দুর্নীতি ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো নীতি ছিল না। এটা যেমন পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার জন্য প্রযোজ্য, তেমনি তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও সত্য। এই সত্যকে উপেক্ষা করার নৈতিক শক্তি খোদ তাদের অনুসারীদেরও নেই। স্বাধীনতার পর মুজিব সরকারের শাসনামলে ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে সহায়-সম্বলহীন মানুষের কম্বল চুরির মাধ্যমে যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই ধারার অবসান ঘটেছে রিজার্ভ লুট, আর্থিক খাত ধ্বংস এবং হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে। সম্প্রতি টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনার সরকারের আমলে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ থেকে যে পরিমাণ টাকা ব্রিটেনে পাচার করেছে, শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় তার চেয়ে বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। মুজিবের দুঃশাসনের পতন ঘটেছিল পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে, আর তার কন্যা শেখ হাসিনার পতন ঘটল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে কাকতালীয়ভাবে শেখ হাসিনারও পতন ঘটেছে সেই আগস্ট মাসে। তাই আগস্ট সত্যিকার অর্থই মুজিব পরিবারের জন্য শোক ও অনুশোচনার মাস।
শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার শাসনামলের দুর্নীতি এবং দুঃশাসনের ধরন থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এরা দেশকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করতেন। শেখ হাসিনার পতনের পর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গত পনেরো বছরের অর্থনৈতিক দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন তুলে দিয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এরই মধ্যে এ শ্বেতপত্রের কিছু অংশ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা অপচয় বা নষ্ট হয়েছে। গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর ৪০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা লুটপাট করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে মূলত রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে এই বিপুল অর্থ লুটপাট করেছেন বিদায়ী ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাভোগীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি ডলার বা ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বাজারদরে) অর্থ এডিপির মাধ্যমে খরচ হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে, এডিপির মাধ্যমে যত টাকা খরচ করা হয়েছে, এর ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অপচয় ও লুটপাট হয়ে গেছে। ১৪ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ চাঁদাবাজি, ঘুষ ও বাড়তি খরচের নামে চলে গেছে। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
শেখ মুজিবের পতনের পর তার দুর্নীতি নিয়েও শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই সময় বহুল আলোচিত বিষয় ছিল ব্যাংক ডাকাতি ও রেড ক্রসের কম্বল চুরি। খোদ শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের বিরুদ্ধেও ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ ছিল। পঁচাত্তরের ১৪ অক্টোবর সেগুনবাগিচার রেড ক্রস চেয়ারম্যানের সচিবালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি সিদ্দিকী শেখ মুজিবের শাসনামলের সাড়ে তিন বছরের রেড ক্রসের কার্যকলাপ সংবলিত একটি ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেন। ফুলস্কেপ কাগজে ইংরেজি ভাষায় টাইপ করা ১৬ পৃষ্ঠাব্যাপী এই তথ্য বিবরণীতে তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রসের কার্যকলাপের আংশিক চিত্র তুলে ধরেন। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকসহ সব পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়। শ্বেতপত্রে আওয়ামী লীগ নেতা বিশেষ করে রেড ক্রসের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার দুর্নীতির বিবরণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য দান হিসেবে আসা অর্থ ও সাহায্য পুরোপুরি আত্মসাৎ করা হয়। গরিব মানুষের জন্য লাখ লাখ কম্বল এলেও তা প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা ভাগবাটোয়ারা করে নেন। রিলিফের চাল, গম, খাদ্য শস্য, বিস্কুট গাজী গোলাম মোস্তফার হাঁস-মুরগি-কুকুরের জন্যও ব্যবহার হয়েছে। শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য রেড ক্রসের পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ছিল। কিন্তু সেগুলো শিশুদের মধ্যে বিতরণ করা হয়নি।
প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ:
১৯৭২ সালের জানুয়ারি হইতে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কোনো স্টক বই ও ক্যাশ বই পাওয়া যায় নাই। ইতিমধ্যে সমিতির আর্থিক লেনদেন এবং সাহায্য সামগ্রী বিতরণের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করার জন্য একটি বিশেষ অডিট পার্টি নিয়োগ করা হইয়াছে। সেইসঙ্গে সরকার বিগত তিন বছরের কার্যকলাপ সম্পর্কে পুলিশ তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন। এই দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে ৩-৪ মাস সময় লাগবে বলে তিনি জানান।
বিচারপতি সিদ্দিকী বলেন যে, এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া না গেলেও রেড ক্রসের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার বহুল আলোচিত দুর্নীতির কিছু চিত্র জনসমক্ষে তুলিয়া ধরা আবশ্যক। তিনি বলেন, ১৯৭২ ও ’৭৩ সালে বিপুল পরিমাণ সাহায্য সামগ্রী আসলেও কোনো স্টক রেজিস্টার রাখা হয় নাই এবং স্টোরের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মচারীদের ঘন ঘন বদলি করা হইয়াছে। অথচ একে অপরের নিকট হইতে চার্জ বুঝিয়া নেয় নাই।
তিনি বলেন, সামান্য যে রেকর্ডপত্র পাওয়া গিয়াছে উহাতে দেখা যায় যে, মাস্টার রোল বা বিতরণের রিপোর্ট ছাড়াই কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে বিপুল পরিমাণ কম্বল, কাপড়, দুগ্ধ ও খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হইয়াছে এবং তাহাদের গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির জন্যও প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়।
সমিতির অফিস হিসেবে ব্যবহৃত বড় মগবাজারস্থ একটি বাড়িতে রেড ক্রসের চেয়ারম্যানের গবাদি পশু রাখা হইত এবং উহাদের জন্য সমিতির রিলিফ স্টক হইতে চাউল, গম ও অন্যান্য খাদ্য সরবরাহ করা হইত। সাবেক চেয়ারম্যানের ৯২, গুলশানস্থ সচিবালয়, মোহাম্মদপুরের ‘অতিথিশালা’, আরেকটি অতিথিশালা বলিয়া কথিত ১০৮ নং গুলশানস্থ বাড়ী ও নয়াপল্টনস্থ চেয়ারম্যানের নিজস্ব বাড়ির জন্য প্রচুর পরিমাণ সাহায্য সামগ্রী বরাদ্দ করা হয় এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাউল, গম, অন্যান্য খাদ্যশস্য, বিস্কুট, দুধ, চিনি ও সাবান প্রভৃতি সাহায্যদ্রব্য সমিতির কতিপয় কর্মচারী এবং সাবেক চেয়ারম্যানের হাঁস, মুরগি ও কুকুরের জন্য ব্যবহৃত হইত।
বিচারপতি সিদ্দিকী বলেন যে, প্রচলিত রীতিনীতিকে পরিহার করিয়া শুধু ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ২৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয় এবং এইগুলিতে অধস্তন কর্মচারীরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে লেনদেন করিত। অবশ্য অর্থ ও হিসাবরক্ষণের জন্য কোনো ঊর্ধ্বতন অফিসার ছিল না। ম্যানেজিং বোর্ডের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও কোন অর্থপরিচালক নিয়োগ করা হয় নাই এবং চেয়ারম্যান ও কোষাধ্যক্ষকে যুক্তভাবে অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য বলা হইলেও তাহা গ্রান্ড করা হয় নাই। বরং চেয়ারম্যান দূরবর্তী একটি ব্যাংকে এককভাবে অ্যাকাউন্ট খোলেন এবং এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ’৭৪-৭৫ সালে ২৫ লক্ষাধিক টাকার লেনদেন হয়।
এ পর্যন্ত রেড ক্রসের মাধ্যমে কী পরিমাণ সাহায্যসামগ্রী আসিয়াছে এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি সিদ্দিকী বলেন যে, প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র না থাকায় এখনো উহা জানা সম্ভব হয় নাই। তবে তিনি এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সমিতির নিকট যে পত্র লিখিয়াছেন উহার জবাবে প্রেরিত সাহায্য সামগ্রীর আংশিক চিত্র পাওয়া গিয়াছে। তিনি জানান যে, অক্টোবরের শেষ নাগাদ তিনি আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতির বোর্ড অব গভর্নরস-এর বৈঠককালে জেনেভা গমন করিবেন এবং তখন এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যাইতে পারে।
গত বৎসর অনাহারে প্রাণহানি প্রসঙ্গে রেড ক্রসের চেয়ারম্যান বলেন যে, সঠিকভাবে খাদ্য সরবরাহ করিলে মৃত্যুর সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পাইত। তিনি জোর দিয়া বলেন, শিশুদের বাঁচাইয়া রাখার জন্য রেড ক্রসের পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ছিল।
বিচারপতি এবি সিদ্দিকী বলেন, সমিতির পরিবহন বিভাগের অবস্থাও শোচনীয়। উপহার হিসেবে প্রাপ্ত সমিতির ২৯৮টি গাড়ির মধ্যে ৯০টি হালকা গাড়ি, ১৬২টি ট্রাক, ৪৬টি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি বাস। এগুলোর মধ্যে বর্তমানের ৪৫টি হালকা গাড়ি, ৭০টি ট্রাক ও ১২টি অ্যাম্বুলেন্স চালু আছে এবং বাকিগুলো মেরামতের জন্য অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছে।
১৯৭২ সাল হইতে ’৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এই গাড়িগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি তেল বাবদ যে খরচ হইয়াছে উহা নিম্নরূপ : হালকা গাড়ি ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭ ১৩ টাকা, ট্রাক ৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৪৩ টাকা, অ্যাম্বুলেন্স ৮ লাখ ৫১ হাজার ৫৮০ টাকা ও বাস ৮ লাখ ৭৯ হাজার ১০৭ টাকা।
তিনি বলেন, এই গাড়িগুলো ব্যক্তিস্বার্থে যথেচ্ছভাবে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরেই সমিতি অফিসার, কর্মচারী, চেয়ারম্যানের দেহরক্ষী এবং তাহার পুত্র ও তদীয় সাঙ্গোপাঙ্গরা দেড় ডজন গাড়ি অপব্যবহার করে। ইহার ফলে মাসে গড়পড়তা ৪৫ হাজার টাকার পেট্রোল পুড়িয়াছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে ড্রাইভারদের ৪ লাখ টাকা ওভার টাইম দেওয়া হয়। অথচ তাহাদের মোট বেতনের পরিমাণ হইল এক লাখ টাকা।
(ইত্তেফাক: ১৫ অক্টোবর বুধবার, ১৯৭৫)
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক