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে আগামী ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। নির্বাচন কমিশন মনে করছে, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্যের দরকার আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই ভোট-ভোটারের এ আয়োজন। ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই, যা শেষ হতে সময় লাগবে ৩০ জুন পর্যন্ত। বিগত ভোটার তালিকার বিতর্ক নিরসনে পুরো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের কথাও জানানো হয়েছে। ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ওয়াদা তো রয়েছেই।
ভোট যেমন-তেমন দেশে ভোটার হয়ে পড়েছিল অবান্তর। তারা কেন্দ্রে গেলে কী, না গেলেইবা কী— এমন একটি অবস্থা কাটবে সেই আশাও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সামনে এর একটি ব্যতিক্রমের নমুনা রয়েছে। ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স এক বছর কমিয়ে ১৭ নির্ধারণ করার প্রস্তাবের মধ্যে একটি উদ্দেশ্য পরিষ্কার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ প্রস্তাব করেছেন একটি অনুষ্ঠানে। তিনি তরুণদের ভোটার করার পক্ষে। অনুষ্ঠানটিতে তিনি আশা করেছিলেন, নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই এরকম একটা বয়স সুপারিশ করবে। নির্বাচন কমিশন বিষয়টি ছেড়ে দিতে চায় রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর।
ড. ইউনূসের প্রস্তাবটি দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত মনে করা যায়। কিন্তু ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ঠিক করার মধ্যে আইনি বিষয় রয়েছে। রয়েছে রাজনৈতিক সমীকরণসহ নানা তাৎপর্যও। বিদ্যমান শিশু আইনে ‘অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু’। জাতিসংঘের মতে, জাতীয় আইনে অন্য কিছু না থাকলে ‘১৮ বছর বয়সের কম যে কোনো মানবসন্তানও শিশু’। আইনে এ কথাও আছে, এ শিশুরা কোনো বিশেষ অপরাধ করলে অপরাধের অনুসন্ধান, তদন্ত আলাদাভাবে করতে হবে। বিচারকার্য হবে শিশু আদালতে। বাংলাদেশে এবার হয়ে যাওয়া ছাত্র-গণআন্দোলনে অংশীজনদের মধ্যে বিশালসংখ্যক ছিল এই বয়সীরা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শিশু সংস্থা এ নিয়ে কাজ করছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। এবারের আন্দোলনে শিশু-কিশোর মৃত্যু নিয়ে তাদের হিসাব চলছে। আন্তর্জাতিকের বাইরে আমাদের স্থানিক হিসাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত শিশু-কিশোরের সংখ্যা শতের কাছাকাছি। এসব শিশু-কিশোরের শরীরে ছররা ও প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। যানবাহন ও স্থাপনায় দেওয়া আগুনে মৃত্যু নয়জনের। বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছররা, প্রাণঘাতী গুলি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা, গুলি এবং সরকার পতনের পর হামলা-অগ্নিসংযোগে শিশু-কিশোরের মৃত্যুর সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসেনি। এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছে কত শিশু-কিশোর। কিছু কিছু ঘটনা গল্প-ফিল্মকেও হার মানানো।
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাহারিয়ার খান আনাস (১৬) ৫ আগস্ট বাড়িতে চিঠি লিখে চলে যায় বিক্ষোভে। চিঠিতে সে লেখে, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। মৃত্যুর ভয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ।’
নিহত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী শিশুটির নাম আবদুল আহাদ (৪)। সে তখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। ২০ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে আটতলা ভবনের বারান্দা থেকে মা-বাবার সঙ্গে বিক্ষোভ দেখার সময় গুলিতে মৃত্যু হয় তার। নিহত শিশু-কিশোরদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রিয়া গোপ (৬) ও উত্তরার নাঈমা সুলতানাও (১৫) বেশ আলোচিত। শিশু হতাহতের ঘটনা সাভার-টঙ্গীসহ ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বাইরে ৩০-৩২ জন। আন্দোলন ঘিরে প্রথম শিশু মৃত্যুর ঘটনা ১৮ জুলাই। ওইদিন থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে অন্তত ৫৬ জন শিশু-কিশোর। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে আরও অন্তত ৩৩ শিশু-কিশোর নিহত হয়।
বাংলাদেশে কোনো আন্দোলন ও বিক্ষোভে এত মানুষের মৃত্যু কখনো ঘটেনি। শিশু-কিশোরের এত মৃত্যুও দেখা যায়নি। আন্দোলনে শিশু হতাহতসহ কিশোর-যুবক ছাত্রদের আগুয়ান ভূমিকাকে ঘিরে দেখতে দেখতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে, তা ধাতস্থ না করে উপায় নেই। টানা প্রায় দেড় যুগ আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরীক্ষায় ‘আদু ভাই’ স্টাইলে অনেকে অকৃতকার্য হয়েছেন। অবশ্য সেই মানের পরীক্ষা যে হয়নি, তাও সত্য। পরীক্ষার আগে কয়েক রাত জেগে পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করার ছাত্রও থাকে। যে কারণে আদুভাই-সাধুভাই বা নিয়মিত-অনিয়মিত বিতর্কে না গিয়ে সিলেবাস মতো নোট-পরামর্শ নিয়ে আগামীর পরীক্ষায় পাস করার চেষ্টা জরুরি। শিক্ষার্থীদের অবদানের কথা প্রধান উপদেষ্টা স্বীকার ও প্রচার করছেন নিয়মিত। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘যে যত পরামর্শ দেয় এটা থেকে বেরিয়ে আসার, সে পরামর্শ তোমরা গ্রহণ কোরো না। তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ, সঠিক—এটা মুঠো থেকে ছাড়বে না। যদি আমরা এ স্বপ্ন থেকে দূরে সরার কোনো কাজ করি, স্মরণ করিয়ে দেবে। আমাদের কারও কোনো ইচ্ছা নেই এ স্বপ্ন থেকে বাইরে যাওয়ার, এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা আমাদের সার্বক্ষণিক কাজ।’
বলার আর বাকি রাখেননি ড. ইউনূস। রাজনৈতিক-সামাজিক মহলেরও এর ফের না বোঝার কথা নয়। ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যে অনেক বর্তমান-ভবিষ্যৎ রয়েছে। এটি হবে রাষ্ট্রীয় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে তাদের মতামত দেওয়ার সক্ষমতার স্বীকৃতি দেওয়া। ১৭ বছর বয়সেই এ সক্ষমতা অর্জন হয়ে থাকলে শুধু রাজনৈতিক নয়, তাদের নিয়ে পারিবারিক-সামাজিক অনেক দায়ও রয়েছে। প্রশ্ন তো রয়েছেই। বিদ্যমান বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৮ বছর বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত দেশের বিদ্যমান অন্যান্য আইন সংশোধন না করে ভোটার হওয়ার বয়স পুনর্নির্ধারণ করলে আরও অনেক কিছুতে হাত দিতে হবে।
ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ থেকে এক বছর কমিয়ে কিশোরদের ভোটার করা হলে আগামী নির্বাচনে কত ভোটার বাড়বে এ বিষয়ে সরাসরি তথ্য না থাকলেও প্রতি বছর এসএসসি, দাখিল, কওমি বা সমমানের পরীক্ষার্থী ধরে হিসাব করলে একটা ধারণা মিলতে পারে। তা গড়ে ২৫ লাখ। এর সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের যোগ করলে সংখ্যাটা ৩২ লাখের ওপরে গিয়ে ঠেকে। তারা ভোটার হয়ে গেলে দেশের বিদ্যমান বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটব্যাংকে বড় রকমের নাড়া পড়বে। সংসদীয় ৩০০ আসনে ছড়ানো-ছিটানো এই ৩২ লাখ নতুন ভোটার (প্রতি আসনে গড়ে ১০ হাজার) নির্বাচনের হিসাবই পাল্টে দেবে। তারাই হয়ে উঠবে ভোটের অন্যতম নিয়ামক। যে কারণে একে ইস্যু করে নতুন সংকট তৈরির ঝুঁকিও রয়েছে।
রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ চলছে। এই শিশু-কিশোরদের ভোটার করতেই নির্বাচনে দেরি করা হচ্ছে বলে ঘোরতর সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু স্পর্শকাতর বিধায় মুখ খুলে বলাও যাচ্ছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার অভিমত দিয়েছেন পরোক্ষভাবে এর পক্ষে। আর প্রধান উপদেষ্টা তো অভিপ্রায় ব্যক্ত করে রেখেছেন আগেই। নতুন ছাত্র রাজনৈতিক দল ও জামায়াতে ইসলামী এ থেকে সুবিধা নেবে বলে বিশ্বাস বিএনপিসহ কয়েকটি দলের। তাদের ধারণা বা বিশ্বাসের অবকাশ রাখে না যে, এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তরুণরা এবার অতি উৎসাহী ভোটের জন্য। যুবকদের অনেকেও গত ১৫-১৬ বছর ধরে ভোট দিতে পারেনি। ৪০ বছরের বেশি বয়স্কদের অনেকেও কবে ভোট দিয়েছেন, ঠিকমতো মনে করতে পারেন না।
এ দেশের মানুষ বিরাট লাইন করে ভোট দিয়ে পৃথিবীতে সুনাম পেয়েছে। নারীরাও দীর্ঘ লাইন ধরে ভোট দিয়েছেন। সেসব দৃশ্যকে ইতিহাস করে দিয়ে গেছে তারা। ভোটের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ তৈরির ষোলোকলা পূরণ করে গেছে বিদায়ী-পতিত সরকার। কম ভোটার উপস্থিতি, ভোটার দেখাতে কৃত্রিম লাইন, বিরোধী দলকে ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া, বের করে দেওয়া, ইভিএম মেশিনে জটিলতাসহ নানা ক্যারিকেচারে মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে তারা। এর মাশুল তাদের দিতে হয়েছে নিদারুণভাবে। এখন ভোটের প্রতি আগ্রহের এ সন্ধিক্ষণে আবার নতুন কোন গোল বাধে নানা সংশয় মানুষের মনে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন