মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৯ এএম
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাড়াতে হবে চিকিৎসাসেবার পরিধি ও মান

বাড়াতে হবে চিকিৎসাসেবার পরিধি ও মান

সম্প্রতি অভিজিৎ নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ভুল চিকিৎসায় হয়েছে বলে দাবি করে তার কলেজের শিক্ষার্থীরা এবং বিচার চেয়ে আন্দোলনে নেমে সড়ক অবরোধ করে। অতঃপর অন্য দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ বাধে। চলে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙচুর, লুটপাট। রোগীর প্রতি চিকিৎসায় কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু কেন্দ্র করে হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনা দেশে প্রথম নয়। এ ধরনের ঘটনার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থায় নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশে জনগণের দোরগোড়ায় উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া চিকিৎসাব্যবস্থায় নানা অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কারণে রোগাক্রান্ত জনগণ কখনো উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন। স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৩৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়, বাকি ৬৫ শতাংশের ভরসা বেসরকারি হাসপাতাল অথবা প্রাইভেট ক্লিনিক এমনও তথ্য রয়েছে। রোগীর তুলনায় দেশের সরকারি হাসপাতালে শয্যা ও চিকিৎসকের সংখ্যা কম, তা সত্য। অনেক হাসপাতাল রয়েছে যেখানে বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা দুই-তিনগুণ। আবার অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রচেষ্টা থাকলেও অবকাঠামোগত এবং জনবল সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবাদান সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বাধ্য হয়ে রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে যেতে হচ্ছে। শহরের সরকারি হাসপাতালে বা গ্রামের যে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবার মান তেমন সন্তোষজনক নয়। অভিজ্ঞ চিকিৎসক যারা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই পোস্টিং নিয়ে থাকেন ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরগুলোতে। শহরের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থায় রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। রোগীর অনুপাতে হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই। হাসপাতালের বারান্দায়, মেঝেতে রোগীদের পড়ে থাকতে হয়। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি যত্নের অভাবে বিকল হয়ে পড়ে থাকে। বহু মূল্যবান যন্ত্রপাতি যোগ্য টেকনিশিয়ানের অভাবে ব্যবহারই করা যাচ্ছে না। এমনকি নতুন আমদানি করার পর যন্ত্রপাতি দক্ষ জনবলের অভাবে স্থাপন করা সম্ভবপর হয় না এমন নজিরও রয়েছে। বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। দেশে পর্যাপ্ত সরকারি হাসপাতালের অভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক। সরকারি হাসপাতালের অনেক চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে পাঠান প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। রোগীদের প্যাথলজিক্যাল টেস্টও করাতে হয় বাইরের ক্লিনিক থেকে। বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের কথা থাকলেও অনেক রোগীই এ থেকে বঞ্চিত হন। রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধ বাইরে বিক্রি হয়ে যাওয়ার ঘটনা বিরল নয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় পুরো চিকিৎসাব্যবস্থাকে।

বাংলাদেশে ডাক্তারের ফি নেওয়ার ব্যাপারে কোনো নিয়মকানুন মানা হয় না। একজন অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক কখনো এক হাজার, কখনোবা দেড় হাজার আবার কেউ দুই হাজার পর্যন্ত ফি নিয়ে থাকেন। ডাক্তারের এত বেশি দর্শনী মূল্য, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার উচ্চ ব্যয়ভার বহন করে গরিব মানুষের চিকিৎসা লাভ সম্ভবপর হয় না। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে অনেক। সেখানে অনেক উন্নতমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। নিয়োজিত আছেন বহু দক্ষ চিকিৎসক। তবে ওইসব হাসপাতালে চিকিৎসার সেবামান নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এমনিতে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় মেটানো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। দেশে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে তেমন সেতুবন্ধ গড়ে ওঠেনি। ভয় ও শঙ্কা নিয়েই সাধারণ মানুষ চিকিৎসকের কাছ যান। দেশের চিকিৎসার ওপর ভরসা রাখতে পারেন না বলেই হয়তো বিত্তশীলরা সামান্য অসুস্থতাতেই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। তারা সেখানে ভিড় করেন, নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। বাংলাদেশে ওষুধের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণেও আইন-কানুনের তেমন বাস্তব প্রয়োগ নেই। অনেক ওষুধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বৈধ লাইসেন্সও নেই। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধপত্র বিক্রি হতে দেখা যায় বাজারে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে নকল ও ভেজাল ওষুধ, ইনজেকশন, মাদকসেবীদের বিষাক্ত রক্ত ব্যবহারের ঘটনাও আজ নতুন নয়। উন্নত বিশ্বের মতো ওষুধের দোকানে নেই কোনো প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু সাফল্যও রয়েছে। আজ দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। হার্ট-সার্জারিতে অনেকদূর এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের মতো কঠিন অপারেশনও সম্ভব করে তুলছেন এ দেশের চিকিৎসকরা। দেশের একজন খ্যাতনামা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ একটি বেসরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর দেহে দেশে প্রথম কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছেন। তার এ সফল প্রচেষ্টা দেশের সর্বস্তরের মানুষ সাধুবাদ জানায়। তবে এ ধরনের চিকিৎসায় যে বিপুল অর্থব্যয়, তা দেশের কম মানুষের পক্ষে জোগান দেওয়া সম্ভব। এ ব্যয়ভার কমিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে এমন চিকিৎসা পেতে পারে সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রসূতি ও নবজাতকের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া ভিটামিনের সঠিক প্রয়োগে প্রসূতি ও নবজাতকের ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ উল্লেখযোগ্য হারে নেমে এসেছে। শিশুদের হেপাটাইটিস বি, হাম, কৃমি, পোলিওসহ নানা রোগের প্রতিষেধক ওষুধ খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারিত করতে দেশব্যাপী বাড়ানো হয়েছে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা। সাধারণ ও বিশেষায়িত নতুন হাসপাতালও স্থাপিত হয়েছে। উপজেলায় নির্মিত হয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে ইউনিয়নগুলোতে। সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্লিনিকে সন্তান প্রসব কার্যক্রমও চালু হয়েছে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা, জনসংখ্যা ও পুষ্টি উৎপাদনে বেশ কিছু উদ্যোগও লক্ষ করা গেছে। গ্রামাঞ্চলে প্রসূতিসেবাও বেশ উন্নত হতে চলেছে। কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসকের নিরলস প্রচেষ্টা দেশের জন্য আশার আলো দেখিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা জনগণের মৌলিক অধিকার। অথচ এ খাতে পরিকল্পনা এবং অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, ছোট শহরের এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ সমস্যা প্রকট। স্বাস্থ্যসেবার নামে বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিধিবহির্ভূত যে বাণিজ্য চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা দুর্নীতি দূর করতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এ লক্ষ্যে কথায় কথায় অহেতুক ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ধর্মঘট, কর্মবিরতি বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসাব্যবস্থায় সমস্যাগুলোকে দ্রুত দূর করে চিকিৎসকদের সেবাদানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের শূন্যপদে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে। সরবরাহ করতে হবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। দেশে ওষুধের দাম আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ওষুধের অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি দ্রুত নিয়ন্ত্রণসহ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়া রোগীর চাপ সামলাতে হাসপাতাল পরিচালনায় আধুনিক প্রযুক্তি এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সংযোজন করতে হবে। সরকার ছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওদের স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা প্রদানে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বস্তরের চিকিৎসকদের তাদের মেধা ও মনন কাজে লাগিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে শহর ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের হতে হবে আন্তরিক। রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ ও সেবার মনোভাব নিয়ে দেশের সব চিকিৎসক এগিয়ে আসতে হবে। একজন চিকিৎসক তৈরি করতে রাষ্ট্রের ব্যয় হয় অঢেল অর্থ। তাই রোগীর প্রতি, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি একজন চিকিৎসকের দায়ভার অনেক। নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ছাড়া কখনো মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা গড়ে উঠতে পারে না।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিদেশি নাগরিকদের বৈধতা অর্জনের সময়সীমা বেঁধে দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

দেশকে প্রসারিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে ভারত : আলতাফ চৌধুরী

সচিব নিবাসেও আগুন

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মির্জা ফখরুলের উদ্বেগ

‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে জনগণ অন্যতম সহায়ক শক্তি’

নিহত ৫ ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে ‘জঙ্গি’ দাবি ইসরায়েলের

সচিবালয়ের পোড়া ভবন থেকে মিলল মৃত কুকুর

পিপলস্ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত

বড়দিন উদযাপনের ছবি পোস্ট করে সমালোচনার মুখে সালাহ

ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ

১০

জবিতে তৃতীয় দিনের মতো ছাত্রদলের পদবঞ্চিতদের বিক্ষোভ

১১

কুর্দি যোদ্ধাদের শেষ পরিণতির হুঁশিয়ারি এরদোয়ানের

১২

দেশে ফিরেই মিজানুর রহমান আজহারীর স্ট্যাটাস

১৩

‘সাড়ে ১৫ বছর শাসনকারীরা দেশকে না সাজিয়ে নিজেদের সাজিয়েছে’

১৪

‘১৫ বছরে চট্টগ্রামে যত উন্নয়ন হয়েছে এখন সব ক্ষতির কারণ’

১৫

বিমানের সিটের নিচে ২ কেজি সোনা

১৬

সিরিয়ায় আসাদপন্থিদের হামলায় ১৪ নিরাপত্তাকর্মী নিহত

১৭

ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ডিএমপির ২৫৯৬ মামলা

১৮

আ.লীগ লাশের ওপর নৃত্য করে ইতিহাস তৈরি করেছে : ড. রেজাউল করিম

১৯

ব্যর্থতার দায় আমাদেরও আছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

২০
X