একাত্তরে নারীদের সাহসের ইতিহাস কি আমরা সঠিকভাবে তুলে আনতে পেরেছি? বীর নারী, নারী মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের জনযুদ্ধে সম্পৃক্ত নারীদের সাহসের ইতিহাস কি রচিত হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং তাদের চোখে একাত্তরকে দেখার চেষ্টায় এই লেখার অবতারণা।
এক বিকেলে মুখোমুখি হই শহীদ সুফিয়া খাতুনের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেনের। তার বাবা আমজাদ হোসেন সিকদার ছিলেন অ্যাকাউন্টস অফিসার, রেলওয়েতে। সে সুবাদে একাত্তরে তারা থাকতেন সৈয়দপুর শহরে, আতিয়ার কলোনির এল-৭৬-বি নম্বর কোয়ার্টারে। ওখানেই সুফিয়া খাতুনকে হত্যা করা হয়।
সে ইতিহাসটি মুরাদ বললেন যেভোবে, “১৪ এপ্রিল রাতে আম্মাকে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করে। মেইন রোডের পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার, ছাদ দেওয়া একতলা বাড়ি। মার্চের শুরুতেই ছাদের ওপর বিশাল সাইজের একটা বাংলাদেশের পতাকা ও একটা কালো পতাকা লম্বা বাঁশ দিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। ওই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করত পাকিস্তানি আর্মি। বাংলাদেশের পতাকা দেখে তারা ক্ষিপ্ত হয়।
বিহারিরা প্রথম এসে আম্মাকে বলে, ‘উসকো উতার দো’। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে টাঙিয়েছে। এটা আমি নামাতে পারব না।’ ওরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি আর্মিদের ভয় দেখিয়ে আবারও পতাকা নামাতে বলে। এবারও আম্মা অস্বীকৃতি জানায়। তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করে ওরা। কিন্তু আম্মার বাধার কারণে পারে না। ফলে হুমকি ও গালাগালি করে চলে যায়।
এর কিছুক্ষণ পরেই আর্মিসহ বিহারিদের একটি সশস্ত্র দল এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। মা তখন রেহালে রেখে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আমার দূরসম্পর্কের এক বোন, নাম জোবাইদা। পেছনের দরজা দিয়ে আম্মা বোনটাকে পাঠান পাশের বাড়িতে, আব্বার বন্ধুকে ডেকে আনতে। কিন্তু পথের মধ্যেই বিহারিরা বোনটাকে কুপিয়ে হত্যা করে। সামনের দরজা ভেঙে তারা ঘরের ভেতরে যখন ঢোকে, আম্মা তখন কোরআন শরিফ বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। ওদের কাছে প্রাণভিক্ষাও চান। কিন্তু পিশাচদের মন গলে না। কোরআন শরিফ ধরা অবস্থাতেই আম্মাকে ওরা কোপ দিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। রক্তে ভেসে যায় পুরো ঘর। আল্লাহর কালাম কোরআন শরিফও মাটিকে পড়ে রক্তে ভিজে যায়।
মুসলমান হয়েও পাকিস্তানের পক্ষে বিহারিরা এমন বর্বরতা চালিয়েছিল। পরে আম্মার লাশ পাকিস্তানি আর্মিরা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। তার লাশটাও ফেরত দেয়নি ওরা। বোন জোবাইদার লাশটা রাস্তায় পড়ে ছিল কয়েক দিন। দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকলে স্থানীয়রা পরে তা মাটিচাপা দেয়।
আশপাশের পরিচিতজনরা আম্মার করুণ ও নির্মম মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। তাদের মুখেই শুনেছি সবকিছু। বিহারিরা চলে গেলে পাশের বাসার একজন ঘর থেকে আম্মার রক্তমাখা কোরআন শরিফটি তুলে নেন। পরে সেটি আমরা সংগ্রহ করি। রক্তমাখা ওই কোরআন শরিফটাই আমাদের মায়ের শেষ স্মৃতি। যার পাতায় পাতায় এখনো রয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
পতাকা দুটি যদি না টাঙাতাম তাহলে হয়তো ওরা আম্মাকে এভাবে হত্যা করত না। মাঝেমধ্যে নিজেকেও অপরাধী মনে হয়। স্বপ্নে আম্মার চিৎকার শুনে জেগে উঠি প্রায়ই। তখন খুব কষ্ট লাগে। এই দুঃখের কথা ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা তো মাকে ফিরে পাইনি, তার লাশও পাইনি। ফলে তার কবরও নেই। পুরো দেশের মাটিতেই মিশে আছে আমার মায়ের রক্ত।”
আক্ষেপ নিয়ে মুরাদ হোসেন বলেন, ‘আবেদন করলেও স্বাধীনতার জন্য শহীদ আমার মায়ের নাম ওঠেনি সরকারের শহীদ তালিকায়। একাত্তরে শত শত মা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমরা কি মনে রেখেছি তাদের? তাদের আত্মত্যাগের কয়টি ইতিহাস জানে এ প্রজন্ম। আজ আপনি এসেছেন বলে বলতে পারছি। কিন্তু সব শহীদের ইতিহাস তুলে ধরতে না পারার দায় রাষ্ট্রসহ আমরাও এড়াতে পারি না।’
মুক্তিযুদ্ধে নারী প্রসঙ্গে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা রওশন জাহান সাথীর সঙ্গেও। একাত্তরে ভারতের হ্যালেঞ্চা শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করেছেন তিনি।
শরণার্থীশিবিরের অবস্থা কেমন ছিল? তিনি বলেন, ‘মানুষকে দেখাশোনা, খাবার পৌঁছানো, সহযোগিতা করা এবং বিভিন্ন ধরনের লিফলেট বিলি করাই ছিল কাজ। বনগাঁও করিডোর অফিস ছিল জওপুরে। ওই অফিসের মাধ্যমেই কাজগুলো করতাম। ক্যাম্পটা দেখাশোনা করতেন এসএম জামান উদ্দিন। খুবই করুণ অবস্থা ছিল সেখানে। মানুষ আর শেয়াল-কুকুর একসঙ্গে থেকেছে। অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মারা গেছে। তখন ডায়রিয়া, আমাশয়, জ্বর হতো বেশি। কলেরার সময় ওষুধের সংকট ছিল। ভারতের স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাবের ছেলেমেয়েরা তখন ওষুধ সংগ্রহ করে দিত। শরণার্থী ক্যাম্পে শিশু ও নারী মারা গেছে সবচেয়ে বেশি।’
একাত্তর নিয়ে কথা হয় ফেরদৌসী হক লিনুর সঙ্গে। একাত্তরে আজিমপুর কলোনিতে ‘মেয়েবিচ্ছু’ হিসেবে কাজ করেছেন, যা ছিল অন্যরকম এক মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানান দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে সাহসী করে তোলার কাজটি তারা করেছিলেন গেরিলা দলের মতোই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বুকের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করে এমন যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুরা।
মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ নেই তার। অকপটে বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধটা ছিল পুরোপুরি একটা গণযুদ্ধ। খুব বড় কাজ করেছি এটা আমি কখনো ভাবি না। মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে নিবন্ধিত হয়ে সুবিধা নিতে হবে এটা কখনো চিন্তাও করিনি। দেশটা স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় পাওয়া।’
একাত্তরে নারীর ভূমিকাকে লিনু তুলনা করেন সন্তানসম্ভবা মায়ের মতো। তার ভাষায়, ‘বাংলাদেশকে তারা গর্ভে ধারণ করেছিলেন। কোথায় তাদের ভূমিকা ছিল না বলেন। শারীরিক নির্যাতন, স্বামী ও ছেলেমেয়েকে হাসিমুখে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা ও মানুষকে আশ্রয় দেওয়া, রান্না করে খাওয়ানো, চিকিৎসা করা প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা ছিল। অস্ত্র হাতেও যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। গেরিলা যুদ্ধ তো একা কেউ করতে পারে না। একাত্তরে পুরো দেশটাকেই মায়েরা ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তাদের সে ইতিহাস কতটুকু আমরা তুলে ধরতে পেরেছি? এ নিয়ে আক্ষেপ বা দাবি নেই। সন্তানের মুখ দেখলে যেমন মা সব ভুলে যায়, ঠিক তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে আনন্দে নারীরাও একাত্তরের সব কষ্ট ভুলে গেছেন।’
খারাপ লাগার অনুভূতিও তিনি তুলে ধরেন এভাবে, ‘অনেককেই বলতে শুনি, নারীদের ইজ্জতের বিনিময়ে। খুব মন খারাপ হয় তখন। নারীরা তো অত্যাচারিত হয়েছেন। ইজ্জত গেছে তাদের যারা অত্যাচার করেছে। স্বাধীনতা লাভের পর তো নির্যাতিত নারীকে তার মা-বাবা, স্বামী ও সন্তানরা জায়গা দেয়নি। অনেকে নিজের পরিচয়ও লুকিয়ে রেখেছিলেন। এখন তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সরকার সম্মানিত করছে। এটা দেখে ভালো লাগে। কিন্তু নারীদের বীরত্বের ইতিহাস তুলে ধরাসহ তাদের প্রতি আমাদের আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেটি পুরোপুরি হয়নি এখনো।’
একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী দাস প্রথম ট্রেনিং নেন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের কাছে। অতঃপর ট্রেনিং চলে ভারতের টাকিতে, ইছামতী নদীর পাড়ে। সুবেদার মেজর মাজেদুল হক ছিলেন ট্রেনার। ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে সাতক্ষীরা, ভোমরা, আশাশুনিতে স্পাইং করা ছিল রমার মূল কাজ।
মুক্তিযুদ্ধে বীর নারীদের ইতিহাস উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী দাস। তিনি অকপটে বলেন, ‘স্বাধীনের পর আমাদের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটিকে নেওয়া হয় খুলনায়। এরপর একটা ডিসচার্জ সনদ দিয়ে সেক্টর কমান্ডার সবাইকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কল্পনা নামের একটা মেয়ের আত্মীয়স্বজনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিল।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সমাজ তখন বিশ্বাসই করেনি নারীরা যুদ্ধ করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে কনক প্রভা মণ্ডল। এ কারণে সমাজ তাকে পরিত্যাগ করেছিল। নারী হওয়ায় পাছে লোকেরা তাকে চরিত্রহীন বলবে। তাই ডিসচার্জ লেটারটাও স্বামী ছিঁড়ে ফেলে। এ কারণে আজ পর্যন্ত কনক মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায়নি। এই মুক্তিযোদ্ধার জীবন কাটছে অবহেলা আর অনটনে। দেশ তাকে মনে রাখেনি। কাগুজে সনদ নেই। তাই তার কদরও নেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ছাড়াও একাত্তরে নারীরা নানাভাবে কাজ করেছে। তাদের সে ইতিহাসের কথা তুলে আনতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও হবে না।’
অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ। ১১ নম্বর সেক্টরের সীমান্তবর্তী এলাকায় রেইকি করা, এক ক্যাম্প ও বাঙ্কার থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা আরেক ক্যাম্প বা বাঙ্কারে পৌঁছে দেওয়াই ছিল কাজ। নারীদের অবদান প্রসঙ্গে অকপটে তিনি বলেন, ‘একাত্তরে নারীরা যে কত রকমভাবে সাহায্য করেছে চিন্তা করা যাবে না। আমার আম্মা আশরাফুন্নেসা রাতভর রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে, শুকনো খাবার দিয়ে তাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দিতেন। গোলাগুলি শুরু হলে মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি বলতেন তুলা রাখো সবাই। যদি ওরা বোমা ফোটায়, গোলাগুলির শব্দে যেন বাচ্চাদের কানের ক্ষতি না হয়। মুড়ি, চিড়া আর গুড় আগেই প্যাকেট করে রেখে দিতে বলতেন। এরকম সাহায্য তো ঘরে ঘরে মা-বোনেরা করেছেন। দেশ থেকে সবাই তো যুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু মায়েরা, বোনেরা এই অবরুদ্ধ বাংলায় চরম নিরাশ্রয় অবস্থায় ছিল। হানাদারদের কাছ থেকে নিজেদের ও শিশুদের বাঁচানোটাই ছিল তখন আরেকটা যুদ্ধ। সে ইতিহাসের কথা কিন্তু তেমন তুলে ধরা হয়নি। বীরাঙ্গনাদের অবদান অনেক পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাও বড় করে দেখতে চান না। স্বাধীনতা লাভের পর পরিবারও তাদের বিতাড়িত করেছে। একাত্তরের নারীদের নিয়ে গবেষণাও কম হয়েছে। যেটি করা উচিত ছিল অনেক আগেই।’
মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরোপুরি একটি জনযুদ্ধ। এটি বাঙালির ইতিহাসে এক মহান অর্জন, গৌরবময় বিজয়গাথা। যে বিজয় বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছে একটি মানচিত্র। আমাদের মানচিত্র ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের মানচিত্র। যার একটি বড় অংশই ছিল নারী। যারা যুদ্ধ করেছেন একাত্তরের প্রতিক্ষণেই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল নারী-পুরুষের সম্মিলিত লড়াই। তাই রক্তের মানচিত্রে নারীদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও সাহসের ইতিহাসও তুলে ধরতে হবে প্রজন্মের মধ্যে। যার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবারই।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক