বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ২০ চৈত্র ১৪৩১
অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৮ এএম
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা জাতিসত্তার মেরুদণ্ড

শিক্ষা জাতিসত্তার মেরুদণ্ড

একটি জাতির মেরুদণ্ড মূলত তার শিক্ষাব্যবস্থা। ঘনঘন মত বদল বা বিষয় বদলে রাজনীতি অভ্যস্ত হতে পারে; কিন্তু শিক্ষার জন্য ভয়াবহ। যে সরকার পনেরো, ষোলো বছর ধরে দেশের ঘাড়ে ভর করেছিল, তার কাছে আমাদের প্রত্যাশার মূল্য ছিল না। তারা তাদের ইতিহাস তাদের মতো করে বলে-পড়ে শিখিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। তাদের ভয়াবহ একপেশে শাসনের ফলে যে সমস্যা তাই আজ হা করে গিলতে চাইছে সবকিছু।

আজকাল ছেলেমেয়েদের ধৈর্য খুব কম। এই ধৈর্যহীনতা তৈরি করেছে প্রযুক্তি। যখন সীমাবদ্ধ প্রযুক্তি ছিল, তখন আমাদের আশ্রয় ছিল পুস্তক। মানুষ বই পড়ত, বই ছিল তাদের ধ্যানজ্ঞান। এর ভেতর এক ধরনের শান্তি ছিল। মনে রাখতে হবে, দর্শন, শ্রবণ আর পাঠ—এই তিনের সমন্বয় আছে পাঠে। এখন এর যে কোনো একটা কাজ করে। দেখা মানে দ্রুত দেখতে থাকা। তারপর সেখান থেকে সরে অডিওতে যাওয়া। এই যে টানাটানি বা দোলাচল এতে শান্তি নেই। শান্তিহীনতায় ভুগতে ভুগতে আজকের প্রজন্ম বই পড়তে ভুলে গেছে। তারা জানে না পাঠে নিমগ্ন থাকা মানে এক ধরনের মন সংযোগের ব্যায়াম। এই যে পাঠ অনীহা, এর ফলে আজ ‘আজই চাই’ জাতীয় এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়ে গেছে। নবীনদের সবসময় দোষারোপ করার চাইতে তাদের দিকে মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে। বলতে পারি সময় বয়ে যাচ্ছে। এখনই তাদের শিক্ষায় না ফেরাতে পারলে অপমান আর অবমাননার যুগ শেষ হবে না। মনে রাখা ভালো, এভাবে মেধা শ্রম আর সময়ের অপচয়ে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছি মাত্র। নিয়ন্ত্রণ বা জবরদস্তি যে ভালো ফল বয়ে আনে না সেটা আমরা জানতাম এবং দেখতাম, কিন্তু মানতাম না। অথচ আজকের বাংলাদেশে তারুণ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, জোর করে কিছু গেলানো যায় না। বরং জোর করে ইতিহাস গেলালে তাতে যে বদহজম হয়; তার ফলাফল ভয়াবহ।

অথচ আমাদের দেশ গঠনে তারুণ্যের বিকল্প নেই। তাদের সহযোগিতা আর অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনোভাবেই সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে না। বলা উচিত, তারাই হবে চালিকাশক্তি। এই চালিকাশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে শিক্ষার মূল বিষয়ে ফিরতে হবে। অচিরে তা না হলে এগোতে পারব না আমরা। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে আসলে শিক্ষা কী?

শিক্ষা বিষয়ে আমরা যা ভাবি তা কিন্তু কেবল এক ধরনের সীমাবদ্ধ ভাবনা। অথচ কবি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন মূলত চিন্তা বা ভাবনার স্বাধীনতা, হৃদয়ের স্বাধীনতা এবং ইচ্ছা শক্তির স্বাধীনতা—এই তিন ধরনের স্বাধীনতার ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। শান্তিনিকেতনের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ধারণাকে ব্যাখ্যা করে উল্লেখ করেছেন, এই স্বাধীনতা কেবল মনের প্রসারতার ওপর নির্ভর করে। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন, মানুষের পূর্ণতা প্রাপ্তির এই ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষার দুটি পরস্পর সংযুক্ত উপাদান আছে—একটি হলো ব্যক্তিগত পূর্ণতা ও অন্যটি সামাজিক পূর্ণতা। এই দুই ধরনের পূর্ণতা একে অপরের প্রতিযোগী নয়, বরং সহযোগী। একটি অন্যটির পরিপূরক।

‘যাহা-কিছু জানিবার যোগ্য তাহাই বিদ্যা, তাহা পুরুষকেও জানিতে হইবে, মেয়েকেও জানিতে হইবে—শুধু কাজে খাটাইবার জন্য যে তাহা নয়, জানিবার জন্যই। মানুষ জানিতে চায় সেটা তার ধর্ম; এই জন্য জগতের আবশ্যক অনাবশ্যক সকল তত্ত্বই তার কাছে বিদ্যা হইয়া উঠিয়াছে। আর গ্রন্থাগারের কাজই হলো সব তত্ত্ব, তথ্য সংগ্রহ, বিন্যাস ও সরবরাহ করা। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, এখানে শিক্ষার সামাজিক ভূমিকার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। জ্ঞান সঞ্চারের ক্ষেত্রে কোনো জাতি বা ধর্মের বিচার চলে না। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সকল জ্ঞানে সকলের অধিকার আছে। কারণ এই জ্ঞান একক ব্যক্তি বা দেশের সৃষ্ট নয়। পৃথিবীর সকল দেশের সর্বকালের সব মানুষের সৃষ্ট জ্ঞানের ধারা জ্ঞানসমুদ্র সৃষ্টি করেছে।’ (গ্রন্থাগার: রবীন্দ্রনাথ ; অমিয় চক্রবর্তী)

জ্ঞানকে বিকশিত করার জন্য যে কোনো একমুখিনতা থেকে আলাদা করতে হয়। একের ভেতরে বহু, না বহুত্বের ভেতরে এক—সে তর্কে না গিয়েও বলা যায় আমাদের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য আর ভবিষ্যৎ ভাবনাই তৈরি করবে সঠিক পথ।

তাহলে আমাদের পথ একটাই। বিকৃত ইতিহাস আর মিথ্যা থেকে মুক্তি। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রজন্মের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ; তারা যদি সঠিকভাবে দেশ ও সংস্কৃতিকে না জানে বাংলা মায়ের দুঃখ-কষ্টের শেষ হবে না। রাজনীতি বা সরকার এসব জায়গায় যতটা প্রভাবশালী, তার চাইতে অনেক বেশি প্রভাবশালী আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস। ইতিহাসের আলোকে পথ নির্মাণ করা গেলে মানুষ আর কোনোদিন পথ হারায় না। বারবার লড়াই সংগ্রাম কিংবা রণংদেহীতায় শক্তি ব্যয় আর নিজেদের বল হারানো ছাড়া লাভ কিছু থাকে না। কষ্টার্জিত স্বাধীনতা বাঁচাতে ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে তারুণ্যকে শিক্ষায় ফিরিয়ে নিতে হবে।

শিক্ষা মানুষের চিন্তা ও মননকে বিকশিত করে। এটি মানুষকে যুক্তিবাদী ও বিশ্লেষণধর্মী হতে শেখায়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারে। সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সমস্যাগুলোর সমাধান এবং নতুন নতুন ধারণা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি শিক্ষিত মানুষ কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার। শিক্ষিত মানুষ নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে পারে; একটি সফল পেশাগত জীবনের মাধ্যমে আর্থিক সাফল্য অর্জন করতে পারে। শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জিত হয়, যা কর্মক্ষেত্রে মানুষের যোগ্যতা বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির গুরুত্ব বাড়ছে এবং শিক্ষিত মানুষই এ প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

শিক্ষা নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে। একজন শিক্ষিত মানুষ শুধু জ্ঞান অর্জন করে না, বরং মানবিক গুণাবলিও অর্জন করে। শিক্ষা মানুষকে সহমর্মী, ন্যায়পরায়ণ এবং সৎ হতে শেখায়। একটি শিক্ষিত সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমে আসে এবং শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে ওঠে। শিক্ষাই সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে তোলে, যা একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য।

আমরা তেমনভাবে গড়ে ওঠা একটি শিক্ষিত জাতির আশায় আছি। আশায় থাকব।

লেখক: সিডনিপ্রবাসী ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুর্ঘটনায় নিহত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহ-মুখপাত্র

প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধিকে মার্কিন উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন

ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হচ্ছে

সভাপতিকে মারধর করায় ছাত্রদল নেতা বহিষ্কার

কাল বিটিভিতে রশীদ সাগরের উপস্থাপনায় ‘প্রিয় শিল্পীর প্রিয় গান’

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে স্পিড গান ব্যবহার করছে হাইওয়ে পুলিশ

ঈদ আনন্দ মিছিলে মূর্তি প্রদর্শনী নিয়ে জামায়াতের বিবৃতি

আমরা সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে থাকি : যুবদল নেতা আমিন

ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনে আবারো রাজপথে নামতে হবে : বকুল 

ফুচকা খেয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৩

১০

বিএনপি নেতা খুনে গ্রেপ্তার ৪, পুলিশের সংবাদ সম্মেলন 

১১

মসজিদের সাইনবোর্ডে ভেসে উঠল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান

১২

চট্টগ্রামে বিএনপি নেতাদের ঈদ পালনে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি

১৩

মামলা নেন না ওসি, বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কৃষক

১৪

অবসরের পর কী করবেন, জানালেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম

১৫

উৎপাদন খরচ উঠছে না পোলট্রি খামারিদের : বিপিএ

১৬

‘স্বৈরাচার সরকার ক্রীড়াঙ্গনকে দলীয়করণ করেছিল’

১৭

ধানক্ষেতে পানি দেওয়া নিয়ে কোন্দল, কৃষককে পিটিয়ে হত্যা

১৮

ওলমোর বিতর্কিত নিবন্ধন নিয়ে আবারও বিপদে বার্সা

১৯

ছোট্ট মেয়েটি এখনো জানে না তার মা-বাবা বেঁচে নেই

২০
X