সিরিয়া এখন বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। গতকাল রোববার সকালে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) রাজধানী দামেস্ক দখল করে। এর কিছুক্ষণ আগে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ তার ব্যক্তিগত বিমানে রাজধানী ছেড়ে পালিয়েছেন। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন এ বিষয়টি এখনো সবার অজানা। দামেস্ক দখলের পর এ অভিযানে নেতৃত্বদানকারীরা সিরিয়াকে মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে বলেছেন, ‘আসাদের পতনের মাধ্যমে একটি অন্ধকার যুগের অবসান ঘটেছে এবং একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।’
আসাদের পতনের পর স্বাভাবিকভাবে দামেস্কের পথে পথে শুরু হয় সব শ্রেণির মানুষের উল্লাস। আনন্দে আত্মহারা মানুষ তাদের প্রিয়জনদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে। একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করে। যেন দেশজুড়ে ঈদের আনন্দ বইছে। আর অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা ভেঙে ফেলে স্বৈরশাসকের ভাস্কর্য।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আমাদের দেশে যেমনটি ঘটেছে, আসাদের পতনের পর সিরিয়ায়ও আমরা একই ধরনের পরিস্থিতি লক্ষ করলাম। শেখ হাসিনা ‘আয়নাঘর’ সৃষ্টির মাধ্যমে বহু নিরপরাধ মানুষকে নির্মম নির্যাতন করেছেন। এই আয়নাঘর এখন শেখ হাসিনার পাশবিক নির্যাতনের প্রতীক। হাসিনার পতনের পর অনেকেই আয়নাঘরের দুঃসহ অন্ধকার জীবন থেকে মুক্ত পরিবেশে ফিরে এসেছেন। তেমনি আসাদের পতনের পর তার সরকারের নির্যাতনের শিকার হাজার হাজার মানুষ যারা কারাবন্দি এবং ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন, তারা এখন ফিরতে শুরু করেছেন। দামেস্কের সবচেয়ে বড় কারাগার ‘সেদনায়া’ থেকে হাজার হাজার বন্দিকে মুক্ত করেছে বিদ্রোহীরা। এটি ছিল আসাদ সৃষ্ট ‘আয়নাঘর’। জাতিসংঘ এক সময় এ কারাগারকে ‘মনুষ্য জবাইখানা’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। সেদনায়া কারাগারের ডাকনাম ‘বধ্যভূমি’। এটি সিরিয়ার দামেস্কের কাছে সিরিয়ার সরকার পরিচালিত একটি সামরিক কারাগার। কারাগারটিতে হাজার হাজার বেসামরিক বন্দি এবং সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক বন্দিদেরও রাখা হতো। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সেদনায়াতে ৩০ হাজার বন্দিকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। ১৩ হাজার বন্দিকে বিনা বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে আসাদ সরকারের এমন আরও ২৭টি কারাগার এবং টর্চারসেল চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কারাগারে বন্দিদের নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো।
হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে মাত্র এক মাসে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছে অন্তত ৮৯ জন শিশু-কিশোর। আবদুল আহাদ, রাকিব হাসান, তাহমিদ ভূঁইয়া, মারুফ মিয়া, মাহফুজুর রহমান, ইফাত হাসান, জাবির ইব্রাহিম, নাঈমা সুলতানা, রিয়া গোপের নিষ্পাপ মুখ এখনো প্রায়ই আমাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। নিহত ৮৯ জনের অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে।
বাশার আল-আসাদের শাসনামলেও গৃহযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে অগণিত শিশু-কিশোর নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছে। এদের একজন আলান কুর্দি। গায়ে লাল টি-শার্ট, পরনে নীল প্যান্ট, পায়ে স্নিকার্স। নির্জন সৈকতে বালুর ভেতর মুখ গুঁজে, উপুড় হয়ে শুয়ে আছে এক শিশু। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর তুরস্কের একটি সমুদ্রসৈকত থেকে এ ছবি তুলেছেন ফটোসাংবাদিক নিলুফার ডেমির। শিশুটির নাম আলান কুর্দি। শুরুতে পশ্চিমা গণমাধ্যম তার নাম ‘আয়লান’ কুর্দি হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পরে তার পরিবারের সদস্যরা জানান, তার নাম আলান কুর্দি। ডাক নাম শেনু। সিরিয়া যুদ্ধের কারণে জীবন বাঁচাতে আলানের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি স্ত্রী রিহানা, বড় ছেলে গালিব ও আলানকে নিয়ে অবৈধ পথে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন ইউরোপে। কিন্তু নৌকাডুবিতে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয় রিহানা, গালিব ও আলান। উন্নত জীবনের আশায় মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ে তারা। কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যান আবদুল্লাহ। সোনালি বালুর বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত আলান কুর্দি নতুন করে প্রমাণ করে শরণার্থী হওয়াটা মানব সভ্যতার চোখে একটি জঘন্য অপরাধ। আলানের মৃত্যুর জঘন্য শরণার্থী ইস্যু নিয়ে নতুন করে হৈচৈ শুরু ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা উদারনীতি অবলম্বন করে তারা। যেহেতু আলানের পরিবার প্রথমে কানাডায় অভিবাসী হওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাই তার মর্মান্তিক মৃত্যুতে ওই বছর কানাডার ফেডারেল নির্বাচনে শরণার্থী সংকট একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে সাড়ে আট কিলোমিটার দূরে মফস্বল শহর ‘রুকিনেদ্দিনের’ বস্তি এলাকায় বাস করত সিরিয়ায় একঘরে হয়ে থাকা কুর্দি জনগোষ্ঠীর মানুষ। এরকমই এক বস্তিতে মা ও পাঁচ ভাইবোনের পরিবার নিয়ে থাকতেন আবদুল্লাহ কুর্দি। তিনটি ছোট সেলুন চালাত কুর্দি পরিবারটি। আবদুল্লাহদের আদি বাড়ি ছিল উত্তর সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তঘেঁষা মফস্বল শহর কোবানিতে। সেখানে তাদের ছিল জলপাইক্ষেত। গ্রীষ্মকালে জলপাই চাষ করার জন্য পরিবারটি চলে যেত কোবানি। আবদুল্লাহ কুর্দির পরিবারটি আচমকাই ‘শরণার্থী’ বানিয়ে দেয় সিরিয়া যুদ্ধ। তারা প্রথমে কানাডা যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। আবদুল্লাহর বোন ফাতিমা কুর্দি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কানাডায় বসবাস করছেন। ফাতিমা চেয়েছিলেন ভাই ও তার পরিবার কানাডাতেই আশ্রয় পাক। কিন্তু তুরস্কে তখন শরণার্থী সমস্যা নেই, এ যুক্তি দেখিয়ে তাদের আবেদন বাতিল করে দেয় কানাডা সরকার। শেষে আবদুল্লাহ ঠিক করেন, সমুদ্র পেরিয়ে যাবেন গ্রিসে।
নৌকাডুবির পর আবদুল্লাহ বলেন, ‘নৌকা ডুবছে দেখেই মাঝি পানিতে লাফ দিল। আমি হাল ধরলাম। কিন্তু আমি সামলাতে পারছিলাম না। স্ত্রীর হাতটা ধরেছিলাম। বাচ্চাগুলো হঠাৎ হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। নৌকাও উল্টে গেল। নৌকাটা ধরে ভেসে থাকতে চাইলাম। হাতড়ে হাতড়ে স্ত্রী-ছেলেদের খুঁজেও পেলাম কিন্তু সর্বগ্রাসী ঢেউ সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এরপর তাদের সঙ্গে দেখা হলো মর্গে।’
আবদুল্লাহ কুর্দি সিএনএনকে বলেন, ‘এ পৃথিবীর কাছে আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার সন্তানদের কবর দিতে চাই এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাদের পাশে থাকতে চাই।’
আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়া থেকে। দেশটির একজন ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজি সেনাবাহিনী ও পুলিশের নারকীয় অত্যাচারের প্রতিবাদে ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। উত্তর আফ্রিকা ও আরবজুড়ে ওঠে গণবিপ্লবের এক ভয়াবহ ঝড়, যা ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত। এই আরব বসন্তের প্রভাবে তছনছ হয়ে যায় তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মিশর, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, জর্ডান, লিবিয়া, কুয়েত, ওমান, ইরাক, ইরান ও ইয়েমেন।
আরব বসন্ত সিরিয়ায় আঘাত হানে ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি। ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হয় সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী সুন্নি গেরিলাদের মধ্যে। আবদুল্লাহ তখন তার এক দুঃসম্পর্কের বোন রিহানাকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন রুকিনেদ্দিনে। কোবানির পৈতৃক ভিটাতে জন্ম নেয় আবদুল্লাহর বড় ছেলে গালিব।
কুর্দিদের ওপর নারকীয় অত্যাচার শুরু করে আসাদের কুখ্যাত সেনাবাহিনী। রাতের অন্ধকারে কুর্দি যুবক ও যুবতীদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যেত সেনারা। পরদিন সকালে যুবতীদের খুঁজে পাওয়া যেত বিবস্ত্র ও অচৈতন্য অবস্থায়। আর যুবকদের কোনো খোঁজই পাওয়া যেত না। এভাবেই এক রাতে দুই চাচাতো ভাইকে হারান আবদুল্লাহ।
এক রাতে রুকিনেদ্দিন ছেড়ে কোবানি পালিয়েছিল কুর্দি পরিবার। কারণ কোবানি শহরে কুর্দিরা ছিল সংখ্যাগুরু। আবদুল্লাহর স্ত্রী রিহানা তখন ছিলেন সন্তানসম্ভবা। কোবানির পৈতৃক ভিটায় ২০১২ সালে জন্ম নেয় আবদুল্লাহর ছোট ছেলে আলান। হাঁটতে শেখার পর কখনো মা রিহানা, কখনো পোষা ভেড়াটির পেছন পেছন ঘুরত শিশুটি। ফুটবল খেলতে দেখা যেত সরু গলিতে। সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। কারণ ময়নাপাখির মতো কথা বলত আলান।
স্ত্রী রিহানা, চার বছরের গালিব ও দুই বছরের আলানকে কোবানিতে রেখে রোজগারের আশায় আবদুল্লাহ যান তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। কোবানির আকাশে জমতে শুরু করে আরও এক ভয়ংকর যুদ্ধের কালো মেঘ। সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ‘আইসিস’। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোবানিকে লক্ষ্য করে কামান দাগতে শুরু করেছিল সন্ত্রাসবাদী দলটি। গোলার আঘাতে গুঁড়িয়ে দেয় কুর্দিদের বাড়িঘর। প্রাণ হারায় শত শত মানুষ।
কোবানিকে বাঁচাতে তুমুল লড়াই শুরু করে কুর্দিদের বামপন্থি গেরিলা দল। উত্তরে থাকা তুরস্ক সীমান্তের দিকে পালাতে শুরু করে তারা। বেশিরভাগই প্রাণ হারায় আইসিস জঙ্গিদের হাতে। কেউ প্রাণ হারায় সীমান্তরক্ষীর গুলিতে। কুর্দি পরিবারের এগারোজনকে প্রকাশ্যে কতল করে ‘আইসিস’ জঙ্গিরা। তাদের মধ্যে ছিলেন আলানের ৬০ বছরের দাদিও।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক