রাজনীতি-অর্থনীতি, ধর্ম-কর্ম সবখানেই টেনে আনতে ছিঁড়ে যাওয়ার দশা। প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের এক পা এগোবার খবরের মধ্যেই দেড় পা পেছানোর কাণ্ডকীর্তি। দিনের প্রথমার্ধের সুখবর—কিছু দরকষাকষির মধ্যেও ফেব্রুয়ারির শেষে আইএমএফের কিস্তির ৬৫ কোটি ডলার পাবে বাংলাদেশ। আর দিনের শেষভাগে ঢাকার কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় জিম্মি নাটকের কুখবর। এভাবে গন্ডগোল পাকাতে লাগাতার নানা ডিভাইড অ্যান্ড রুলে দেশকে অস্থির করার আয়োজকরা সেভাবে সাফল্য না পেলেও আশা ছাড়ছে না। নানা ফাঁদ পেতেও আলেম-ওলামা এবং তুলনামূলক একটু বেশি ধর্মাশ্রয়ীদেরও চটানো যায়নি। তাদের যারপরনাই সহিষ্ণুতা এবং ম্যাচিউরিটির মাঝেই বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে হত্যাকাণ্ড। তাবলিগ জামাতের দুগ্রুপের সহিংসতায় পড়ল কয়েকটি লাশ। আহত অনেকে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তখন মিশরের কায়রোতে ডি-এইট সম্মেলনে রাজসম্মানিত অতিথি। এ ফোরামে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সংখ্যাই বেশি। নোবেল লরিয়েট ছাড়াও নানা অর্জনের কারণে সম্মেলনটির আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তিনি। গত মঙ্গলবার মিশরের রাজধানী কায়রোতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ডি-৮-এর ১১তম শীর্ষ সম্মেলনে তার বক্তব্যের ব্যাপক সমাদর উঠে এসেছে বিশ্বগণমাধ্যমে। একই সময়ে তাবলিগ জামাতের গন্ডগোলও বিশ্বগণমাধ্যমের আইটেম। ডি-এইট সম্মেলনের বক্তব্যেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মধ্যভাগের আগে বাংলাদেশে নির্বাচন দেওয়ার পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি ঘোষণায় থ্যাঙ্কস এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। অন্তর্বর্তী সরকারের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং থেকে।
ডি-এইট সম্মেলনের উদ্বোধনীতে সভাপতি হিসেবে বক্তব্যও দেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। তার ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পর আরেকটি অর্জনে অভিষিক্ত তিনি। বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্বের তালিকায় শুরুর দিকে তার নাম। সম্প্রতি আম্মানের দ্য রয়েল ইসলামিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টারের প্রকাশিত ২০২৫ সালের বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিম ব্যক্তিত্বের তালিকায় ৫০ নম্বরে ড. ইউনূসের নাম। অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান এবং বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী মুসলিমদের তালিকায় তার নাম। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রভাব ও অবদান পর্যালোচনা করে প্রকাশিত হয় ‘দ্য মুসলিম ৫০০: দ্য ওয়ার্ল্ডস ৫০০ মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল মুসলিমস’, যা ১৬ বছর আগে থেকে প্রকাশ করা হচ্ছে। এ তালিকার ড. ইউনূসের দেশেই তাবলিগ জামাতের সংঘর্ষ-প্রাণহানি। তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম।
এদিকে, দেশীয় পরিমণ্ডলে নির্বাচন নিয়ে আচ্ছা রকমের রাজনৈতিক জটিলতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউনূস নিজে অরাজনৈতিক বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু তার যত কাজ রাজনীতিকদের দিয়ে এবং নিয়ে। তাদের আয়ত্ত করতে, নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টায় তার অন্ত নেই। কিন্তু কতটা পারছেন তা গোপন থাকছে না। বিতাড়িত আওয়ামী লীগ তার সরাসরি বা স্পষ্ট প্রতিপক্ষ। বিএনপি-জামায়াতসহ ডান-বামের বাকিরা প্রতিপক্ষ নয়। আবার একেবারে পক্ষ শক্তি নয়, নির্মোহ সমর্থকও নয়। যথাসময়ে, যৌক্তিক সময়ে, যথাশীঘ্র সংস্কার শেষ করে নির্বাচন—এ ধরনের কথায় তারা অসন্তোষ জানাচ্ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে—অবিরাম এ জিজ্ঞাসার জবাব আরেকটু খোলাসা করে যেন ড. ইউনূস আরেক ধরনের ফ্যাসাদে পড়ে গেছেন। ২০২৫ সালের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে জানিয়েও তিনি বাড়তি ফ্যাসাদে। বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। এর সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করলে আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।
এ ধরনের বাক্যে মেসেজ মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সেখানেও বাগড়া। তার এ ধরনের কথার মধ্যে ‘তবে-কিন্তু-যদি’ আঁচ করছেন তারা। তাই তারা আরও স্পষ্টতা দাবি করে। যার জেরে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। প্রেস সচিবের বক্তব্যে নির্বাচনের একটা খসড়া রোডম্যাপ মোটামুটি দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে যন্ত্রণা যেন আরও বেড়েছে। তিনি এ তথ্য জানানোর কে—এ প্রশ্নও উঠে গেছে। ভাষা বেশি ঝাঁজালো বিএনপির। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ও তার প্রেস সচিবের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। বিএনপি নেতারা বলতে ছাড়েননি—প্রধান উপদেষ্টাকে সবাই মিলে, দেশের মানুষ মিলে মনোনীত করেছেন। কিন্তু প্রেস সচিব তো সরকারি চাকরি করেন, সরকারের বেতন নেন, তিনি ভোটের সময় জানানোর ক্ষমতা পেলেন কোথায়? এখানেই শেষ নয়, প্রেস সচিব প্রধান উপদেষ্টাকেও ক্রস করে ফেলেছেন বলেও ক্ষোভ জানানো হয়েছে বিএনপি থেকে। বিএনপি নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলে চার থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। নির্বাচনের যাত্রা ভন্ডুলের কানাঘুষায় নতুন মাত্রা পেয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এক মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, একটি চক্র চায় দেশে জনসমর্থনহীন সরকার ক্ষমতায় থাকুক।
বাম শক্তির বড় দল সিপিবির মতে, সরকার আন্তরিক হলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন সম্ভব।। সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না করলেও নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে চায় না জামায়াত। ২০২৬ সালে নির্বাচন হলে আপত্তি নেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। পছন্দের সময় চায় জাতীয় পার্টি। সেই পছন্দের সময়টা কখন, তা এখনই বলতে চায় না দলটি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও বসে আছে। তাদেরও আশা আছে। সেই আশায় বাড়তি টোকা পড়েছে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের কথায়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে সংস্কার কমিশন থেকে কোনো বাধা নেই বলে খবর আসে তার বরাতে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুপারিশ করা হবে বলে জানিয়েছেন বদিউল আলম মজুমদার। বৃহস্পতিবার সকালে রংপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। জানান, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সংস্কারের প্রস্তাবনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তুলে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সময় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করার কথাও জানান তিনি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকা এসে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে তার বক্তব্য সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি। এতে তিনি ব্যথিত ও মর্মাহত উল্লেখ করে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রংপুরে দেওয়া তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে কিছু গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করেছে। বলেন, এ ধরনের অপপ্রচার শহীদ আবু সাঈদ ও শহীদ মুগ্ধের রক্তকে অস্বীকার করার শামিল। এর আগে কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আরও কঠিন কথা বলে বসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি। সমাবেশ ডেকে তারা জানিয়ে দিয়েছে, শেখ হাসিনার বিচারের আগে যারা নির্বাচন চাইবে, তারা জাতীয় শত্রু। তাদের কথা পরিষ্কার, কিন্তু উদ্দেশ্য ঝাপসা। মহান বিজয় দিবসে রাজধানীতে বিজয় র্যালি করে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেছেন, শেখ হাসিনা গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের নাগরিকদের হয় দালাল বানিয়েছেন, নইলে দাস বানিয়েছেন। সেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। যারাই বিচারের আগে কোনো নির্বাচনের পাঁয়তারা করবে, তাদের জাতীয় শত্রু হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর কথা আরও কড়া। তিনি বলেছেন, তারা বুলেট ক্রস করেছেন, আগামী দিনে ব্যালটের রেভল্যুশন এলে সেটাও মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তবে সেটা বিচারের আগে নয়। বিচার হবে, এরপর নির্বাচন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক আলোচিত সারজিস আলম আরও তেজি। তিনি বলেন, তাদের নাগরিক হয়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরে সুযোগ হয়েছে নাগরিক হয়ে ওঠার। তারা জুলাই-আগস্ট স্টাইলে কিছু নতুন স্লোগানও ছেড়েছেন। তাদের বিজয় অন্য কাউকে হাইজ্যাক করতে দিতে চাইছে না। এর বিপরীতে আবার স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের অপসারিত কাউন্সিলরদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলে জনগণ সেবাবঞ্চিত হবে বলে মনে করেন তারা। তবে বিএনপি নেতাদের কারও কারও মত, অপসারিত কাউন্সিলরদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করলে, ছাত্রনেতারা অভ্যুত্থানের আদর্শবিরোধী কাজ করবে। কারণ পতনের আগমুহূর্তেও আন্দোলনরতদের ওপর শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ দলীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা।
তাদের কারও কারও অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলি করে একাধিক আন্দোলনকারীকে হত্যা করার ভিডিও ফুটেজও ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কয়েক ধাপে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মেয়র কাউন্সিলদের অপসারণ করে। এই অপসারণের প্রতিবাদ ও স্বপদে বহালের দাবিতে ঢাকায় বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সিটি করপোরেশন ও কাউন্সিলরদের সংগঠনের ব্যানারে এক সভায় অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। এই কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। এর আগে সেপ্টেম্বরে, জাতীয় নাগরিক কমিটিকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও দেশব্যাপী বিস্তারের সফর করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা বিগত সরকার আমলের দুষ্টচক্রকে সঙ্গী-সাথি করে উল্টাপাল্টা পথে কেন? তাদের সমর্থক-সহচর তো শহর-বন্দর-জনপদ কোথাও কম নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন