এক
রোল মডেলের জন্য জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকবেন না। আপনার আগামী দিনের আপনিকে রোল মডেল করুন। বুদ্ধদেবের এক বইয়ে পড়েছিলাম ‘আত্ম দীপ ভবো’—নিজেকে নিজের মডেল করুন। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আয়নার দিকে তাকিয়ে বলুন, মানুষ আন্তরিকভাবে যা চায়, তা পায়। আমি চাই আমি যেন আজকের চেয়ে আরও উন্নত হই। আমাকে তুমি ঈর্ষাহীন, লোভহীন, দ্বেষহীন মডেল মানুষে পরিণত করো। সবাই আমাকে ঈর্ষা করুক বা দ্বেষ করুক, আমি যেন কাউকে ঈর্ষা না করি। আমাকে লোকে ঠকাতে পারে, কিন্তু আমি যেন কাউকে না ঠকাই। আমাকে লোকে দুঃখ দিতে পারে, তবে আমি যেন কারও দুঃখের কারণ না হই।
আমার ভালো কথা লোকেরা বিদ্রুপ করেও উড়িয়ে দিক, আমি যেন নিজের সব উচ্চারিত বাক্যগুলো মেনে চলি। যখন সবাই আমাকে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দেবে, আমি যেন তাদের ঘৃণা না করে বরং করুণা করি। আর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকে বলুন, ‘আমি কারও কাছ থেকে কিছু আশা করব না, হে আগামী দিনের আমি, আমি তোমার ওপর আশা রাখব। তুমি কখনো আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। তুমি আমাকে অন্যের জন্য পথ দেখাবার মশাল না দিলেও চলব শুধু, জোনাকির মতো নিজের আলোয় আমার পথ চিনতে সাহায্য করো।’
দুই
যে যুদ্ধ আপনি কখনো করেননি, সেই যুদ্ধে আপনি সবসময় জয়ী। যে দেশে কখনো যাননি, সেই দেশটাই আপনার কাছে সবচেয়ে সুন্দর। কল্পনায় হারিয়ে যাওয়ার কোনো বাধা নেই, তবে বাস্তব জীবনে আপনি কখনো জিতবেন, কখনো হারবেন। নতুন দেশে গিয়ে নতুন সমস্যার মুখোমুখি হবেন। তাই যদি শুধু জিততেই চান, তবে টিভিতে যুদ্ধ দেখুন। কিন্তু শুধু প্রত্যাশা বাদ দিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকলে আর হতাশ হতে হবে না—এ চিন্তাটাও ভুল। কারণ চুপচাপ পড়ে থাকা জীবন নয়, বরং মৃতের লক্ষণ। জীবন মানে চলা, চেষ্টা করা এবং একটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আপনি যা পারবেন না বলে ভাবছেন, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে একমুখী লক্ষ রাখুন। মনে রাখবেন, কাজটা শুরু করার আগে বলুন, ‘আমি পারব।’ কারণ ‘আমিও পারতাম’ এ আফসোসের চেয়ে কিছু করে দেখানোর আনন্দ অনেক বড়। মৃত্যুর আগে একবার নিজের হিসাবের খাতা খুলুন। দেখুন, জমার ঘরে কতটা জমা হয়েছে। তবে সেই হিসাব কারও কাছে নয়, শুধু নিজের কাছে। নিজের সাফল্য আর ব্যর্থতার বিচার করবেন আপনি নিজেই।
তিন
চরিত্র আর ব্যক্তিত্ব এক নয়। ব্যক্তিত্ব হলো persona: মুখোশ। এটি ক্ষণে ক্ষণে বদলানো যায়। কিন্তু চরিত্র তার ভেতরের অন্তর্নিহিত এক চিরন্তন সত্তা, যা তার বংশগতি এবং পরিবেশের প্রভাবে গড়ে ওঠে। এটি ঘড়ির কাঁটার মতো আপনগতিতে চলে। কিন্তু সব ঘড়ি সমান সময় দেয় না। আবার ভৌগোলিক সীমানা অনুযায়ী সময়ের হেরফের হয়। এজন্য ঘড়ির মালিককে সবসময় ঘড়ি মিলিয়ে চলতে হয়। কার সঙ্গে? যে ঘড়ি ঠিক সময় দেয় বলে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, তার সঙ্গে।
তাই চরিত্রকে কতগুলো আদর্শমানের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়। যেমন একজন অনুবাদককে মৌলিক লেখাটির সঙ্গে মেলাতে হয়, তেমনি চরিত্রকে মেলাতে হয় কতগুলো সর্বস্বীকৃত ইতিবাচক মূল্যবোধের সঙ্গে। এগুলো পৃথিবীর সর্বত্র এক। যেমন উদারতা, সত্যনিষ্ঠা, সততা, সমত্ববোধ ও নৈর্ব্যক্তিকতা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক উপাদান হলো consistency বা চরিত্রের ধারাবাহিকতা। আজ একরকম, কাল আরেকরকম হলে চলবে না। গৃহীত মূল্যবোধের প্রতি একনিষ্ঠ থাকা জরুরি।
যে মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখে না, প্রতিজ্ঞা পালন করে না, কাজ শুরু করে শেষ করে না, সেই মানুষই চরিত্রভ্রষ্ট হয়। পুরুষ হলে সে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ করে। নারী হলে বহু পুরুষকে প্রলোভিত করে নিজের কাজ স্বার্থসিদ্ধ করে নেয়। রাজনৈতিক নেতারা সমাজ বদলানোর বা পরিবর্তন প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুধু নিজের আর্থিক অবস্থার বদল ঘটায়। তার কথায় ও কাজে সংগতি রাখেন না...
সে শুধু অন্যকে টেনে নামাতে জানে, কাউকে তুলতে জানে না। সে চোখ রাঙাতে জানে, কান ভাঙাতে জানে, কিন্তু মানুষের মন রাঙাতে জানে না। চরিত্রবলের অভাব সে পূরণ করে বাহুবল দিয়ে। আর চরিত্রবান এবং সর্বত্যাগীর পোশাক পরে ভণ্ডদের মতো মানুষের প্রণাম নিয়ে বেড়ায়।
জনসাধারণ ব্যক্তিত্বকেই চরিত্র মনে করে এবং তাদের সালাম ঠোকে...। কিন্তু একটা গোটা জাতির ঘড়ি যে ঠিক সময় দিচ্ছে না, তা কেউ বুঝতে পারছে না। কারণ সমাজের রোল মডেলদের হাতে যে ধীরগতি ঘড়ি রয়েছে, তার সঙ্গে সবাই নিজেদের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়েছে। তাই এখন সবাই ভাবছে কেউ ভুল নয়, সবাই ঠিক।
‘চরিত্রহীন’ একটি উপন্যাসের নাম। আসলে চরিত্রহীন বলে বাংলায় কেউ নেই।
লেখক: বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী