গাজার সাম্প্রতিক খবর জানতে শনিবার সকালে আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ করি। আমার বিধ্বস্ত মাতৃভূমির এখন কী অবস্থা, তা জানতে আমাকে অনেকক্ষণ খুঁজতে হলো। কিন্তু বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আমরা গাজার যে বর্তমান হাল শুনতে পাই, তা একদম বছরখানেক আগে এ অঞ্চল থেকে পাওয়া সংবাদের মতোই মর্মস্পর্শী। গাজার মানুষ এখনো সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে কাঁদছে, এ আশায় যে কেউ তাদের আকুতি দেখতে পাবে।
উত্তর গাজার বেইত লাহিয়া অঞ্চলের কামাল আদওয়ান হাসপাতালের পরিচালক ড. হুসাম আবু সাফিয়া গত তিন মাস যাবৎ বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আসছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হাসপাতালটি অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং জরুরি মালপত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। হাসপাতালে বোমাবর্ষণ এবং এর আশপাশে অবস্থানরত বেশ কিছু মানুষকে হত্যা করেছে তারা। এমনকি হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার এবং চিকিৎসারত বেশ কিছু রোগীকেও আহত করেছে।
গত ১২ ডিসেম্বর একটি ভিডিও প্রকাশ করেন ড. আবু সাফয়া। সেখানে আক্ষেপ করে বলেন, ‘হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা করার মতো অবস্থা এখন নেই। আমরা শুধু মৌলিক পর্যায়ের কিছু সেবা দিতে সক্ষম হচ্ছি। আমি আশা করছি কেউ আমার অবেদন শুনবেন। হাসপাতালে যারা আটক আছে, তাদের অনুরোধ একটি মানবিক করিডরের ব্যবস্থা করা হোক, যার দ্বারা প্রয়োজনীয় সামগ্রী এখানে প্রবেশ করতে পারে। নতুবা কামাল আদওয়ান হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
কিন্তু তার সাহায্যের এ আবেদন কেউ শুনল না। ২৬ ডিসেম্বর ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে হাসপাতালের সামনে এক নারী নিহত হন। আরও নিহত হন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ সামুর, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান ইসরা আবু জাইদাহ, স্বাস্থ্যকর্মী আবদুল মজিদ আল-ইশা ও মাহের আল-আজরামি এবং হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কর্মী ফারেজ আল-হুদালি। বোমাবর্ষণে মাথার খুলি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় নার্স হুসান দাবুসের। গত শুক্রবার ইসরায়েলি সেনারা হাসপাতাল আক্রমণ করে ৩৫০ জন রোগীকে জোরপূর্বক হাসপাতাল থেকে বের করে দেয় এবং হাসপাতালে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফেরার পথে তারা ড. আবু সাফিয়াসহ কিছু চিকিৎসাকর্মীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
ভয়াবহ এ সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্র এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছাড়া কোনো বিদেশি সরকার বা শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এ ঘটনায় কোনো ধরনের আলোকপাত করেনি। নৃশংস হামলা, হাসপাতালে ধ্বংসযজ্ঞ, রোগী ও চিকিৎসাকর্মীদের হত্যার বিষয়গুলো স্বাভাবিকীকরণে ইসরায়েল স্পষ্টতই সফল হয়েছে।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তর গাজার শেষ অর্থোপেডিক সার্জন ড. সাইদ জুদেহকে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। তিনি জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে প্রায় অচল অবস্থায় থাকা আল আওদা হাসপাতালে কাজ করতেন। চিকিৎসাক্ষেত্র থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন বেশ আগেই। কিন্তু দেশের এ করুণ পরিস্থিতিতে চিকিৎসক সংকট থাকায় মানবিক মূল্যবোধের কারণে তিনি কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। ইসরায়েল তালিকা করে এমন ব্যক্তিদের হত্যা করে যাচ্ছে। তাকে মেরে ফেলার এক সপ্তাহ আগে তার সন্তান মজিদকে মেরে ফেলে ইসরায়েলি সেনারা। তারপরও নিজের কাজে বিরতি দেননি ড. জুদেহ। পরিণামে নিজের মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয় তাকে।
উত্তর গাজা অঞ্চলকে জনশূন্য করার উদ্দেশ্যে ইসরায়েল সেখানে স্বাভাবিক নাগরিক জীবন ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তারা হাসপাতালের মতো সেবামূলক অবকাঠামোগুলো লক্ষ্য করে আক্রমণ করছে। যে কয়েকটা চিকিৎসাকেন্দ্র এখন অবধি কার্যকর ছিল, এগুলো ছিল এ অঞ্চলের জনজীবনের অত্যাবশ্যকীয় অংশ। চিকিৎসাকর্মীদের হত্যার পাশাপাশি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে উত্তর গাজায় প্রাণরক্ষার কাজে নিয়োজিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা দল এবং অ্যাম্বুলেন্সগুলোর কাজে বাধা দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ওপর আক্রমণ করে হত্যা করা হচ্ছে।
শুধু উত্তর গাজার দুর্দশা অগ্রাহ্য করা হচ্ছে তাই নয়, পুরো গাজাই এখন দুর্ভিক্ষের কবলে। মানবিক সংস্থাগুলোর পাঠানো সাহায্য এবং বাণিজ্যিক ট্রাকগুলোর গাজার অভ্যন্তরে প্রবেশ সীমিত করে রাখছে ইসরায়েল। ক্ষুধা সর্বত্র বিদ্যমান। অধিকাংশ মানুষের পক্ষে খাদ্যের ব্যবস্থা করা দুষ্কর। যে গুটিকয়েক মানুষের পক্ষে ব্যবস্থা করা সম্ভব, তারাও বাজার থেকে কেনার মতো খাদ্যদ্রব্য পাচ্ছেন না।
আমার এক নিকটাত্মীয় জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থার শিক্ষক। তিনি সম্প্রতি গাজার মধ্যাঞ্চলের একটি শহর দেইর আল-বালাহতে গিয়েছিলেন, তার অসুস্থ এবং উদ্বাস্তু বোনকে সাহায্য করতে। যে ১৫ দিন তিনি সেখানে ছিলেন, কোনো রুটি খেতে পাননি। ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্নার শব্দে এক রাতও ঘুমাতে পারেননি। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তিনি ওই পরিবারের শিশুদের রাতে ঘুমের আগে গল্প বলতেন, যেন তারা পেটের ক্ষুধা ভুলে থাকতে পারে।
খাদ্য ছাড়াও আশ্রয়স্থল নির্মাণের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহও বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ঠান্ডার কারণে চারটি শিশু এ মাসে প্রাণ হারিয়েছে। দুর্ভিক্ষ আর শীতের প্রকোপের মাঝে আবাসস্থল আর তাঁবুতে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
শেখ রাদওয়ান অঞ্চলে আমার দূর সম্পর্কের আরেক আত্মীয় থাকেন, ড. মুহাম্মদ আল-নৈরব। ৭ ডিসেম্বর ইসরায়েলি হামলায় তার স্ত্রী ও তিন কন্যা প্রাণ হারায়। তিন কন্যার ভেতর দুজন ছিল ডাক্তার। মানুষের প্রাণ বাঁচানো ছিল তাদের পেশা। আর কোনো প্রাণ তারা বাঁচাতে পারবে না।
আমার ভাগ্নি নুর তাকে সান্ত্বনা জানাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমাকে সে জানায়, পরিবারহারা এ মানুষটির বেদনা কারও পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। নুর আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বিশ্ব কবে আমাদের আর্তনাদ শুনতে পাবে? কবে তারা আমাদের কষ্ট দেখতে পাবে? এ গণহত্যার সমাপ্তি কবে? আমরা কি মানুষ না?’ আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি।
ড. আল-নৈরবের বাড়ি থেকে একটু সামনে ঘর ছিল সাংবাদিক ইমান শান্তির। স্বামী আর তিন শিশুসন্তান নিয়ে তার সুখী পরিবার। ১১ ডিসেম্বর ইসরায়েলের বোমা হামলায় তারা সবাই মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি ভিডিওতে ইমান বিশ্বকে দুটো প্রশ্ন করেছিল, ‘এত বড় পরিসরে আন্তর্জাতিক ব্যর্থতা কেমন করে সম্ভব? গাজার মানুষের রক্তের মূল্য কি এতটাই সস্তা?’ তার এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যেমন স্বাভাবিকীকরণ হয়ে গেছে, তেমনই স্বাভাবিক হয়ে গেছে তাদের যন্ত্রণা আর মৃত্যু। এ নীরবতা তাদের কষ্টকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ করে দিচ্ছে, তাদের মনুষ্যত্ব অবজ্ঞা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এত কষ্টের পরও ফিলিস্তিনিরা এখনো স্বাভাবিকতার কোনো রূপ দেখতে পাচ্ছে না। ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ শুধু গাজার ভেতরেই নয়, গাজার বাইরেও অনেকে হারিয়েছে। নিজ দেশের সীমানার বাইরেও তাদের বেদনার ছাপ দৃশ্যমান। অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিরাও গণহত্যার আতঙ্কের রেশ ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
মিশরে আশ্রয় নেওয়া সাংবাদিক ডায়ানা আল-মুগরাবি ৩ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজার অধিবাসীদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলো একবার মৃত্যুবরণ করে না, তারা বারবার মৃত্যুবরণ করে। আমার পরিচিত একজন মারা গেছেন। যেদিন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেদিন তিনি একবার মারা গেছেন। যেদিন আমার কাছে থাকা তার হাতঘড়িটা ভেঙে গেছে, সেদিন তিনি আবার মারা গেছেন। যেদিন তার চায়ের পেয়ালাটা ভেঙে গেছে, সেদিন তিনি আবারও মারা গেছেন। যখন কেউ তার কৌটায় থাকা ওষুধগুলো ফেলে দিয়েছে, তখন তিনি আবারও মারা গেছেন। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করার পর সবাই যখন ফের তাকে ভুলে গেছে, তখন তিনি আবারও মারা গেছেন। যাদের আমরা ভালোবাসি, তারা বারবার মরতে থাকে, তাদের মৃত্যুর শেষ নেই।’
৪৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে গাজায়। এরাও বারবার মরতে থাকবে। কিন্তু পৃথিবী তাদের ভুলতে বসেছে। ১৫ মাস হয়ে গেছে এই গণহত্যার, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদকারী এবং মানবাধিকার কর্মীরাও হাঁপিয়ে উঠেছে। অগত্যা চুপ হয়ে যাচ্ছে অসহায়দের সমর্থক গোষ্ঠী। কিন্তু একজন শরণার্থী হিসেবে আমি আশা হারাতে রাজি নই। স্বাধীনতাকামী চেক প্রধানমন্ত্রী বাকলাভ হাভেল বলেছিলেন, ‘আশা করা এবং আশাবাদী হওয়ার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। কোনো কিছুর পরিণাম ভালো হবে, এমনটা চিন্তা করেন আশাবাদীরা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আশা করার অর্থ হলো, পরিণাম যেটাই হোক; একটা সত্যের প্রতি বিশ্বাস রেখে তা কায়েম করতে চাওয়া।’ আমি তাই আশা করি, এ কষ্টের সমাপ্তি ঘটবে।
অন্যায় ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলা এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে অপরাধীদের বিচার বিশ্ববাসীর জন্য শুধু দৃষ্টান্তই নয়, একই সঙ্গে তা ইসরায়েলের গণহত্যার বিচারের প্রক্রিয়া হিসেবে অনুকরণীয়। আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়ার এটা মোক্ষম সময়। অপরাধীদের ন্যায্য বিচার করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং তৃতীয় প্রজন্মের একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে ভাষান্তর করেছেন অ্যালেক্স শেখ