শিক্ষার মশাল ছেড়ে তারা হাতে নিয়েছে লাঠিসোঁটা, অস্ত্র। লিপ্ত হয়েছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে। একে অন্যের রক্ত ঝরিয়েছে। মেতে ওঠে লুটপাটে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ধ্বংস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে করেছে উল্লাস-নৃত্য। ধ্বংস হওয়া শ্রেণিকক্ষে এখন বিরাজ করছে অন্ধকার। দাবি আদায়ের জন্য তারা চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়ে নারী-শিশুকে আহত করে। সড়ক অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে দুর্ভোগ ঠেলে দেয়। তারা কথিত ‘বড় ভাই’ সেজে ‘ছোট ভাইদের’ কান ধরে ওঠ-বস করায়, গালাগাল করে অকথ্য ভাষায়। তাদেরই কেউ কেউ উপাচার্যের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এভাবেই শিক্ষঙ্গনে আলো নিভে আসে।
ওপরে যেসব ঘটনার উল্লেখ করা হলো, তা গত মাসে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষর্থীরা। তাদের সহপাঠী বন্ধুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারের বেশি মানুষ এই অভ্যুত্থানে শহীদ হন। হাজার হাজার আহত মানুষ এখনো হাসপাতাল বা বাড়িতে বসে কাতরাচ্ছেন। কেউ হারিয়েছেন হাত-পা, কারও চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। স্বৈরাচার পতনের সাড়ে তিন মাস পরও শিক্ষাঙ্গনে রক্ত ঝরছে। শিক্ষার্থীরা নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন এ সংঘর্ষ, রক্তপাত, অস্থিরতা?—এ প্রশ্ন এখন জোরেশোরে উঠছে। এসব দেখেশুনে নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ ক্রমেই হতাশ হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ, প্রশাসন, সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ এ যাবৎ ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কমিশনগুলো সুপারিশমালা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। চলতি মাসের মধ্যে ছয়টি কমিশনের সুপারিশসমূহ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা। ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। তাহলে কি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা হবে না? একশ্রেণির শিক্ষার্থী মাঝেমধ্যেই যেসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাতে প্রশ্ন ওঠা খুবই সংগত যে, কীভাবে তাদের পুরোপুরি লেখাপড়ায় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে? স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিচার করা বাদ দিয়ে তারা কি শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবে? যাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে, তাদের মধ্যে সেই মূল্যবোধ কি জাগ্রত করা সম্ভব হবে?
শুধু রক্তক্ষয়ী সংঘাত নয়, শিক্ষাঙ্গনে এখনো র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটছে। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে র্যাগিংয়ের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত) প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টর্চার সেল’ খুলেছিল। সাধারণ ছাত্রদের ধরে এনে এসব সেলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। ছাত্রলীগ তাদের মিছিল সমাবেশে যেতে অনেক শিক্ষার্থীকে বাধ্য করাত। কেউ মিছিল সমাবেশ যেতে না চাইলে র্যাগিংয়ের শিকার হতো। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যায়ের (বুয়েট) আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে। আবরারকে পেটানোর আগে ছাত্রলীগ নেতারা তার মোবাইল নিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে দেখে। এরপর ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে শুরু করে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ওই সময়ের কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে আবরারের দেওয়া কিছু স্ট্যাটাস তার হত্যার কারণ বলে সংবাদপত্রের খবরে উল্লেখ করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার না হলেও সম্প্রতি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২৫ শিক্ষার্থীকে র্যাগ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এসব শিক্ষার্থীকে হলের একটি গণরুমে ‘সিনিয়র ছাত্ররা’ র্যাগিং করে। হিন্দি সিনেমার কথিত ‘বড় ভাইয়ের’ মতো এই সিনিয়র ছাত্ররা রাত ১১টার দিকে গণরুমে এসে সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। তাদের কান ধরে ওঠ-বস করতে বাধ্য করা হয়। অকথ্য ভাষায় তাদের গালাগাল করা হয়। গণরুমের সামনে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়। একপর্যায়ে পাঁচজনকে জানালার গ্রিলে ঝুলিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের শিকার পাঁচজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শুচিতা শারমিনের কক্ষে হানা দিয়ে নেমপ্লেট খুলে নিয়ে যায় একদল শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের বেঁধে দেওয়া সময়ে পদত্যাগ না করায় কঠোর আন্দোলনের অংশ হিসেবে এ কর্মসূচি পালন করে তারা। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ২৮ নভেম্বর দুপুরে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করে। বিক্ষোভ শেষে উপাচার্যের কক্ষে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। গত সেপ্টেম্বরে ড. শুচিতা শারমিনের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ড. শুচিতাকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করে।
রাজধানীতে নভেম্বর মাসে কতগুলো কলেজের শিক্ষার্থীরা যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে, তার হিসাব হঠাৎ করে মনে করা কঠিন। ২৫ নভেম্বর একদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজ, অন্যদিকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। ভয়াবহ এ সংঘর্ষে যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা এলাকা রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুর ঘটনার জের ধরে সংঘাতের শুরু। ভুল চিকিৎসায় অভিজিতের মৃত্যু হয়েছে, এ অভিযোগে ড. মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অবরোধ করে। সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পক্ষ নেয়। ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় শিক্ষার্থীরা। হামলা-সংঘর্ষের সময় টাকা-পয়সা, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফ্যানসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করেছে শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা। ড. মোল্লা কলেজের লাইব্রেরি তছনছ করা হয়। মেঝেতে পড়েছিল ছেঁড়াফাটা বই। সংঘর্ষ ও লুটপাটের পর একদল শিক্ষার্থী উদ্দাম নৃত্য করেছে—এমন ভিডিও দেখা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ এবং সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
২৪ নভেম্বর ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে আহতের সংখ্যা অর্ধশত। ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের মধ্যে। ২০ নভেম্বর সংঘটিত এ সংঘর্ষের ঘটনায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে আহতের সংখ্যা ৪০। রাজধানীর বিরাট এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয় যানজট। কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা রেল ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। তাদের এ অবরোধের কারণে নারী, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষ যানজটের কবলে পড়ে দুঃসহ দুর্ভোগ পোহায়। অবরোধকারীদের কয়েকজন ট্রেনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। শিক্ষার্থীরা একবারও কি ভেবে দেখেছে, তাদের ছুড়ে মারা ইটপাটকেল শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে? তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করলেই কি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান উন্নত হবে—এ প্রশ্ন তোলাই যায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাষ্ট্রের অনেক কিছু সংস্কার করার ঘোষণা দিয়েছেন। রক্তে ভেজা সফল আন্দোলনে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে সরকার এখনো কোনো ঘোষণা দেয়নি। কেন শিক্ষা সংস্কারের জন্য কেন কমিশন গঠন করা হয়নি—তাও একটি বড় প্রশ্ন। আদৌ অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের চিন্তাভাবনা আছে কি না অথবা শিক্ষাঙ্গন নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কী, সরকার সে বিষয়ে এখনো কিছু বলছে না। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগো বা মনোগ্রামে ‘শিক্ষাই আলো’ অথবা ‘জ্ঞানই আলো’ ইত্যাদি লেখা থাকে। যেমন কবি নজরুল ইসলাম কলেজের মনোগ্রামে ‘জ্ঞানই আলো’ উৎকীর্ণ আছে। জ্ঞানের অন্বেষণ দূরে ঠেলে রেখে কলেজের শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করে আরেক কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘাত-সন্ত্রাসসহ যাবতীয় নেতিবাচক কার্যকলাপের স্থায়ী অবসান হওয়া দরকার। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করবে—এটাই প্রত্যাশিত। শিক্ষার্থীরা আইন নিজের হাতে তুলে নেবে না, র্যাগিং শব্দ শিক্ষাঙ্গন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে, সব শিক্ষার্থী মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হবে—অভিভাবকসমাজ সর্বোপরি দেশের মানুষ এমনটাই দেখার আশা করে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক