আমলারা তাদের চরিত্রগত কারণেই কর্তৃত্ব ফলান। তা তালিম করে জনগণের ওপর নিজেদের অবস্থান বজায় রেখে। জনগণের সরকার হলে, জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। আর অনির্বাচিত স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন শাসকরা সবসময় আমলানির্ভর হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিক-জনতাও অংশ নেয়
জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো টাইপের স্লোগান শেষ হয়ে যায়নি। আনাচে-কানাচে, চিপাচাপায় মৃদুমন্দতে এখনো আছে। খুব বেশি শুনতে মানুষ আগুনের কথা পছন্দ করে না। পাটের গুদাম, শেয়ারবাজার, বঙ্গবাজার, বিভিন্ন মিল-ফ্যাক্টরিতে তারা আগুন দেখতে দেখতে আগুন শুনতেও ভয় পায়। আবার সহ্যও করে। তাই বলে সব আগুন মশাল বা মিছিলের প্রতীকী আগুনের অংশ নয়। জেরও নয়। আগুন সম্পর্কে সাবধানতার অংশ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। বাস্তবে দেবালয়ে এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড না হলেও সচিবালয়ে ঘটে গেছে।
বাংলাদেশের ৫৩-৫৪ বছরের ইতিহাসে এটি এরই মধ্যে একটি রেকর্ড। প্রশাসনের বা রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ নথি ধ্বংস হয়ে থাকলে বাংলাদেশ কতটুকু সুরক্ষিত—এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। আবার ক্ষমতা আরোহণের পাঁচ মাস পরও শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণের নথি আগুনে পুড়ে গেছে বললে তা গ্রাহ্য হওয়ার নয়। বরং তা হবে হাসির আইটেম। যেমনটি অবিরাম করেছে বিগত সরকার। কোথাও আগুন লাগলে সেটিকে বিএনপি-জামায়াতের কাণ্ড বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। মানুষ হেসেছে। বিনোদিত হয়েছে। মনে পড়ে রিজার্ভ লুটের পরও বাংলাদেশ ব্যাংকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। আবার ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনের রেজাল্টশিট এবং নির্বাচনের খরচপাতির হিসাব নিয়ে টানাটানি হতে থাকলে একপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনেও আগুন লাগে। মানুষ বাধ্য হয়ে এসব সার্কাস উপভোগ না হলেও মহাশয় হয়ে সয়েছে। বমি করেনি। উগরে ফেলতেও পারেনি।
আগুনের হাত-পা বা গ্যারান্টি থাকে না। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে বুধবার রাত ১টা ৫০ মিনিটে। ওই ভবনে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর আছে। আগুনে ছয়, সাত ও আটতলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন নেভাতে গিয়ে সোহানুর জামান নামে এক অগ্নিনির্বাপণকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। পরদিন সকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘তদন্ত করে জানা যাবে, এ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোনো নাশকতার ঘটনা আছে কি না।’ অন্যদিকে স্থানীয় সরকার, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেসবুকে এক বার্তায় লিখেছেন, সরকারকে অকার্যকর প্রমাণ করতেই এ আগুন লাগানো হয়েছে।
সচিবালয়ে ঢোকার ফটক পাঁচটি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার ফটক মাত্র দুটি। কিন্তু ওই দুই ফটক দিয়েও ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢুকতে সমস্যা হয়েছে। সচিবালয়ের ৪ নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি ভেঙে গেছে। সচিবালয়ে কোনো দাহ্য পদার্থ থাকে না। সচিবালয়ের কয়েকটি দপ্তরে কাঠ দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছে, যা থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সৌন্দর্যবর্ধন মানেই সরকারের কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সচিবালয়কে কেন ‘অগ্নিখামারে’ পরিণত করা হয়েছে? ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সদস্য বলেছেন, আগুন নেভাতে গিয়ে তাদের পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের দুটি টার্নটেবল লেডারের ভেতরে ঢুকতে পেরেছে।
অগ্নিকাণ্ডটি নিছক দুর্ঘটনা না নাশকতা, সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা যে ইঙ্গিত করেছেন, সেটাও বিবেচনাযোগ্য। অগ্নিনির্বাপণ দলের সহায়তাকারী নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাও বলেছেন, এ ঘটনা পরিকল্পিতভাবে কেউ ঘটিয়ে থাকতে পারেন। সচিবালয়ে যখন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটল, তার আগে থেকে জনপ্রশাসনে অস্থিরতা চলে আসছিল বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যকার দ্বন্দ্বে। বুধবার রাতের অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। ১৭ ডিসেম্বর প্রথম সাংবাদিকদের কম পড়াশোনা জানা বলে অভিযোগ করার পর থেকেই সব সাংবাদিকের সঙ্গে হট্টগোল শুরু হলে সংস্কার কমিটির প্রধান মুয়ীদ চৌধুরী তার পক্ষাবলম্বন করেন। এর পর থেকে প্রশাসনের ২৬ ক্যাডারের সব ক্যাডার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মূলত আলোচিত সংস্কারের পক্ষে কোনো পক্ষকে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না, একমাত্র সমন্বয়কদের কয়েকজন ছাড়া। সংস্কারের যেসব প্রেসক্রিপশন নিয়ে বিতর্ক, সেটাকে দেশের আমলাতন্ত্রকে জামায়াতীকরণের বিরুদ্ধে সব দল-মতের সচিবদের একটা সম্মিলিত অবস্থান হিসেবেই বর্ণনা করেছেন একাধিক বিসিএস ক্যাডার। এ কারণে পুরো কমিশনের প্রধানকেই পদত্যাগের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে আমলাদের সব প্ল্যাটফর্মে। এ সময়ের মধ্যে প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি প্রধান মুয়ীদ চৌধুরীকে অপসারণ করতে হবে। নইলে এ কমিটির রিপোর্ট আগেরগুলোর মতো হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই ৪৮ ঘণ্টার অর্ধেক পার না হতেই অগ্নিকাণ্ড। ভাবনার খোরাক এখানেও।
সচিবালয়ে যে-কারও ঢোকা এত সোজা নয়। চুরি করে দিনের বেলা তো দূরে থাক, রাতে ঢুকতে চেষ্টা করলে গুলি খাবে নিশ্চিতভাবে। চারপাশে পুলিশ, আনসার, আর্মি ঘিরে রাখে, দেয়ালের চারদিকে। কিছুদূর পরপর ছোট ছোট অস্থায়ী নিরাপত্তা চৌকি। চারদিকে হাই-রেজল্যুশনের ক্যামেরা। সেই সচিবালয়ে আগুন দেওয়া কঠিন কাজ। কিছুটা অবিশ্বাস্যও।
কোথাও অগ্নিকাণ্ড হলে বিশ্বব্যাপী তার তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় ফায়ার ডিপার্টমেন্টের ওপর। তারা খুঁজে বের করে আগুনের উৎস কী, আগুন কীভাবে লাগল। এমনকি পুলিশও কাজ শুরু করে ফায়ার ডিপার্টমেন্টের ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট ধরে। কারণ, ফায়ার ডিপার্টমেন্টেরই এই এক্সপার্টিজ থাকে। কিন্তু সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড তদন্তে উচ্চপর্যায়ে কমিটিতে এর ব্যত্যয় ঘটেছে।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সরকারি কর্মচারীরা হিসাবে খুব পাকা। তারা হিসাব নিয়ে নয়, অন্যের হিসাবে টান দিতে অভ্যস্ত। তাদের সম্পদের হিসাব জমার সময় ছিল ৩০ নভেম্বর। তারপর সেটা বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়। উত্তেজনাকর সময়ে আবার সেটা বাড়িয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কি অনেক সম্পদ যে হিসাব বের করা কঠিন। নাকি তেমন কোনো সম্পদ নেই, যার হিসাব দেওয়ারই দরকার নেই। অভ্যুত্থানের সাড়ে চার মাস পরও আমলাদের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন আসেনি। উপরন্তু জনগণের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর যে প্রবণতা ৫ আগস্টের আগে ছিল, তা অব্যাহত আছে। সচিবালয়ে তাদের দুদিনের যে আন্দোলন মানুষ দেখল, তা কতটা জনস্বার্থে আর কতটা নিজেদের স্বার্থে, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
জনপ্রশাসন বিষয়ে আলোচনা সভায় উঠে আসে কথাগুলো। আমলারা তাদের চরিত্রগত কারণেই কর্তৃত্ব ফলান। তা তালিম করে জনগণের ওপর নিজেদের অবস্থান বজায় রেখে। জনগণের সরকার হলে, জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। আর অনির্বাচিত স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন শাসকরা সবসময় আমলানির্ভর হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিক-জনতাও অংশ নেয়। ছাত্রদের সামান্য চাহিদাও মেটেনি। প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গলাকাটা চলছে আগের মতো। শ্রমিকরা দ্রব্যমূল্যের চাপে দিশেহারা হয়ে রাস্তায় নামলে তাকে নৈরাজ্য বলা হচ্ছে। কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমলাদের দুদিনের হুমকিতে সরকার কাবু হয়ে গেল। গতকালের মন্ত্রিপরিষদ সভায় সরকার তাদের দাবিগুলো মেনে নিল। যেন এ আমলারাই জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানটির প্রধান ভূমিকায় ছিল...!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ৫ আগস্টের আগে জনগণ যে তিমিরে ছিল, এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেল। ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪-এর রাতে সচিবালয়ে ছাত্রদের রাজনীতিতে নামার মূল কেন্দ্রবিন্দু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কক্ষগুলো পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’—সচিবালয়ে আগুন লাগার এ অভিজ্ঞতার কারণে অল্প চাপেই ছাত্রনেতাদের এখন শঙ্কিত থাকতে হতে পারে। শঙ্কা কাটিয়ে সংগঠন গোছানো এখন তাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হবে।
পরিবেশ তৈরি করার আগেই যারা দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন তারা বর্তমান সংকটকে কীভাবে দেখছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অতীতের সংকট মোকাবিলায় তাদের ব্যর্থতাগুলো সামনে আসতে পারে এবং সে কারণে নতুন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা তাদের অনুকূলে যাওয়ার গ্যারান্টি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান করার কোনো পরিস্থিতি নেই। নির্বাচন কমিশনকে যারা সহায়তা করে যেমন বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি এবং আনসার—তাদের অবস্থা অগোছালো এবং তারা বর্তমানে অকার্যকর।
পদ-পদোন্নতির দাবিতে ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪-এ এক ঘণ্টার ‘কলমবিরতি’র মাধ্যমে প্রকাশ্যে আন্দোলনে নেমেছেন ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। প্রশাসনের সব পদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য রাখার দাবিতে গত রোববার (ডিসেম্বর ২২, ২০২৪) সচিবালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বড় জমায়েতের এক দিনের ব্যবধানে কলমবিরতির কর্মসূচি পালিত হয়। অন্যদিকে জনপ্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা তার পরের রাত ডিসেম্বর ২৫, ২০২৪-এ যৌথ সভা ডাকেন। ওই কক্ষেরও ক্ষতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবর। সংস্কার কমিশনে বিরক্ত কর্মকর্তারা আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। তারা কমিশনের চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি করেছেন।
প্রতিবাদ সভায় ডিসি, এডিসি ও ইউএনও যোগ দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক অদ্ভুত ঘটনা, আবারও বিভাজনের রাজনীতি ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক দল এবং ছাত্ররা বলেছে, শুধু নির্বাচনের জন্য বিপ্লব হয়নি। সংস্কার আগে করতে হবে। অন্যদিকে বড় দলগুলো বলছে, দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই। ডিসেম্বর ২৬-এ বেসামরিক প্রশাসনের অবস্থা পুরো জাতি দেখেছে। পুলিশ এখনো ফ্যাসিজমের ঘোরের মধ্যে আছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন