বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিশেষ একটি ইস্যু নিয়ে তিনবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কয়েক বছর আগে আলোচনাকালে দেখেছি তার জ্ঞানের গভীরতা। তিনি দেশ নিয়ে ভাবেন; ভাবেন দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে। তাই সংগত কারণেই তার দর্শনের আওতায় দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যৎসামান্য লেখার জন্য ব্রত হয়েছি। বস্তুত ‘ক্ষুদ্রঋণ’ (Micro Credit) শব্দটি কিছুকাল আগেও খুব বেশি পরিচিত ছিল না। সত্যি কথা বলতে; তখন ব্যাংক-ব্যবস্থায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকারের দরজা বলতে গেলে বন্ধ ছিল। অবশ্য চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে কম বা বিনা সুদে প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে মানুষ বেশি ঋণ নিতেন। কিন্তু এতে তাদের কম নাকানিচুবানি খেতে হতো না।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও সফলতার মিশ্র ফলাফল রয়েছে। মূলত এ কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন ও যুগপৎ নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড। সত্যি কথা বলতে কী, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। যদিও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা, নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নত পুষ্টি এবং ঋণগ্রহীতার সন্তানদের উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এদিকে ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করি, তাহলে প্রতীয়মান হয় যে, এটি গরিবদের জন্য ঋণ, জামানতমুক্ত ঋণ, সাংগঠনিক প্রেশার বা চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঋণ, স্বল্প আকারে ঋণ এবং আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ব্যবহৃত ঋণ।
আসলে ক্ষুদ্রঋণের সুদূরপ্রসারিত কার্যকারিতা যদি তলিয়ে দেখি; তাহলে প্রত্যক্ষ করি যে, দারিদ্র্যপীড়িত এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য অনেক সুবিধা তৈরি পূর্বক দেশের আর্থসামাজিক ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান তৈরি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ এবং পুঁজি বিনিয়োগে সুবিধাসহ দেশের অর্থনীতির সূচককে ত্বরান্বিত করে। এতদ্ব্যতীত দারিদ্র্য হলো বহুমাত্রিক সমস্যার সূতিকাগার। তাই কেবল ক্ষুদ্র অর্থায়ন দিয়ে এই চক্র থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়। তাই এর সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি- প্রশিক্ষণ দিয়ে অগ্রগতির পথ সুগম করতে হবে। যেভাবেই বলি না কেন, দারিদ্র্য উত্তরণে বলতে গেলে আলাদিনের আশ্চার্য প্রদীপ হলো এই ক্ষুদ্র অর্থায়ন। এ ব্যাপারে যদি সহজভাবে বলি, তাহলে বলতে হয় যে, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন একটি সিঁড়ির মতো, যার কতগুলো স্তর থাকে। এতে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, সময়ের আবর্তে ঋণ চাহিদা বাড়ে এবং ধীরগতিতে দারিদ্র্যবিমোচন হতে থাকে। এদিকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরি হয়; বিশেষ করে নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নারীরা গৃহস্থালির কাজকর্ম ছাড়াও এখন মাঝারি ধরনের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়। এ সূত্র ধরে হাঁস-মুরগি পালনসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প উৎপাদনে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। আর বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকদের প্রায় ৯০.৫৪% নারী। এটা সত্য যে, ঋণপ্রাপ্তি নাগরিকের জন্য প্রতিষ্ঠিত অধিকার হলেও সাধারণত এ দেশের অধিকাংশ ব্যাংকই দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ঋণ প্রদানে অনীহা পোষণ করে থাকে। তাই বলতে গেলে তারা ব্যাংকের দরজার কাছেই যেতে পারে না। এক্ষেত্রে Micro Finance Institute (MFI) গুলো এসব দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে এবং এ সূত্র ধরে আত্মকর্মসংস্থানে বলয় সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে তাদের গৃহীত কর্মসূচি ও উদ্যোগের ফলে এক কোটিরও বেশি মানুষের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো যে, ক্ষুদ্রঋণ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ সুগম হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণের ক্ষেত্রে Micro Finance Institute শুধু ঋণ প্রদান করে না, তারা গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে কর্মে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশ আজ যে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে, তার পেছনে এ খাতের অবদান অনস্বীকার্য। এর মধ্যে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতারও অনেক বৃদ্ধি ঘটেছে এবং ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ বিভিন্ন ধরনের এনজিও হতে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তারা তাদের ব্যবসা হতে অর্জিত মুনাফার মাধ্যমে তা পরিশোধ করে থাকে, যা এই ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য একটি অনন্য উদাহরণ বৈ কিছু নয়। এদিকে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কৃষিভিত্তিক শিল্প, কাঁচা পাটের কাগজ, রেশম শিল্প, হিমায়িত খাদ্য (বিশেষত চিংড়ি), পর্যটন, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, এর মতো রপ্তানিমুখী শিল্পে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে এবং এর ফলে অতীতের মহাজনি ব্যবস্থা প্রায় লোপ পেয়ে পুঁজি বিনিয়োগে স্থানীয় বা দেশীয়রা সুবিধা পাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো যে, গ্রামীণ অর্থনীতির প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি অর্থের জোগানদাতা হচ্ছে এসব ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা। এদিকে দেশব্যাপী শতাধিক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে প্রায় ৩ কোটি দরিদ্র, হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করেছে। এ ক্ষুদ্র ঋণপ্রাপ্ত পরিবারগুলো সরাসরি উৎপাদন সংশ্লিষ্ট; যেমন- হাঁস-মুরগির ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, সবজি বাগান, মাছ চাষ, দোকান, ইত্যাদি। আর এসব কাজে ব্যবহার করে নিজেরাও যেমন স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে; তেমনই দেশজ উৎপাদনেও সহায়ক শক্তি হিসেবে পাই ভোটাল রোল প্লে করছে। মূলত গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে দেশের এ উন্নয়ন এখন শুধু সাময়িক উন্নয়ন নয়। এ উন্নয়ন বলতে গেলে টেকসই উন্নয়ন। আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, পুষ্টি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সহমর্মিতার আদলে কাজ করছে বিভিন্ন Micro Finance Institute।
বস্তুত ক্ষুদ্র ঋণ বা মাইক্রোক্রেডিট, যাকে আরও একটু প্রসারিত করে বলা যায় ক্ষুদ্র অর্থায়ন বা মাইক্রোফাইন্যান্স; যা হলো গরিব মানুষদের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর্থিক সেবা, যার মধ্যে নিবিড় তদারকির আওতায় জামানতবিহীন ঋণভিত্তিক সেবা। এদিকে যেভাবেই বলি না কেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণের ‘জন্মভূমি’ এবং মানুষের দারিদ্র্য হ্রাসের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এর জন্ম। পূর্বেই বলেছি যে, এরই হাত ধরে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘নোবেল প্রাইজ’ আসে। যদিও ‘ক্ষুদ্রঋণ’ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আলোচনায় গুরুত্ব পেতে থাকে ৯০-এর দশক থেকেই। আর ক্ষুদ্রঋণের উত্থানের সঙ্গে বাজার অর্থনীতির এবং যুগপৎ গ্রামীণ আর্থিক খাতের বিবর্তনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিগত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রামীণ আর্থিক খাতের বিষয়ে চিন্তাভাবনার জগতে যে মৌলিক পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তার ঢেউ বাংলাদেশের গ্রামীণ আর্থিক খাতকে আরও প্রভাবিত করেছে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশ ঘটেছে প্রধানত দুটি ভিন্ন ধারায় ও ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। এর প্রথম ধারাটিকে বলা যায় আবির্ভাব পর্ব এবং পরবর্তী ধারাটিকে বলা যায় বিস্তার পর্ব। প্রথমটি আসে গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে, দরিদ্র মানুষদের মালিকানাভিত্তিক একটি নতুন ধারার ব্যাংক সৃষ্টির মাধ্যমে। আর দ্বিতীয় ধারাটি তৈরি হয় এনজিওদের মাধ্যমে। প্রথমটির প্রকাশ আশির দশকের গোড়ায়। দ্বিতীয়টির বিকাশ নব্বইয়ের দশকে। গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টিকে বলা যায় ব্যক্তি উদ্যোগে স্থানীয় উদ্ভাবন, যদিও এখানে সরকারি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা ছিল। অন্যদিকে এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণের বিকাশকে বলা যায় স্থানীয় উদ্ভাবনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মূলত বিদেশি আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত একটি ব্যবস্থা। উভয় ধারার বিবর্তনেই তৈরি হয়েছে আজকের আধুনিক ক্ষুদ্রঋণের ধারণা। তবে যেভাবেই বলি না কেন, দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের বাতায়নে নবদিগন্তের পুরোধা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
লেখক: গবেষক ও লেখক