নিজের পতন নিশ্চিতের পর এখন তার বিরুদ্ধে একটি জাতীয় ঐক্যও অনিবার্য করলেন শেখ হাসিনা। তার বিরুদ্ধে তেড়ে আসা আন্দোলন আরও বেগবান করে গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যাওয়াও তার নিজেরই কর্মফল। তার এক কাপড়ে পালানোর পর আন্দোলনকারীদের ঐক্যে টুকটাক গোলমালও পাকতে থাকে। ওই আন্দোলনে কার ভূমিকা বেশি ছিল, কার লোক বেশি হতাহত হয়েছে, এখন কারা বেশি খবরদারি করছে, ড. ইউনূস কি পারবেন পরিস্থিতি সামলাতে, সংস্কারে কতদিন লাগবে, নির্বাচনে দেরি হচ্ছে কেন?—এ ধরনের নানা প্রশ্নে কিছুটা খটকা লাগতে থাকে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিও দুর্বল হতে থাকে। দলটির নেতাদের কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে একটু-আধটু করে সোশ্যাল কন্টাক্ট চালাতে থাকেন।
এমন কথাও সামনে আসতে থাকে, আওয়ামী লীগের সবাই খারাপ না। সবাই তো লুট, পাচার করেনি। খুন-খারাবিতে সবাই জড়িত ছিল না। এ বিবেচনায় তুলনামূলক ভালো আওয়ামী লীগারদের দিয়ে দলটিকে আবার সংগঠিত করার গুঞ্জনও হালে পানি পেতে থাকে। একপর্যায়ে কথা ঘুরতে থাকে আওয়ামী লীগকে ছাড়া কি নির্বাচন করা ঠিক হবে? এ ধরনের একটি আবহ ভণ্ডুল করে দিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। একেক সময় তার মুখদোষে ঠাসা একেকটা বাজে কথার অডিও পায়। একে তো নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলে বাড়ির মতো তার আশ্রয়দাতা দেশ ভারতের অতিতৎপরতা আরও সর্বনাশ করে দেয়। সরকার কঠোর হয়ে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, বিএনপি, জামায়াতসহ ডান-বামের প্রায় সব দল ম্যাজিকের মতো এক হয়ে যায়। থেমে যায় তাদের মধ্যে শুরু হওয়া মনোমালিন্য ও কথার খোঁচাখুঁচি। অল্পতেই এক কাতারে সবাই শামিল হয়ে যায় জাতীয় ঐক্যের শামিয়ানায়।
দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি এখন এমন যে, প্রশ্ন করার জো জো নেই কে-কারা আছে জাতীয় ঐক্যে? আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টিসহ ১৪ দল না থাকলে কি সর্বদলীয় ঐক্য হয়—এমন প্রশ্ন করলে এখন ফুটপাতের হকার পর্যন্ত নগদে ধোলাই দেবে। জাতীয় ঐক্য তো এখন এদেরই বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও জাতীয় পার্টিকে এখন এক কথায় প্রকাশ ‘ফ্যাসিস্ট’। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণকারী। পুরোনো কথা সামনে আসছে নতুন করে। টানা ১৫-১৬ বছর আওয়ামী লীগের মিত্র হয়ে মন্ত্রিত্ব-এমপিত্বসহ ক্ষমতার ছানা-মাখন খেয়ে তাজা হওয়াদের মধ্যে জাতীয় পার্টি একটা মোচড় দেওয়ার চেষ্টা করছিল। বলা শুরু করেছিল, তারাও আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট মনে করে। কিন্তু অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পটিয়ে-পাটিয়ে তাদের মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছে। প্রতিদিনই তারা ফ্যাসিস্ট-দুর্বৃত্তায়নের সমালোচনা করতে থাকে। পরিমাণে একটু বেশি করে ফেলায় অন্যরা বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কেসটা ধরে ফেলেন। তার ওপর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে দেশটির স্পেশাল আতিথেয়তায় দেশে একের পর এক ষড়যন্ত্র ও নৈরাজ্য সৃষ্টির তথ্য-সাবুদ বাংলাদেশের অনেককে আহত করে। এরই সম্মিলন জাতীয় ঐক্য। সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে ওকালতি করার সুযোগ আর স্বাভাবিকভাবেই এ সুযোগের পুরোটা কাজে লাগিয়েছে সরকার। ড. ইউনূসের পক্ষে পঙ্গপালের মতো শামিল হয়েছে দলগুলো।
দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের অপপ্রচার, হস্তক্ষেপ ও উসকানির বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে। সংলাপের শুরুতে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে তা রুখে দিতে সব রাজনৈতিক দলের কাছে ঐক্য চান। বলেন, ‘আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, একযোগে পেয়েছি। কোনো মতভেদের মাধ্যমে পাইনি, কাউকে ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি। যারা আমাদের বুকের ওপর চেপে ছিল, তাদের বের করে দিয়েছি।’ আলেম-ওলামাসহ হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান নেতাদের সঙ্গে বৈঠকটিও জুতসইভাবে কাজে লেগেছে।
বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যের ফটোসেশনটি হয়ে গেল দেশের রাজনীতিতে একটা ইতিহাস। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদ, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাসদ, জেএসডি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য দল ও সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা সংলাপে অংশ নেন। দেশের প্রশ্নে সবার এক হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অন্য উচ্চতার ইতিহাস তৈরি করেছে। বৈঠকে ভারতে বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ ইত্যাদির তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এসবের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ ও সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে এবং সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা হয়েছে। বৈঠকে ভারতের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালীভাবে সরকারকে বিষয়গুলো মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছে। একই সময়ে আবার শেখ হাসিনার দুষ্ট ও উগ্রবাদী বক্তব্য গণমাধ্যমে না আসার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হওয়া চুক্তিগুলো প্রকাশ করা এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দেশের জন্য ক্ষতিকর চুক্তি বাতিলের দাবি জানানো হয় বৈঠকে। ৬৪ জেলায় একটি করে সম্প্রীতি সমাবেশ করার প্রস্তুতির পরামর্শ রয়েছে। বিজয়ের মাসে এমন একটি কর্মযজ্ঞ যেনতেন বিষয় নয়। এর আগে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে বিজয়ী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বসেছেন। পরদিন বসেছেন প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। এর পরদিন বৈঠক করেন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে। সবশেষে আলেম-ওলামার সঙ্গে। এর আগে, ৪ ডিসেম্বর ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসে ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ কমপ্লেক্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স ২০২৪ এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স ২০২৪-এর কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সার্টিফিকেট দেন। সেখানে বর্তমানে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন বলে একটা বার্তা দেন।
সেনানিবাস থেকে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়ার আলাদা গুরুত্ব বহন করে। ঐক্য প্রশ্নে এর পরের আয়োজন রাষ্ট্রীয় ভবনে, যা এ সময়ের একটি ঘটনাই নয়, দলিলও। সবকিছুতে খুঁত ধরা শক্তি ওই বৈঠক ও ফটোসেশন ব্যবচ্ছেদে ব্যস্ত। সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক পাশে জামায়াতের আমির, আরেক পাশে বিএনপির ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার সাতজন পর বাসদের খালেকুজ্জামান ও দশজন পর সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। এ নিয়েও ব্যথিত আওয়ামী লীগের পরাজয়ের শোকে মুহ্যমানরা। জামায়াতের প্রয়াত আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের ছবি ও হাসিমুখে করমর্দনের ছবির কথা তারা কিছু সময়ের জন্য ভুলেও যান। কিন্তু গণমাধ্যমের কাছে আছে। এদিকে, প্রতিবেশীদের ত্যক্ত-বিরক্ত করতে করতে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত এখন নিজেই কোণঠাসা।
শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানও এড়িয়ে চলছে ভারতকে। সব দেশেই ভারতীয় মর্জির বিপরীত সরকার। পাকিস্তান, চীন এবং শেষতক বাংলাদেশও ছেড়ে কথা বলছে না। এক সময় বলা হতো বাংলাদেশের দম ফেলার সুযোগ নেই। কারণ এর তিনদিকেই ভারত। আর এখন ভারতের চারদিকেই তার প্রতিপক্ষ। এরপরও হাল ছাড়ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাড়ি চট্টগ্রামে, দেশের ভেতরে-বাইরে থেকে ইন্ধন দেওয়া ঝামেলাটা সেখান থেকেই শুরুর মধ্যে ওই বার্তার কিছুটা রেশ রয়েছে। দেশের ভেতরে বাইরের ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় ঐক্য গড়ার একটি সূত্রপাতও এরই মধ্যে হয়েছে। অতীতে রাজনৈতিক নেতারা মুখে ঐক্যের কথা বললেও বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে একপক্ষ আরেকপক্ষকে ঘায়েল করতেই তৎপর ছিল, যার পরিণাম দেশের জন্য ভালো হয়নি। ঐক্য হলো শক্তির প্রতীক। তা ব্যক্তিতে, দলে, চেতনায় সবদিকেই হতে পারে। আবার একক বিষয়েও হতে পারে। একাত্তরে স্বাধীনতার প্রশ্নে গোটা জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ; আর এ কারণেই সম্ভব হয়েছিল আমাদের মহান বিজয় অর্জন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, স্বাধীনতার পর নানা ইস্যুতে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর একটা সুযোগ আসে নব্বইয়ে। তাও বেশিদিন টেকেনি। এ বিভক্তি দিন দিন বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও জাতি অভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। চব্বিশের ঘটনাবলি ও আবহ একেবারে ভিন্ন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন