বিশ্বের প্রায় সব স্বৈরাচারী শাসকই ক্ষমতাচ্য়ুত হওয়ার পর করুণ পরিণতি ভোগ করেছেন। বিক্ষুব্ধদের হাতে খুন, রাষ্ট্রীয় বিচারে হত্য়া, নির্বাসনে নিঃসঙ্গ করুণ মৃত্য়ু অথবা আমৃত্য়ু কারাবাসে তাদের নিয়তি নির্ধারিত হয়েছে। এর মধ্য়ে বিরল ব্য়তিক্রম প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দীর্ঘ জীবনে ভোগবিলাসের ব্য়ত্যয় ঘটেনি তার। নীতিহীন রাজনীতির মাঠ পেয়ে খেলে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। দুর্নীতিবাজ, লম্পট পরিচিতি পেলেও আঞ্চলিক রাজনীতিতে ছিলেন জনপ্রিয়। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কাছে জোটসঙ্গী হিসেবে ছিলেন প্রথম পছন্দ। শীর্ষ দুই নেত্রীকে ছলচাতুরীর মাধ্য়মে রেখেছেন শশব্য়স্ত। অথচ, তাদের জীবনের অনেক মূল্য়বান সময় খরচ করতে হয়েছে এরশাদের পতনের জন্য়। এসব দেখে মনে হতে পারে, তার বেলায় নিউটনের তৃতীয় সূত্র ঠিকঠাক কাজ করেনি। সূত্রটি হলো—‘প্রত্য়েক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ বোঝার সুবিধার্থে এ ক্ষেত্রে বলা যায়, মানুষকে কষ্ট দিলে তা কোনো না কোনোভাবে নিজের জীবনে ফিরে আসে। অন্য়ের ক্ষতি করলে নিজেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। সুকর্ম বা কুকর্ম দুটিরই প্রতিদান পায় মানুষ। ক্ষতির শিকার লোকটি না পারলেও প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। সবার সব হিসাব পাই পাই করে বুঝিয়ে দেন স্রষ্টা। সেটা যে সবসময় একইভাবে হবে, তা নয়। পরাক্রমশীল শাসক এরশাদ মারা গেছেন রাজনৈতিক জোকার হিসেবে। এককালের খুনি স্বৈরাচারী বিশ্ববেহায়া এরশাদ বাধ্য় হন ফ্য়াসিস্ট কওমি জননীর আঁচলে আশ্রয় নিতে। তার বিশেষ দূত হয়ে রাজনীতিতে দুধভাত বনে যান তিনি। তার দলীয় এমনকি পারিবারিক কোন্দল মেটাতেও ছুটে যেতে হতো গণভবনে কর্তৃত্ববাদী হাসিনার কাছে। এমন করুণ পরিণতিতেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন কারামুক্ত জীবন পেয়ে। তার ম্লান সুরের ঘেউ ঘেউ তৃপ্তি নিয়ে উপভোগ করেছেন পলাতকা প্রধানমন্ত্রী। বশংবদ বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা ভয়ংকর স্বৈরাচারী এরশাদের চেয়েও লজ্জাজনক। এমন জীবন হয়তো তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। কিছু ভালো কাজের বিনিময়ে হয়তো স্বাভাবিক মৃত্য়ুর গ্য়ারান্টি পেয়েছিলেন এরশাদ। কিন্তু কোনো ব্য়ক্তিত্ববান রাজনীতিবিদের মর্যাদা জীবনে কোনোদিন পাননি তিনি। শেষ জীবন কাটাতে হয়েছে তার চেয়েও ভয়ংকর স্বৈরাচারীর অঙ্গুলিহেলনে। নির্লজ্জতার শৃঙ্খল ভেঙে জীবদ্দশায় আর সোজা হতে পারেননি। এদিক থেকে চিন্তা করলে তৃতীয় সূত্রের সর্বোচ্চ ব্য়বহার হয়েছে তার বেলায়।
ফ্য়াসিস্ট শাসনব্য়বস্থার কারণে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ঝুলছিল খাদের কিনারে। এটা দেখেছিল খাদের নিচে পড়ে থাকা বিএনপি, সমমনা রাজনৈতিক দল ও নিপীড়িত জনগণ। দেখেছিল বলেই তারা হাল ছাড়েনি কখনো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং আনহোলী চক্রের পেশাজীবীরা দেখতে পাননি। কেননা, তারা ছিলেন খাদের ওপর বিস্তীর্ণ সবুজ উচ্চভূমিতে। সেখানে সবকিছুই পরিপাটি। গলফ ক্লাবের মতো। মাঝেমধ্যে অবশ্য় দেশের খবর জানতে গলফ ক্লাবে তারা ডেকে নিতেন সুবিধাভোগী সাংবাদিকদের। সেখানে খবর যাচাইয়ের চেয়ে নির্দেশনা চাপানোয় আগ্রহ ছিল বেশি। টানা তিন মেয়াদের প্রথম সরকার পরিচালনায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের ৩২ বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। পরেরবার হীরকরাজ্য়ের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামেন বঙ্গবন্ধুকন্য়া, সম্রাজ্ঞী (!) শেখ হাসিনা। সরকার, বিরোধী দল, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন সবকিছু ঢেলে সাজান তিনি। পরিস্থিতি বোঝাতে একটি সংগৃহীত গল্প যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ‘বরযাত্রা ও বিয়েবাড়ির মজা দেখে ছোট্ট শিশু বাবার কাছে একটা কথা জানতে চায়। তুমি বিয়ে করবে না আব্বু? বাবা হেসে বলে, করেছি তো। ছেলে জানতে চায় কাকে? সে বলে, তোমার মাকে। বিস্ময় নিয়ে ছেলে বলে—ও, তোমরা তোমরাই?’ শিশুটির ধারণা ছিল, বিয়ে করতে দূরে যেতে হয়। হ্য়াঁ, দশম সংসদ থেকে তারা তারাই রাজনীতির নামে খেলা-খেলা শুরু করে। ত্য়াগী আওয়ামী লীগ, হাইব্রিড আওয়ামী লীগ, বড় আপা, ছোট আপা, দেশি গোয়েন্দা-বিদেশি গোয়েন্দা নানান গ্রুপে খেলা চলে হরদম। এসব গ্রুপের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন, অর্থ পাচার, ঠিকাদারি, দখল, মদ, নারী নিয়েও ঝগড়া চলে পর্দার আড়ালে। বাগড়া দিতে গুম-খুন-অপহরণ পর্যন্ত গড়ায় বিভিন্ন বাহিনীর বিপথগামী সদস্য় চক্রের সহায়তায়। আপসরফায় ভূমিকা রাখতে হয় কাছের অনেক সাংবাদিক ভাইবোনকে। এমনকি প্রতিবেশী দেশের আশীর্বাদ কেন্দ্র করেও গ্রুপ গড়ে ওঠে। ইয়োগা, ইসকন, সাউথ ব্লক, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের প্রতিনিধি পরিচয়ের প্রতিযোগিতাও চলে প্রকাশ্য়ে। এসবে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে আওয়ামী লীগের পুরোনো নীতিনৈতিকতা বোধ। কিন্তু যখনই বিরোধী দলের কর্মসূচি ঘোষিত হয়; সব শিয়ালের এক রা—হুক্কাহুয়া। স্বাধীনতা গেল গেল বলে সার্বভৌমত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মাঠে নেমে পড়ে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর দমন আর গণমাধ্য়মের কঠিন বয়ান। সাব্য়স্ত হয়, দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র প্রমাণে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজপথে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে। জনগণ তাদের প্রতিহত করেছে। যদিও হেলমেট বাহিনীর প্রকাশ্য় সন্ত্রাস দেখেছে নির্বাক জাতি। এভাবে বারবার পার পেলেও হিসাবের খাতায় জমা পড়ে যায় অনেক দেনা। নাটক হাজার জনপ্রিয় হলেও সমাপ্তি একসময় টানতেই হয়। তাইতো, দেড় দশকে বড়রা যা পারেনি; দেড় মাসে তা করে দেখিয়েছে শিশুরা। নমরুদের পতনও তো হয়েছে সামান্য় মশার আক্রমণে। কিন্তু সমস্য়া রয়েই গেল পলাতক আওয়ামী লীগের অশরীরী অপপ্রচারে। গণঅভ্য়ুত্থানে শহীদ মুগ্ধর মৃত্য়ু নিয়ে সন্দেহ ছড়ায় তারা। এর প্রতিক্রিয়ায় শেখ রাসেলের মৃত্য়ু নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বিক্ষুব্ধরা। তারা বলে, শেখ তাপসই শেখ রাসেল। ফল, চারপাশে ঘৃণার বাম্পার ফলন। ১৭ বছরের গায়েবি মামলার প্রতিক্রিয়ায় গত কয়েক মাসে হয়েছে হাজার হাজার অযৌক্তিক মামলা। আওয়ামী লীগকে অনুধাবন করতে হবে, তাদের এ পরিণতি শুধু পরিকল্পিত নয়। এটা ছিল অনিবার্য। নিজের শরীরে লাগলে বেশি বেশি মনে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রিয়ার চেয়েও প্রতিক্রিয়া বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু এর জন্য়ও দায়ী আওয়ামী লীগের অপরিণামদর্শিতা।
অভ্য়ুত্থানের পর বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুহাত তুলে সমর্থন দিয়েছে দেশের জনগণ। যে কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে সংবিধান বা নির্বাচনের দরকার পড়েনি। কিন্তু গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকায় সজাগ রয়েছে দেশবাসী। যেজন্য় পান থেকে চুন খসলেই সরকারকে ধুয়ে দিচ্ছে ভয়ভাঙা জাতি। সুখের খবর, নির্ভয়ে কথা বলছে পলাতক ফ্য়াসিস্ট আওয়ামী সমর্থকরাও। দুঃখের বিষয়, নানা রূপে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে তারা। হাজার উসকানিতে সরকার এখনো আওয়ামী লীগের মতো দমননীতিতে যায়নি। তবে সরকার সমর্থক কিছু রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন তাদের ফাঁদে পা দিয়ে উগ্র আচরণ করছে। গণমাধ্য়মের বিরুদ্ধে তাদের হঠকারী কর্মসূচি নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো। ভয় দেখিয়ে বা সুবিধা দিয়ে দেশের অনেক সাংবাদিককে বশংবদ করে রেখেছিল হাসিনা সরকার। এ কথা সত্য়। তবে জনগণকে পলাতক সরকারের কুকীর্তিগুলো আবার জানিয়েছে এ গণমাধ্য়মই। নির্দিষ্ট কোনো সাংবাদিক বা গণমাধ্য়মকে টার্গেড বানানোর ফল ভালো হয় না। সেটা পালিয়ে গিয়ে প্রমাণ করেছেন শেখ হাসিনা। সরকারকে একটা সুষম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যেখানে গণমাধ্য়ম জনগণের কথা বলবে। গণশত্রুর পক্ষ নেবে না। ভয়ভীতি প্রদর্শন করে প্রীতির সম্পর্ক হয় না। হাসিনা রেজিমে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক শিল্পপতি হয়েছেন। শতাধিক সাংবাদিক কোটিপতি হয়েছেন বলে প্রচারণা আছে। আয়ের বৈধ উৎস না থাকলে বা হিসাবে গরমিল পেলে তাদের অপরাধ অনুযায়ী মামলা হতে পারে। তাই বলে হত্য়া মামলা! এটা তো গণঅভ্য়ুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে যায় না। হাসিনার মতো হিংসুক সরকারের প্রেতাত্মা মনে করবে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ। নিউটনের তৃতীয় সূত্র মাথায় রেখে সরকার পরিচালনা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক আমলের ‘উদ্দীন সরকারের’ প্রধান দুই ব্য়ক্তি আজও দেশছাড়া। অথচ, তাদের ভদ্রলোক হিসেবে চিনত দেশবাসী।
এ সরকারের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা বিএনপির মতো পোড় খাওয়া দলের নিঃশর্ত সমর্থন। সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ দলটি দিনের পর দিন সহযোগিতা অব্য়াহত রেখেছে জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণে। যৌক্তিক সময়ে সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া তাদের আর কোনো চাওয়া নেই। এই পর্যায়ে আসতে টানা সতেরো বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের। ক্ষমতায় থাকতেই গণমাধ্য়মের পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়েছে। ক্ষমতা হারানোর পর তাদের প্রতি মানুষের মমতাও আটকে ছিল নানা কূটকৌশলে। হাইকোর্টের মাধ্য়মে তারেক রহমানের বক্তব্য় গণমাধ্য়মে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তারপরও আক্রান্ত গণমাধ্য়মের পাশে দাঁড়িয়েছে দলটি। প্রতিহিংসা প্রকাশ করেনি। বিএনপি নেতারা বলেন, তারেক রহমান এখন আগের চেয়ে অনেক পরিণত। তার মানে অতীতে কিছু ত্রুটি থাকলেও থাকতে পারে। প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়ার উদারতা চর্চা করছেন তারা। অতীতে হয়তো অপপ্রচার ঠেকাতে তার পারিষদবর্গ খুব একটা মেধার পরিচয় দিতে পারেননি। সারা দেশে সংগঠন ও কোটি কোটি সমর্থক থাকার পরও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। অথচ, আন্দোলনের ভূমিকা নিয়ে তাদের পাশাপাশি এখন দাঁড়িয়েছে অনেক ভাগীদার। তারপরও উদার বিএনপি কাউকে বাদ দিতে চায় না। এ নিয়ে কট্টরপন্থি দলগুলো দিচ্ছে নানা হুংকার। তারা জানলেও মানে না, এ দেশের মানুষ শুধু ধর্মপ্রাণ নয়, একই সঙ্গে সংস্কৃতিবানও। ধর্মীয় গোঁড়ামির জিকিরে ভোট দিতে ভুল করেনি কখনো শত পীর-দরগাহ-আশ্রমে বিভক্ত বাংলাদেশিরা।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, কালবেলা