‘কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ঘরে দিলে ঠাঁই—
দূরকে করলে নিকট বন্ধু পরকে করলে ভাই’
ভারতীয় যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ নন্দলাল ভট্টাচার্যের উপরোক্ত কথা থেকে যোগাযোগের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই যোগাযোগের উদ্ভব। প্রথম মানব-মানবীর যোগাযোগটি ছিল একান্ত অন্তরঙ্গ যোগাযোগ (ডায়াডিক কমিউনিকেশন)। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ, নিজের ভাব প্রকাশ, নিজের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা, অন্যের কার্যক্রম সম্পর্কে জানা—এসবই সহজাত প্রবৃত্তি। তাই এখনকার আধুনিক বিশ্বে জনসংযোগের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনসংযোগ আর সাংবাদিকতা, এ দুটো বিষয়ও পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) ব্যাপক উন্নয়ন ও এর বিস্তৃত ব্যবহারের কারণে জনসংযোগে আইসিটিকে ব্যবহার করে লাভবান হওয়া যাবে অনেক দিক থেকে। লাভবান হওয়ার বিষয়গুলো বললে প্রথমেই বলতে হবে দ্রুত ও অল্প খরচে যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি। পরে আসবে দ্রুত অনেক বেশি মানুষের কাছে নিজের খবরাখবর পৌঁছানো, খুব সহজে প্রায় বিনে খরচে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ, যে কোনো তথ্য নিজের মতো করে যখন-তখন উপস্থাপন বা পরিবর্তন করা এবং সংগ্রহ করা ইত্যাদি সব বিষয়।
ইমেইল, যোগাযোগের সবচেয়ে দ্রত ও সাশ্রয়ী মাধ্যম: আইসিটির অন্যতম বড় প্রায়োগিক অংশই হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের যে অংশটি আবার বেশি ব্যবহৃত হয় সেটি ইলেকট্রনিক মেইল বা ইমেইল। ইমেইল এ মুহূর্তে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাধ্যম। ইমেইল ব্যবহারের জন্য প্রথমে কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ লাগবে। যদি নিজস্ব ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, সে ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি) গ্রাহকের জন্য একটি ইমেইল অ্যাকাউন্ট খুলে দেবে। গ্রাহক সেটা ব্যবহার করে ইমেইল আদান-প্রদান করতে পারবে। মেইল আদান-প্রদানের জন্য মাইক্রোসফট আউটলুক এক্সপ্রেস বা ইউডোরা সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন।
তবে বিনামূল্যের ইমেইল ব্যবহার করার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে সর্বত্র। এ ক্ষেত্রে ইয়াহু, জিমেইল, আউটলুকের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। বিনামূল্যে ইমেইল অ্যাকাউন্ট খুলে সেটা পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে যখন-তখন ব্যবহার করা যায়। মেইল আদান-প্রদান ও অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য প্রচুর ওয়েবসাইট আছে ইন্টারনেটে। সবটিতে অ্যাকাউন্ট খোলা ও মেইল আদান-প্রদানের নিয়ম প্রায় একই রকম। দরকার শুধু একটি ইমেইল অ্যাকাউন্ট খোলা। এখন হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইমো, স্কাইপে, ইনস্টাগ্রাম ও ভাইবারে খুব সহজে তথ্য ও ছবি আদান প্রদান করা যায়।
ইমেইলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি: সংবাদ বিজ্ঞপ্তি (প্রেস রিলিজ) বা সংবাদ সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্র পাঠনোর ক্ষেত্রে ইমেইল খুবই কার্যকর। কারণ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চিঠিটি সংবাদমাধ্যম বা প্রেরকের কাছে পাঠানো সম্ভব। ইংরেজিতে লিখলে তো কথাই নেই। বাংলায় লিখলে লেখাটি অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে পাঠানো ভালো। ছবির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। ছবির ফাইলটি অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে পাঠাতে হবে। তবে একটি কথা মনে রাখা দরকার, ছবি জেপিজি ফরম্যাটে পাঠানো ভালো। ছবিটির প্রস্থ বা দৈর্ঘ্য যে কোনো একদিকে যেন ৮ ইঞ্চি হয়। রেজুলেশন হবে ৭২ ডিপিআই। ফাইলের আকার ২০০ কিলোবাইটের বেশি না হওয়াই ভালো। খেয়াল রাখতে হবে বেশি ছবি না পাঠানোই ভালো। কারণ এতে প্রেরক বিরক্ত হতে পারেন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন ও প্রকাশ: ইন্টারনেট বেশি কার্যকর ও বেশি জনপ্রিয় হয়েছে সেই দিন থেকে, যেদিন (১৯৯১ সালে) সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সার্ন গবেষণা কেন্দ্রে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www.) ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়েছে। ইন্টারনেটে একটি ওয়েব থাকা মানে সাইবার জগতে একখণ্ড জমি থাকা। ইন্টারনেটে নিজের বা নিজের প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থাকলে তা একেবারে ছড়িয়ে যায় সারা বিশ্বে। বিশ্বের যে কোনো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছেই উন্মুক্ত থাকে নিজের বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য জানানোর সুযোগ। জনসংযোগের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইট ব্যবহার করাটা ভিন্ন একটি মাত্রা এনে দেবে। ওয়েবসাইট ডিজাইন করা একজন জনসংযোগ কর্মীর কাজ নয়, তবে ওয়েবসাইট প্রকাশ করাটা তার কাজের মধ্যে অবশ্যই পড়ে। জনসংযোগ কর্মীকে ওয়েবসাইটের পরিকল্পনা করতে হতে পারে। ওয়েবসাহট ডিজাইন করা পেশাদারি একটি কাজ। এজন্য ওয়েবসাইট ডিজাইনারের সহায়তা নিতে হবে বা নিজেকেই ওয়েব ডিজাইন শিখতে হবে।
ওয়েবসাইট তৈরিতে প্রথমে জানতে হবে এইচটিএমএল (হাইপার টেক্রাট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ)। তবে এখন কিছু সফটওয়্যার রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করলে সরাসরি এইচটিএমএল প্রোগ্রামিক সংকেত কোড না লিখলেও চলে। এ ধরনের সফটওয়্যারগুলো হলো এমএস ফ্রন্ট পেইজ, অ্যাডোবি ড্রিমউইভার ইত্যাদি। ওয়েবসাহট তৈরির ক্ষেত্রে নান্দনিক সৌন্দর্য, সহজবোধ্যতার মতো বিষয়গুলো মনে রাখা দরকার যাতে প্রথম পৃষ্ঠাতেই (হোমপেজ) চুম্বক তথ্যগুলো উপস্থাপন করা যায়। ওয়েবসাইটে ছবি সংযোজনের ক্ষেত্রে জেপিজি ফরম্যাট এবং ভিডিও সংযোজনের ক্ষেত্রে স্ট্রিমিং ভিডিও ব্যবহার করা যায়।
ওয়েবসাইট প্রকাশ: ওয়েবসাইট তৈরি করা হলে একে ইন্টারনেটে প্রকাশ করতে হবে। একে বলে ওয়েব হোস্টিং। ওয়েবসাইট প্রকাশের জন্য প্রথমে লাগবে রেজিস্ট্রেশন। এটা বাৎসরিক একটি ফি দিয়ে করতে হয়। পাশাপাশি ওয়েবসাইটটি রাখতে হবে একটি সার্ভারে। এ কাজগুলো করার জন্য পেশাদার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে (পেশাদারি ওয়েবসাইট) করা ভালো।
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট: এখন সামাজিক যোগাযোগ বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাহটগুলোর অবস্থা রমরমা। এসব সাইটে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করা যায়। আবার গ্রুপ তৈরির সুযোগও আছে। চাইলে অবাণিজ্যিক প্রচারণার কাজেও এসব সাহটকে ব্যবহার করা যায়। এমনই একটি সাইট হলো ফেসবুক। এই সাইটে লেখা, ছবি, ভিডিও ইত্যাদিও রাখা যায়। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির ভিডিও ইন্টারনেটে রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে ইউটিউব সাইটটি ব্যাপক জনপ্রিয়। ইন্টারনেট ছাড়াও আইসিটির আরও কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনসংযোগের কাজ করা যায়। এ ক্ষেত্রে এফএম ব্যান্ড রেডিও, শৌখিন রেডিও (হ্যাম) ইত্যাদি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। জনসংযোগের জন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা বেশ জরুরি। সব মানুষের ঠিকানা, ফোন নম্বর, অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে রাখা সম্ভব নয়। এ কাজে কম্পিউটারে থাকা মাইক্রোসফটের আউটলুক এক্সপ্রেস সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ইমেইল প্রদান করা ছাড়াও বিভাগের প্রতিদিনকার করণীয় কাজ বা কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে তা সব মনে করিয়ে দেবে। এ ছাড়া এখন প্রায় সব মোবাইল ফোনেই রিমাইন্ডার সুবিধা আছে। ফলে মোবাইল ফোনই বলে দেবে কখন কোথায় যেতে হবে, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে।
পরিশেষে এ কথাই বলা যায়, জনসংযোগ বাড়াতে প্রথমেই জনসংযোগ কর্মকর্তাকে হতে হবে সৃজনশীল। পরিকল্পনা করে লাগসই একটি প্রযুক্তি বেছে নিলেই চলবে। মনে রাখতে হবে—The task of a PRO is rarely finished...
লেখক: ঊর্ধ্বতন মুখ্য কর্মকর্তা
জনসংযোগ ও প্রটোকল বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, প্রধান কার্যালয়