মামুন রশীদ প্রখ্যাত ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। তিন দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে। দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত ছিলেন অনেক বছর। ছিলেন ‘বেটার বিজনেস ফোরাম’ ও ‘রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন’, নতুন আয়কর আইন ও বিডার বিনিয়োগ আকর্ষণে আইনি সংস্কার পরামর্শক কমিটির সদস্য। ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, উত্তরণ ও করণীয়সহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন
কালবেলা: ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রক্রিয়া আপনি কীভাবে দেখেন? এসব উদ্যোগ আরও টেকসই করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?
মামুন রশীদ: ব্যাংক ঋণ কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সমস্যা দীর্ঘদিনের। মন্দ ঋণ, ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার, আকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে প্রদত্ত ঋণের ব্যবহার না হওয়া, কোনো সাকসেশন প্ল্যানিং না থাকা, কোনো দেউলিয়া আইন না থাকা এবং বাংলাদেশে অর্থ ঋণ আদালত কিংবা লোয়ার কোর্টগুলোকে কোনোভাবেই ব্যাংকের পক্ষে ব্যবহার করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণকে কেন্দ্র করে সমস্যাগুলো টিকে আছে। সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ২২ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। তারাই ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ নিয়ে ক্ষমতা থেকে পালাল। এ ছাড়া প্রশ্নবিদ্ধ ঋণ রয়েছে আরও প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা।
মূলত তিনটি কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রথমত, সরকারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্রনি ক্যাপিটালিজম। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সরকারের গঠন করে দেওয়া বোর্ডগুলোর কার্যক্রম এবং তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকে অত্যন্ত দুর্বল নেতৃত্ব দেওয়া। বিনা বাধায় হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি করতে দিয়েছে সরকার। নতুন নতুন অনেক ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে সরকারের তত্ত্বাবধায়নের লুটেরাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করা হয়েছে। ফলে বলতেই হয়, সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত এবং সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই দেশের ব্যাংক খাতের আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের কথা উঠে আসে। তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঋণখেলাপিদের তালিকা ছাপিয়েছিলেন। এতে সাইফুর রহমানের প্রতি দলের অনেকের অসন্তোষ তৈরি হয়। এমনকি ’৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপি হেরে যাওয়ার পেছনে সাইফুর রহমানের ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশকে দায়ী করেছিলেন অনেকে। বলা হয়েছিল, তার কারণে ব্যবসায়ী গ্রুপ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি বিএনপি। তবে সাইফুর রহমানের এ উদ্যোগে সরাসরি সমর্থন দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
সাইফুর রহমান আমাকে এটাও বলেছিলেন, খালেদা জিয়া বিশ্বাস করতেন, সরকার সত্যিকার উদ্যোক্তাদের কাছে ব্যাংক ঋণ পৌঁছে দিতে দায়বদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিনিয়োগ কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। আর এ কারণে সত্যিকার উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানো সরকারের দায়িত্ব। খালেদা জিয়ার পর এমন মন-মানসিকতা আর কারও মধ্যে দেখিনি।
রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত না করে অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে সুশাসনের জন্য প্রয়োজন সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়বদ্ধতা। খালেদা জিয়া যেভাবে জনগণের প্রতি নিজেকে দায়বদ্ধ ভাবতেন, সেভাবে গত প্রায় দুই দশকে আর কেউ ভাবেনি। এ কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও আর্থিক খাতে সুশাসন আসেনি। বাংলাদেশে একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকারের কাছে মানুষ অনেক কিছু আশা করছে। সরকারের উচিত হবে, সঠিক জায়গায় এবং সঠিক ব্যক্তিদের ঋণ প্রদান করে অর্থনীতির যেসব খাত ও উপ-খাতগুলো শুকিয়ে গেছে, সেগুলোতে প্রাণের সঞ্চার করা।
কালবেলা: আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো নির্দিষ্ট মডেল ফলো করা হয় কি?
মামুন রশীদ: চীন, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এরকম একটি মডেল অনুসরণ করার উদাহরণ রয়েছে। চীনের ব্যাংকগুলোতে যখন মন্দ ঋণ অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল, তখন তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কার্নাইল কোম্পানিকে নিয়ে আসে। তারা সেখানে স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট করে। তারা ব্যাংকটিকে ম্যানেজ করে এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টরদের দায়িত্ব দেয়। তারা ব্যাংকের হেলথকে ইম্প্রুভ করে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে আবার বেশি দামে বিক্রি করে দেয়। সেন্ট্রাল ব্যাংককে দিয়ে তারা একটি গাইডলাইন তৈরি করে দেয় যেখানে ব্যাংকের ৯৯ শতাংশ শেয়ার বিদেশি ব্যাংকগুলো কিনতে পারবে বলে সুযোগ রাখা হয়। এই আইনের মাধ্যমে ব্যাংক অব আমেরিকা, জেপি মরগান, সিটি ব্যাংক চীনের দুর্বল ব্যাংকগুলোর শেয়ার কিনে নেয়। এর ফলে ব্যাংকগুলো একটি ভালো ম্যানেজমেন্টের মধ্যে চলে আসে।
একই মডেলে কাজ করে দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়া-আমেরিকান ব্যাংক এরকম সমস্যায় পড়ে। ব্যাংকটিকে টেকওভার করেছিল কার্নাইল। তারা ব্যাংকটির সুস্থতা আনার জন্য ক্যাপিটাল সহায়তা দেয় এবং পরে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং সিটি ব্যাংকের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে। এ ধরনের মডেল ইন্দোনেশিয়ায়, তুরস্কে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও অনুসরণ করা হয়েছে।
এই মডেলের মাধ্যমে ক্রেতা খারাপ ব্যাংককে ভালো ব্যাংকে রূপান্তর করে। বাংলাদেশও এ ধরনের মডেল অনুসরণ করতে পারে। আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে এটা বের করা খুব কঠিন কাজ না যে, একই সমস্যায় ইন্দোনেশিয়া কী করেছিল, একই সমস্যায় শ্রীলঙ্কা কী করেছিল অথবা একই সমস্যায় গ্রিস এবং আর্জেন্টিনা কী করেছিল। আর্জেন্টিনার আর্থিক খাতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেকগুণ বেশি সমস্যা হয়েছিল। তারা কীভাবে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠল, ব্যাংকিং সেক্টর ফেল করার পর মেক্সিকো কীভাবে সেটা থেকে বের হয়ে এলো—এসব বিষয়ের ওপর বড় বড় ব্যাংকের অনেক কেস স্টাডি রয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজনেস স্কুলের কেস স্টাডি রয়েছে। এসব কেস স্টাডি পাওয়ার জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গুগলেই এগুলো পাওয়া যায়। সুতরাং আমাদের ইচ্ছেটাই সবচেয়ে জরুরি।
আমাদের সামনে পরিষ্কার থাকতে হবে যে, কে আমাদের সংস্কারকে অর্থায়ন করবে, কে আমাদের সংস্কারকে পরিচালনা করবে এবং কে এই সংস্কার ও অর্থায়ন প্রকল্পের বাইরে গিয়ে নৈব্যক্তিক কাজগুলো সম্পাদনে সহায়তা করবে, যাতে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়ন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
কালবেলা: কয়েক মাস ধরে দেশের ব্যবসা ও শিল্পাঙ্গনে বিরাজ করছে অস্থিরতা। স্থিতিশীলতা আনয়নে কী করা যেতে পারে?
মামুন রশীদ: বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে। এ কারণে ব্যবসা অঙ্গনে বিশেষ করে সরকার ও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জনগণের চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জাতির ক্রান্তিলগ্নে একটি অজনপ্রিয় স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন, সেটা প্রত্যাশিত ছিল না। স্বাধীনতার সময়কাল থেকেই আমাদের মধ্যে একটি সন্দেহ রয়েছে যে, আমাদের ব্যবসায়ী বা পুঁজিপতি শ্রেণি কখনো দেশের পাশে দাঁড়াননি। স্বাধীনতা যুদ্ধে বা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমরা জনগণের পাশে ব্যবসায়ীদের কোনো ভূমিকা দেখিনি।
এবারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনেও ব্যবসায়ীদের জনগণের পাশে দেখা যায়নি। বরং পুঁজি পাচার ও দেশ লুটপাটে কিছুসংখ্যক আমলা, ব্যাংকার ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নেক্সাস সম্পূর্ণভাবে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে এবং এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া। দেশে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া এবং এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থ হওয়ার পেছনেও ভূমিকা রয়েছে এই ব্যবসায়ীদের। সংসদে ব্যাপক হারে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশের ফলে জনগণের পক্ষে কোনো আলোচনা সংসদে হয়নি। সব মিলে ব্যবসায়ীদের প্রতি জনমনে অনেক ক্ষোভ জমেছিল।
তবে এটাও সত্যি যে, বাংলাদেশের প্রধান ব্যবসা খাতগুলো যেমন গার্মেন্টস, ওষুধ শিল্প, খাদ্য শিল্প, এফএমসিজিগুলো যদি না চলে তাহলে দেশ চলতে পারবে না। কারণ সরকারের পক্ষে এত বড় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার সক্ষমতা নেই। সুতরাং বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য বিমোচন—এ তিনটি বিষয়কে একটি সরলরেখায় রেখে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমরা জানি রাতারাতি এটা সম্ভব নয় তবে সঠিক পরিকল্পনা এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে এটা অবশ্যই অর্জন করা সম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হতে আমাদের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা এবং সমাজের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গা ফিরিয়ে আনতে হবে।
কালবেলা: দেশের শিল্প খাতে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত মজুরি অনেক কমে গেছে।
মামুন রশীদ: দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। উৎপাদনকে সচল করতে শ্রমিকদের অবশ্যই ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। শ্রমিক এবং ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। আমাদের ওয়েজ বোর্ড রয়েছে, নতুন আরেকটি ওয়েজ বোর্ড গঠনের সময় এসেছে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে সরকারকে। শ্রমিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে এজন্য শ্রম মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে যে, একটি ঘর একদিনে তৈরি করা যায় না। তাই সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা না করে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আস্তে আস্তে এগোনো উচিত। হয়তো সময় এসেছে নতুন একটি ওয়েজ বোর্ড তৈরি করার। এজন্য শ্রমিক প্রতিষ্ঠানগুলো, সরকার ও সম্পৃক্ত বৃহত্তর অংশীজন সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আমি দেশের গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, ফার্মাসহ বিভিন্ন সেক্টরে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের কথা জানি যারা মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে ওয়েজ বোর্ডের বাইরে গিয়ে শ্রমিকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করছে। দুবেলা খাবার দিচ্ছে, টিফিন দিচ্ছে এমনকি অনেকে সাশ্রয়ই স্টোরগুলোকে সেখানে দোকান খুলে শ্রমিকদের স্বল্পমূল্যে দ্রব্যসামগ্রী কেনার সুযোগ করে দিচ্ছে। স্টোরগুলো শ্রমিকদের সুলভমূল্যে এবং বাকিতে জিনিস দিচ্ছে, মাস শেষে তার বেতনের থেকে সেই টাকা কেটে রাখছে। এ উদ্যোগগুলো আমি সাধুবাদ জানাই।
ব্যবসায়িক বন্ধুত্ব কখনো চিরস্থায়ী নয়। যদি আমাদের শিল্প খাত দীর্ঘদিন অস্থিরতার মধ্যে থাকে তাহলে তা আমাদের রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করবে। ব্যবসায়িক পার্টনাররা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না। তারা বিকল্প বাজার খুঁজে নেবে। সরকারের উচিত, আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প, আমাদের ওষুধ শিল্প, এফএমসিজি, ফুড সেক্টরসহ অন্যান্য সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোতে ব্যাপক সহায়তা করার উদ্যোগ নেওয়া। যাতে আমরা উদ্ভূত সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারি।
কালবেলা: গত ১৫ বছরে দেশে ঋণখেলাপি যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যাপক পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরানোর উদ্যোগের কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটা কতটা সহজ হবে?
মামুন রশীদ: বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা এতটা সহজ নয়। কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা জেলে রেখে তার পাচার করা সম্পদ ফেরত আনা সম্ভব নয়। পাচারের টাকা ফেরত আনতে হলে আমাদের আইনের আশ্রয় নিতে হবে এবং এটা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ একটি ব্যাপার। দেশ থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে সেগুলো কোন দেশের কোন ব্যাংকের এবং কোন অ্যাকাউন্টে রয়েছে, তা আমরা জানি না। যেসব দেশে এই পাচারের টাকা গিয়েছে তারাও টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে আন্তরিক থাকে না। কারণ এ টাকা তাদের অর্থনীতিতে কাজে লাগছে এবং তাদের জন্য লাভজনক।
সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকংয়ের মতো জায়গার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে অনেকটা বিদেশি বিনিয়োগ এবং পাচারের টাকায়। তারা এটুকু নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, সে দেশের কেউ টাকা নিয়ে গেলে তার তথ্য গোপন রাখা হবে। শুধু সিঙ্গাপুরের ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের আন্ডারে থাকা ২৪ বিলিয়ন ডলার ডিপোজিটের মধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারই ইন্দোনেশিয়ার ধনাঢ্যদের টাকা। এ টাকা সিঙ্গাপুর পেয়েছে। কারণ তারা গ্যারান্টি দিয়েছে যে, তারা বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেবে। পাচারের টাকা যেসব দেশে যায় সেসব দেশের এখানে বড় একটি ভূমিকা থাকে। সুতরাং টাকা ফেরত আনতে তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আমরা যতই বলি না কেন যে পাচারের টাকা ফেরত আনব, এটাতে আবেগপ্রবণ হওয়ার সুযোগ নেই। সেটা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন।
কালবেলা: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
মামুন রশীদ: সরকার যে সংস্কার উদ্যোগগুলো নিচ্ছে এটা অবশ্যই আমাদের জন্য খুশির ব্যাপার। আমি চাই সরকার সফলভাবে এ কাজগুলো সম্পন্ন করুক। সরকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন হবে দুর্নীতি দমন করা। কারণ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। এখানে টাকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ। এখান থেকে দেশকে বের করে নিয়ে আসা কষ্টকর হবে। দুর্নীতি দমন এবং প্রশাসন সংস্কার নিয়ে অনেক দেশে অনেক কাজ হয়েছে। আমরা সেসব কাজ থেকে প্রয়োজনীয় আইডিয়া নিতে পারি।
আমাদের প্রশাসনিক সংস্কারটা অনেক জরুরি। প্রশাসনের আকার কতটুকু হবে, কয়টি মিনিস্ট্রি থাকা উচিত, কতদিন সচিব থাকা উচিত এবং তাদের সিলেকশন ও প্রমোশন সবকিছুই এ সংস্কারের আওতায় আসা উচিত। আমাদের পুলিশ বাহিনীর সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজন। পুলিশের কাজ যেখানে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া, সেখানে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী দল দমনের হাতিয়ার হিসেবে এবং জনগণের মাথায় লাঠি মেরে টাকা আদায় করার বাহিনী হিসেবে। একই সঙ্গে পুলিশ ব্যবহৃত হয়েছে দুষ্টলোকদের শাসন, স্বৈরাচারীর শাসনকে প্রলম্বিত করার হাতিয়ার হিসেবে।
সবমিলে পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের মাধ্যমে যদি একটি নতুন বাংলাদেশ গঠন করা যায়, সেটাকে আমি স্বাগত জানাই। সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করে ওঠা সহজ হবে না। তাই আমাদের জনগণকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিয়ে সরকারের সঙ্গে থাকা প্রয়োজন।